E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কচুয়ায় টাকা না দিলে মিলছে না বয়স্ক-বিধবা ভাতার কার্ড!

২০২১ জুন ০১ ১৬:৩৩:৪৭
কচুয়ায় টাকা না দিলে মিলছে না বয়স্ক-বিধবা ভাতার কার্ড!

উজ্জ্বল হোসাইন, চাঁদপুর : কচুয়ায় টাকা না দিলে মিলছে না বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। অর্থের বিনিময়ে ভাতার কার্ড প্রদানের অভিযোগ খোদ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে।

সরেজমিনে গেলে কড়ইয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমি বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ভাতা পাই না। কড়ইয়া ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুন্নাহারের কাছে গেলে তিনি বলেন, ভাতা করে দেব, আগে ৩ হাজার টাকা এবং ভাতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো ৩ হাজার টাকা আমাকে দিতে হবে। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানাই। তারপর অনেক দিন ঘোরাঘুরি করেও কার্ড পাইনি।’ আনোয়ারা বেগমসহ শামসুন্নাহারের বিরুদ্ধে ওই ইউনিয়নবাসীর অভিযোগের যেন শেষ নেই। তাদের অভিযোগ শামসুন্নাহার বেগম বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, গর্ভবতী ভাতাসহ এমন কোনো ভাতা নেই যেখান থেকে তিনি কমিশন নেন না। উপকারভোগীরা কার্ড করার জন্যে কখনো ভাতার পুরো টাকা, কখনো অগ্রিম টাকা, কখনো বা ভাতার টাকার বড় একটি অংশ দিতে বাধ্য হন ওই নারী নেত্রীকে।

নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা বলেন, আমি গরিব মানুষ। ভাবলাম, কিছু টাকা দিয়েও যদি কার্ড পাই, অসুবিধা কী। আবেদনের দিন ৩ হাজার টাকা দিয়েছি। কিছুদিন পরে তিনি এসে বলেন, আপনার কার্ড তৈরি হয়ে গেছে, বাকি টাকা দেন, কার্ড পেয়ে যাবেন। আমি নারী নেত্রীকে বলেছি, ভাতার টাকা পেলেই পাঁচ হাজার টাকা দেব। তিনি নাছোড়বান্দা, টাকা না দিলে কার্ড দিবেন না। আর কী করা, বাকি ৩ হাজার টাকাও দিয়ে দেই। আবদনের ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও কার্ড কিংবা ভাতা পেলাম না। শুধু আমার কাছ থেকেই নয়, আরও কয়েকজনের কাছ থেকেও তিনি এভাবে ভাতার কার্ড করে দিবেন বলে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেন।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শামসুন্নাহার বেগম বলেন, ‘টাকা নেয়ার বিষয়টি সত্য নয়। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কোনো ভাতার কার্ড করার জন্যে কারো কাছে টাকা-পয়সা চাইনি।’

একই অভিযোগ পৌর এলাকার পপি রাণীর বিরুদ্ধে। তিনি কচুয়া পৌরসভার পলাশপুর গ্রামের বিধবা অঞ্জলী রাণী দাসকে বলেন, কার্ড করতে নাকি অনেক টাকা লাগে। উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তাকে নাকি ঘুষ দিতে হয়। উপজেলার কর্মকর্তাদের টাকা না দিলে কার্ড করা যায় না, এসব কথা বলে পপি রাণী সরকার অঞ্জলী রাণীর কাছ থেকে কার্ড করার আগে দুই হাজার টাকা নেন। আমি ঋণ করে তাকে টাকা দেই। এখন আবার বলছেন জনপ্রতি ২৫০০ টাকা করে দিলে ভাতার কার্ড হবে, না হয় নাম কেটে দেবে।

পপি রাণী সরকারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কর্ম কইরা দুইডা পয়সা রোজগার করলে কারও কোনো অসুবিধা আছে? আমি যে এ কাজে এতোদিন ঘুরছি আমার একটা খরচ আছে না? আমি তাদের ১ হাজার টাকা করে ফেরত দিয়ে দেব।’

