E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম

হস্তান্তরের দুই মাসেই ভেঙেছে দরজা-জানালা, উঠে যাচ্ছে পলেস্তারা

২০২১ জুলাই ১১ ১৪:৫২:১৩
হস্তান্তরের দুই মাসেই ভেঙেছে দরজা-জানালা, উঠে যাচ্ছে পলেস্তারা

আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হতদরিদ্রের স্বপ্নের উপহার আমতলীর আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। লেন্টিন ছাড়া ঘর নির্মাণে ধসে পড়ে আশঙ্কায় বসবাস বন্ধ করে দিয়েছেন হতদরিদ্ররা। হস্তান্তরের দুই মাসের মাথায় দরজা জানালা ভেঙ্গে যাচ্ছে। উঠে যাচ্ছে মেঝের পলেস্তারা। ফাটল ধরেছে মুল ভবনে। 

জানা গেছে, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রায়ণ প্রকল্পের অধীনে আমতলী উপজেলায় দুই ধাপে হতদরিদ্রদের ৪’শ ৫০ টি ঘর দেয়। ওই প্রকল্পে ঘর প্রতি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ভ্যাট ট্যাক্স বাদে এক লক্ষ ৭১ হাজার টাকা। প্রকল্পের পরিপত্রে উল্লেখ আছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এসিল্যান্ড, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যান মিলে হতদরিদ্রের ঘর বরাদ্দ তালিকা প্রস্তুত করবে। ওই তালিকা অনুসারে তারা ঘরের নির্মান কাজের তদারকি করবেন। কিন্তু আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান ঘরের তালিকা প্রস্তুত করতেই কমিটির অন্য সদস্যদের এড়িয়ে অনিয়মের আশ্রয় নেন। উপজেলা প্রকৌশলী ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে এড়িয়ে ঘরের নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় করেন তিনি। ঘরের ডিজাইন মোতাবেক ঘর নির্মাণ না করে নিজের ইচ্ছামত নির্মাণ কাজ করেন ইউএনও।

ডিজাইনে উল্লেখ আছে, ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ, ঘরের ভিতরের দুই কক্ষ ৯ ফুট ৩ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৯ ফুট ৮ ইঞ্চি প্রস্থ। রান্না ঘর, টয়লেটসহ ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি। ভীত মজবুত করতে ধরা হয়েছে মুল ভবনের চারিদিকে ৫৮ ফুট লেন্টিন। ডিজাইন মোতাবেক ঘর নির্মাণে ৬ হাজার ইট, ৫০ বস্তা সিমেন্ট, লোকাল বালু ২০০ ফুট এবং ভিটি বালু ৫০ ফুট প্রয়োজন। কিন্তু ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। মুল ঘরে লেন্টিন দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। এতে অল্প চাপেই ঘর ধসে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রাজমিস্ত্রি।

নিম্নমানের লোহার পাত দিয়ে দরজা ও জানালা নির্মাণ করা হয়েছে। ১০ ইঞ্চি ফাউন্ডেশন দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে প্রকার ভেদে ৫-৬ ইঞ্চি। এতে ঘর হস্তান্তরের দুই মাসের মাথায়ই ঘরের দরজা জানালা ভেঙ্গে পরেছে। প্রয়োজনীয় ইট, সিমেন্ট ও বালু না দেয়ায় ঘরের পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে। টয়লেটে প্লাষ্টিকের প্যান বসালেও রিং বসায়নি। ওই ঘরগুলোর টয়লেট এখন পরিবারের লোকজন মালামাল রাখার কাজে ব্যবহার করছেন। তদারকি এবং ক্রয় কমিটিকে ছাড়াই ইউএনও আসাদুজ্জামান তার আস্থাভাজন লোক সুজন মুসুল্লী ও হাবিব গাজীকে দিয়ে মালামাল ক্রয় করেছেন এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে ওই প্রকল্পের তালিকা তৈরিতে সুজন মুসুল্লী, হাবিব গাজী, আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নের কাওসার হাওলাদার, আনোয়ার মাষ্টার, মাহতাব প্যাদা, সবুজ খাঁন ও হলদিয়া ইউনিয়নে জুয়েল রাঢ়ী, জহিরুল ইসলাম ও খলিল মুন্সি ঘর প্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা আদায় করেছেন। ইউএনও’র চাহিদামত যারা টাকা দিয়েছেন তারাই পেয়েছেন ঘর নির্মাণের নিম্নমানের সামগ্রী। ঘরের তালিকা তৈরি এবং নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগে গত সোমবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামানকে ওএসডিসহ বিভাগীয় মামলা দেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

