E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতিদরিদ্রের তালিকায় আ. লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সচ্ছল নেতা-কর্মীদের নাম!

২০২১ এপ্রিল ২৬ ১৪:৪৭:২১
অতিদরিদ্রের তালিকায় আ. লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সচ্ছল নেতা-কর্মীদের নাম!

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের তালিকায় সরকারি দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি ও তাদের স্বজনদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে স্বচ্ছল ও সম্পদশালী ব্যক্তির নামও। ইউপি চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে এই তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের অনেকেই।

এই প্রকল্পে ছবিলাপুর আজিমউদ্দিনের বাড়ি হইতে ছবিলাপুর মোতালেবের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত কাজে ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ও নন-ওয়েজ কস্ট ১ লাখ ১০ হাজার ৩৮২ হাজার টাকায় শ্রমিক হিসেবে ৮৭ জন অতিদরিদ্র লোকজনের কাজ করার কথা ছিল। ৮৭ জনের তালিকার মধ্যে ৭০ জনই সরকারি দলের নেতাকর্মী, চেয়ারম্যান-মেম্বারের স্বজন ও সচ্ছল ব্যক্তি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অতিদরিদ্র লোকজন অভিযোগ করেন, 'চেরম্যান মুখ দেইখ্যা দেইখ্যা নিস্টি করছে। টেহা চাইছিল, দিবের পাই নেই, তাই নামও উঠে নাই।'

এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, 'ঠিকমতো খেয়াল করিনি। এত শ্রমিকের নাম পড়া যায় না। তাছাড়া সময়ও পাইনি।'

প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্র জানায়, উপজেলার ঘোষের পাড়া ইউনিয়নে অতিদরিদ্র কর্মসংস্থানের ৩টি প্রকল্পের জন্য ৩৭২ জন শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। যাচাই-বাছাই করে অতিদরিদ্র লোকজনদের শ্রমিকের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। ৩ নম্বার প্রকল্পে ৮৭ জন অতিদরিদ্র শ্রমিকের নামের তালিকায় ৭০ জন স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম উঠেছে।

অতিদরিদ্র কর্মসংস্থান প্রকল্পের শ্রমিক তালিকার বিবরণে জানা যায়, অতিদরিদ্র শ্রমিকের নামের বদলে তালিকায় নাম উঠেছে চেয়াম্যানের পুত্র ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সিরাজুল আলম, পুত্রবধূ জীবুন নাহার, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি সামিউল আলম, ভাই ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি সরোয়ার আলম, তার ছেলে মফিউল আলম, আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খাদেমুল মুরসালিন খোকন, রায়হানুল ইসলাম, অর্থ সম্পাদক চাঁন মিয়া, ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক মো. রবিউল, ছাত্রলীগ সভাপতি রিফাত আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান, শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেল মিয়া, মহিলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি নাজমা আক্তার জীবন, ইউপি সদস্য চাঁন মিয়ার ছেলে আসলাম মিয়া ও ভাতিজা রাসেল মাহমুদসহ ৭০জন নেতা, জনপ্রতিনিধি ও স্বজনদের নাম। সেই সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য স্বচ্ছল ব্যক্তির নামও। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইউপি সদস্য চাঁন মিয়ার মৃত ছেলে আসাদুজ্জামানের নামও।

ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি সামিউল আলম। তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও ধনী ব্যক্তি। অতিদরিদ্রের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্তির কথা স্বীকার করে বলেন, 'অনেকের মতো আমার নামও অতিদরিদ্রের তালিকায় উঠেছে। এটা ঠিক হয়নি।' এ বিষয়ে আর কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রিফাত আহমেদ বলেন, 'দলীয়ভাবে তালিকায় আমার নাম গেছে। ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমার কাছে ভোটার আইডি কার্ড চেয়ে নিয়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর বেশি কিছু আমি জানি না।'

ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্তির কথা স্বীকার করে বলেন, 'তালিকায় অতিদরিদ্রদের নামই যাওয়া উচিৎ। তবে দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের নাম যাওয়ায় আমার নামও দিয়েছি।'

ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন বলেন, 'সবার সাথে আমার নামও দিয়েছিলাম। এখন বুঝতাছি অতিদরিদ্রের তালিকায় আমার নাম যাওয়া ঠিক হয়নি।' তার নাম প্রত্যাহার করে নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন এই যুবলীগ নেতা।

ইউপি সদস্য চাঁন মিয়া জানান, 'আমার মৃত ছেলে আসাদুজ্জামানের নাম দিয়েছিলাম। এ নিয়ে কথা উঠায় ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি। তার নামে টাকা তুলবো না।' তবে তার আরেক ছেলে আসলাম ও ভাতিজা রাসেল মাহমুদকে অতিদরিদ্র দাবি করেন তিনি।

সরেজমিনে জানা যায়, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির ৩ নম্বর প্রকল্পে মাঠ পর্যায়ের কোনো কাজই হয়নি। যা হয়েছে সবই কাগজে-কলমে। শ্রমিকের তালিকা প্রস্তুতে যাচাই-বাছাই না করেই উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেছেন। মাঠপর্যায়ে অতিদরিদ্র কর্মসংস্থানের কাজ হচ্ছে কি-না, এর খোঁজ নিতে প্রকল্প এলাকায় পা পড়েনি ট্যাগ অফিসারের। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাও রাখেননি কোনো খোঁজ-খবর। কাগজে-কলমে কাজ দেখিয়ে শ্রমিকের ভুয়া টিপসই ও স্বাক্ষরে বেতন শিট প্রস্তুত রাখা হয়েছে উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে। সেখান থেকে অর্ডার পেলেই ব্যাংক থেকে ছাড়বে চেক। ব্যাংকের চেক স্ব স্ব শ্রমিকের হাতে দেয়ার নিয়ম থাকলেও সেখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। ইউপি চেয়ারম্যান সকল শ্রমিকের স্বাক্ষর নিয়ে ব্যাংক ম্যানেজারকে ম্যানেজ করে নিজেই টাকা তুলে আনেন।

সোনালী ব্যাংক মেলান্দহ ব্রাঞ্চের ম্যানেজারো মো. মামুনুর রশিদ বলেন, 'চেক এখনো ছাড়া হয়নি। যেসব শ্রমিকের নামে একাউন্ট রয়েছে, তাদের হাতেই চেক দেয়া হবে।'

ঘোষের পাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান অতিদরিদ্রের কর্মসংস্থান প্রকল্পের শ্রমিকের নামের তালিকা তৈরিতে অনিয়মের কথা স্বীকার করে মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেছেন, 'সবাইকে ম্যানেজ করেই চলতে হয়। সরকারিদল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম তালিকায় দিতে হয়েছে। আমারও দুটি নাম রয়েছে। আমার ছেলে ও ছেলের বউয়ের। নাম দুটো প্রত্যাহার করে নেব।'

মেলান্দহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামীম আল ইয়ামীন বলেছেন, 'উপজেলার ঘোষের পাড়া ইউনিয়নে অতিদরিদ্র কর্মসংস্থান প্রকল্পের শ্রমিকদের তালিকায় দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও স্বচ্ছল ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্তের প্রমাণ পাওয়া গেলে তালিকা থেকে সেই সব নাম বাদ দেয়া হবে। তারা কোনোভাবেই চেক পাবেন না। আর তালিকা প্রস্তুত ও দায়িত্বরতদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।'

(আরআর/এসপি/এপ্রিল ২৬, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test