পপি রাণীর মতো এরকম দালাল প্রত্যেক ইউনিয়নে এক বা একাধিক রয়েছে। উপজেলা সমাজসেবা অফিসে এদের নিত্য আসা-যাওয়া। পৌরসভার কুলসুম, ৩নং ইউনিয়নের লিপি, ৬নং ইউনিয়নের বেলায়েত, ১২নং ইউনিয়নের মারিয়াসহ অনেকেই বিগত ক’দিন রাত ১০টা পর্যন্ত সমাজসেবা অফিসে লেনদেনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সমাজসেবা অফিসার আক্তার হোসেন নিজে এবং কম্পিউটার অপারেটর এমদাদ হোসেন দালালদের নিয়ন্ত্রণ ও উৎকোচ গ্রহণ করেন।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ আসতে থাকলে সাংবাদিকরা সমাজসেবা অফিসে যান। সে সময় জেলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগগুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সামনে উপস্থাপন করেন সাংবাদিকরা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো পাওয়া সত্ত্বেও জেলা কর্মকর্তা ও উপজেলা কর্মকর্তার কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

অপর দিকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে গেলে উপজেলার বিতারা ইউনিয়নের বিতারা গ্রামের সরকার বাড়ির শরিফুল ইসলাম জানান, তার পিতা হাবিবুর রহমান ও জোহরা বেগমকে ভাতার কার্ড পাইয়ে দেয়ার নামে ৬ হাজার টাকা নেন একই এলাকার মিজান সরকার। এছাড়া সরকার বাড়ির আঃ হালিম সরকার, সিরাজুল ইসলাম সরকার, ডাঃ আলী আজগর সরকার, আঃ খালেক সরকার, আবুল হাসেম সরকার, সহিদ সরকার, তাজির সরকারের কাছ থেকে কার্ড পাইয়ে নেয়ার নাম করে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেন মিজান সরকার।

অপরদিকে করইশ গ্রামের মৃত নূরুল ইসলামে ছেলে সাগর হোসেনকে ভাতার কার্ড পাইয়ে দেয়ার নামে নগদ আড়াই হাজার টাকা হাতিয়ে নেন উপজেলা সমাজসেবা অফিসের অফিস সহকারী এমদাদ। এমনই অভিযোগ সাগরের কাছ থেকে পাওয়া।

উত্তর কচুয়া ইউনিয়নের নাহারা কড়ইয়া গ্রামের সরকার বাড়ির মনিন্দ্র চন্দ্র সরকার জানান, প্রায় বছর খানেক পূর্বে ভাতার কার্ডের চেষ্টা করি। অথচ আমার পরে একই বাড়ির প্রেম রাণী, পদ্ম রাণী, বল্লব ও তুলসী রাণী ভাতার কার্ড করে ভাতা পাচ্ছে।

উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়রদ্বয় বয়স্ক, বিধবা ও পঙ্গু ভাতার তালিকা করে উপজেলা সমাজসেবা অফিসে প্রদান করার কথা থাকলেও সমাজসেবা কর্মকর্তা তার স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা হতে প্রায় ২ শতাধিক সুবিধাভোগীর নাম তার নিজ আয়ত্তে রেখে এ ভাতার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র দপ্তর হতে যে সকল তালিকা অফিসে জমা দেয়া হয়েছে সেখান থেকেও অনেকের নাম বাদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আকতার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা কার্ডের জন্যে কোনো টাকা লাগে না। তবে কোনো কোনো ইউনিয়নে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ভাতার কার্ড প্রদানের নামে টাকা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ শুনেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে সদুত্তর না দিয়ে তিনি সুকৌশলে বিষয়গুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।

কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপায়ন দাস শুভ বলেন, ‘আমি অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো। সত্যতা পাওয়া গেলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।

(ইউ/এসপি/জুন ০১, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test