রোববার উপজেলার গুলিশাখালী, আঠারোগাছিয়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখাগেছে ঘর নির্মাণের অনিয়মের চিত্র। গুলিশাখালী ইউনিয়নের হরিদ্রাবাড়িয়া গ্রামের হামিদা বেগম পেয়েছেন আশ্রায়নের ঘর। ওই ঘর নির্মাণের পাঁচ দিনের মাথায় বারান্দার পিলার ভেঙ্গে পরেছে। খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক ইউএনও আসাদুজ্জামানের প্রতিনিধি সুজন মুসুল্লী পিলার নির্মাণ করে দেন। হামিদা বেগম বলেন, ঘরের কাম হরার পাঁচ দিনের মধ্যেই পিলার ভাইঙ্গা গ্যাছে। সিমেন্ট ও বালু কোম দেয়। মুই মাল কোম দেওয়ার কথা কইছিলাম রাজমিস্ত্রি মোতালেব মোরে গালি দেছে।

একই গ্রামের রোজিনা আক্তার বলেন, ঘরের কাম না হইর‌্যা হালাইয়্যা রাখছে। রুপা আক্তার বলেন, ঘরের বারান্দার পিলার এ্যাকছেন লড়ে। ঘরে কোন সিমেন্টের আড়া দেওয়া অয়নি। কাটা আড়া দিয়ে দেছে।

নাইয়্যাপাড়া গ্রামের বারেক মাদবর বলেন, মোরা কি কমু পঁচা ইট দিয়ে ঘর বানাইছে। সিমেন্ট ও বালু বেশী দেয় না। কইতে গেলেই মিস্তি মোতালেব কয় তোরা এইয়্যা পাও। তোগো সরহার খয়রাত দেছে। যে হরি হেইয়্যারই বেশী। তিনি আরো বলেন, এই ঘরে মোরা থাকতে পারমু? ডয় অয় কহোর যেন ভাইঙ্গা পড়ে।

নাইয়্যাপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, মোর ঘরে ৩০ বস্তা সিমেন্ট আর ৫ হাজার ২০০ ইট দিয়া ঘর তুলেছে। মিস্ত্রি মোতালেব সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমাকে যে ভাবে ইউএনও করতে বলছে আমি তেমন করেছি।

একই চিত্র আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের আনোয়ার হাওলাদারের ঘর নির্মাণে কাটা লেন্টিন দেয়া হয়েছে। লেন্টিন না দেয়ায় বারান্দার পিলার ঠকঠক করে নড়ছে। আনোয়ারের স্ত্রী শিরিনা বলেন, মোর স্বামীর কাছ থেকে চেয়ারম্যান ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ঘর দেছে।

তিনি আরো বলেন, ঘর নির্মাণে কাওসার হাওলাদার ৫ হাজার ৩০০ ইট এবং ৩০ বস্তা সিমেন্ট দিয়েছে। ওই ইট ও সিমেন্ট দিয়ে কাজ করছে।

এছাড়া হলদিয়া ইউনিয়নের হলদিয়া গ্রামে ঘর নির্মাণে রয়েছে ভিন্ন চিত্র। গত এপ্রিল মাসে চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম মৃধার আস্থাভাজন মোঃ জুয়েল রাঢ়ী ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন ঘর নির্মাণ কাজ চলমান অবস্থায় জুয়েল রাঢ়ী শ্রমিকদের খোরাকি বাবদ ৫-৭ হাজার টাকা নিয়েছেন। যারা টাকা দেয়নি তারা ৫ জন শ্রমিককে ঘর নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুই বেলা খাবার খাইয়েছেন। ওই ইউনিয়নের হলদিয়া গ্রামের ১০ টি ঘর গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে উপকারভোগীদের কাছে হস্তান্তর করেছেন ইউএনও আসাদুজ্জামান। কিন্তু ঘর হস্তান্তরের দুই মাসের মাথায় ঘরের দরজা ও জানালা ভেঙ্গে গেছে। মেঝের পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে। কোন ঘরেই লেন্টিন দেয়া হয়নি। লেন্টিন না দেয়ায় ঘর নড়বড়ে। প্রাণনাশের ভয়ে অধিকাংশ ঘরে উপকারভোগীরা বসবাস করছেন না। টয়লেটে প্লাস্টিকের প্যান বসানো হলেও রিং বসানো হয়নি। বসবাসরত পরিবারগুলো ওই টয়লেটে মালামাল বোঝাই করে রেখেছেন।

ওই গ্রামের রিপন খলিফার স্ত্রী তানিয়া বলেন, ঘরে ফাটল ধরেছে। টয়লেটে রিং বসায়নি। ফ্লোরে প্রয়োজনীয় বালু না দেয়ায় পলেস্তারা জুতার ঘষায় উঠে যাচ্ছে। ঘরে বসবাস করতে ভয় লাগে। একই গ্রামের চাঁন মিয়া বলেন, ঘরের মধ্যে পায়খানা বসাইলেও রিং বসায়নি।

কহিনুর বেগমের ঘরের দরজা ও জানালা ভাঙ্গা। ঘর ও বারান্দার ফ্লোরের (মেঝ) পলেস্তারা উঠে মাটি বের হয়ে গেছে। ভয়ে তিনি ঘরে বসবাস করছেন না। তারও ঘরের মধ্যে টয়লেট রিং বসানো হয়নি। কহিনুর বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোগো ঘর দিয়ে ভালোই হরছিল কিন্তু চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম মৃধার সহযোগী জুয়েল রাঢ়ী ঘরের খারাপ কাম হরছে। ঘরের দরজা ও জানালা ভাইঙ্গা গ্যাছে। টয়লেটের কাম হরে নাই। হারা ঘরের সিমেন্ট উইঠ্যা গ্যাছে। মুই ওই ঘরে থাহি না। মোর এ্যাকছেন ডর হবে।

তিনি আরো বলেন, হারা ঘরে কোনহানে সিমেন্ডের আড়া দেয়নি। একটু বাতাস আইলে ঘর এ্যাকছেন লোলে। তবে জুয়েল রাঢ়ী সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঠিকমত কাজ করেছি।

হলদিয়া বাজার সংলগ্ন প্রতিবন্ধী দুলাল শরীফের ঘরের দরজা জানালা ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গেছে। টয়লেট নির্মাণ করেনি। তিনি বলেন, ঘরের কাম হরার কালে জুয়েল রাঢ়ী টাহা নেছে। ১৫ দিন ৫ জন মানেরে খাওয়াইছি। জুয়েইল্লা কইছে না খাওয়াইলে ৭ আজার টাকা দেতে অইবে। মুই গরিব মানু টাহা পামু কই। পরে ৫ জন মানেরে খাওয়াইছি। হ্যারপর ঘরের ৫ হাজার ২’শ ইট মোর টাইন্ন্যা আনা লাগছে।

অপর দিকে ঘর নির্মাণের তিন মাসের মাথায় তালতলী উপজেলার অংকুজান পাড়া গ্রামের আবুল কালাম মালের ঘরে ১২ স্থানে ফাটল ধরেছে। ঘরের সামনের পিলার ভেঙ্গে গেছে। ঘর হেলে পরেছে। ঘরের মেঝের পলেস্তারা উঠে গেছে। আবুল কালাম মাল বলেন, ঘর নির্মাণের তিন মাসের মাথায় ঘরের সামনের পিলার ভেঙ্গে গেছে। ঘরে ১২ স্থানে ফাটল ধরেছে। ঘরে বসবাস করা বন্ধ করে দিয়েছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রাজমিস্ত্রি বলেন, ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী দেয়া হয়নি। লেন্টিন ছাড়াই ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এই ঘর বেশী দিন টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। তারা আরো বলেন, ঘর নির্মাণে এমন অনিয়মের কথা ইউএনওকে জানিয়েছি কিন্তু তিনি আমাদের ধকম দিয়ে বলেন, যেভাবে করতে বলছি সেই ভাবে কর। তোমাদের প্রয়োজন কি?

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ মফিজুল ইসলাম বলেন, ঘর নির্মাণের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। আমাকে ইউএনও হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। তিনি আরো বলেন, নির্মাণের শুরুতেই আমি ঘর নির্মাণে অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলাম কিন্তু এতে ইউএনও আমাকে লাঞ্চিত করেছেন।

উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হওয়া সত্বেও আমি এ বিষয়ে কিছুই জানিনা। সব করেছে ইউএনও ও তার লোকজন। আমাকে কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেছে আমি স্বাক্ষর দিয়েছি। তিনি আরো বলেন আমাকে ইউএনও এ কাজের জন্য একদিনও ডাকেননি।

ইউএনও মোঃ আসাদুজ্জামান তালিকা তৈরি ও ঘর নির্মাণে অনিয়মের কথা অস্বীকার করে বলেন, জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তালিকা অনুসারে যথা নিয়মে কাজ করা হয়েছে।

(এন/এসপি/জুলাই ১১, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test