E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৫ মাস সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরার অনুমতি বন্ধ

৫ হাজারের বেশি জেলে পরিবারের মানবেতর জীবন

২০২১ জুলাই ২৮ ১৮:৩৭:৪৭
৫ হাজারের বেশি জেলে পরিবারের মানবেতর জীবন

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : পাঁচ মাস ধরে সুন্দরবনে ঢোকার পাস (অনমুতি) বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের কাঁকড়ার উপর নির্ভরশীল পাঁচ হাজারের বেশি জেলে পরিবার। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তণ করা না হলে সুন্দরবনের উপকুল সংলগ্ন জেলেরা অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে না পেরে পেশা পরিবর্তণ করে অন্যত্র চলে যতে বাধ্য হবে।

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনবিভাগের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য পাঁচটি স্টেশন থেকে প্রতি বছর দু’ হাজার ৯০০ পাস(বিএলসি) বা অনুমতিপত্র ইস্যু করা হয়। প্রতিটি পাসে এক সপ্তাহের অনুমোদন দিয়ে ৩৫০ টাকা করে সরকারি ফাণ্ডে জমা দিতে হয়। এর মধ্যে কাঁকড়া ধরার জন্য প্রায় এক হাজার ৭০০ পাস দেওয়া হয়। কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হিসেবে প্রতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্র“য়ারি মাস পাস দেওয়া বন্ধ রাখায় ১০ মাসই কাঁকড়া ধরা যায়। একইভাবে জুন ও জুলাই মাস মাছের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় পাস বন্ধ রাখা হয়। বছরের বাকী ১০ মাস মাছ ধরার অনুমতি বা পাস দেওয়া হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে গত বছরের ২০ মে থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদ নদীতে কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখার জন্য খুলনা বিভাগীয় বনসংরক্ষক ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারি বণসংরক্ষককে চিঠি দেওয়া হয়। এ বছরেও পহেলা মার্চ থেকে আগষ্ট পর্যন্ত কোন পাস দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

সরেজমিনে বুধবার সকালে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের দাতিনাখালি গ্রামে গেলে শাহ আলম সানার ছেলে মাহাবুবর সানা(৫৮) বলেন, বাবার হাত ধরে বনে যাওয়া। মাছ ও কাঁকড়া ধরে এক সময় তাদের জীবন জীবিকা চলতো। চিন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানি শুরুর সাথে সাথে কাঁকড়ার দাম বেড়ে যায়। ফলে সুন্দরবন উপকুলীয় এলাকার বুড়িগোয়ালিনি, দাতিনাখালি, কলবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে কাঁকড়ার হ্যাচারি গড়ে ওঠে। এসব হ্যাচারিতে মূলত নরম কাঁকড়া শক্ত করা হয়। সুন্দরবনের কাঁকড়ার কদর বাড়ায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের নদ- নদীতে কাঁকড়া ধরে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাচ্ছিলেন। মার্চ মাস থেকে বনবিভাগ গত পহেলা মার্চ থেকে পাস দেওয়া বন্ধ রাখায় তারা পড়েছেন বিপাকে। পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের। তবে পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে চুরি করে কাঁকড়া ধরতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান মাহাবুবর সানা।

একই গ্রামের উজির গাজীর ছেলে বারেক গাজী (৫৫)। পাঁচ সদস্যের সংসার। ৪০ বছর আগে বাবার হাত ধরে বনে কাঁকড়া দলতে যাওয়া। বাবা মারা যাওয়ার পর একাই বনে যাচ্ছেন ২২ বছর। মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে বনে যান তারা। বন থেকে ফিরে কাঁকড়া বিক্রি করে মহাজনের টাকা শোধ করেন। গত পাঁচ মাস অনুমতি না থাকায় সংসার চালাতে পারছেন না। মহাজনরাও কোন টাকা দিচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ পেশা ছেড়ে শহরে রিক্সা চালাতে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না।

বুড়িগোয়ালিনি গ্রামের মৃত কেনা ঢালীর ছেলে সামছুর ঢালী (৫০)। ৩০ বছর ধরে সুন্দরবনের নদীতে কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। পাঁচ মাস কাঁকড়া ধরার পাস বন্ধ থাকায় সংসারের চাকা ঘুরছে না। সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিস্তির টাকা নিতে এসে আদায়কারিদের গালিগালাজ না শুনতে পালিয়ে থাকতে হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে সংসার ফেলে পালানো ছাড়া উপায় থাকবে না।

মাহাবুবর রহমান, সামছুর ঢালী ও বারেক গাজীর মত বুড়িগোয়ালিনির আবু হাসান, গাবুরার চাঁদনীমুখার মহববত আলী, মুন্সিগঞ্জের তাপস মহালদার, হরিনগরের শহীন রায়, কৈখালির সাহেব আলীসহ কয়েকজন জানান, পাঁচ মাস কাঁকড়া ধরার পাস বন্ধ থাকায় সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়লে টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না তারা। তবে বর্তমানে সুন্দরবনে ডাকাতদলের উৎপাত না থাকার জন্য তিনি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।

কলবাড়ি বাজারের আড়ৎদার দাতিনাখালি গ্রামের মনিরুল তরফদার জানান, নয় বছর ধরে কাঁকড়ার ব্যবসা করে আসছেন। কাঁকড়া কোন- বেচা করে যে আয় হতো তাতে ছয় সদেস্যর সংসার ভালই চলতো। জেলেরা কয়েক মাস ধরে কাঁকড়া ধরতে না পারায় তার ব্যবসা ও লাঠে উঠেছে। সংসার চলা তো দূরের কথা। থ্যালাসামিয়ায় আক্রান্ত সাত বছরের একমাত্র মেয়েকে তিন মাস পরপর রক্ত দিতে হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাকে রক্ত দিলেও এখনো পর্যন্ত পরবর্তী রক্ত দিতে পারেন নি। টাকার অভাবে রক্ত যোগাড় করতে না পেরে মেয়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। একই অবস্থা এলাকার শতাধিক আড়ৎদার ও দু’ শতাধিক ছোট বড় খামারি মালিকের।

বুড়িগোয়ালিনির তরুন হ্যাচারি মালিক কামাল হোসেন জানান, চার বছর ধরে হ্যাচারিতে কাঁকড়া চাষ করছেন। কাঁকড়া আহরণ ও বিপনন ব্যবস্থার সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে দু’ লক্ষাধিক মানুষের ভাগ্য জড়িত। পাঁচ মাস কাঁকড়ার পাস বন্ধ থাকায় তার হ্যাচারিতে পাঁচজন কর্মচারির কাজ নেই। একই অবস্থা অন্য হ্যাচারিগুলোতে। তিনি বলেন, তিন মাস পর পর কাঁকড়া মারা যায়। আবার নতুন কাঁকড়ার জন্ম হয়।তাছাড়া কাঁকড়া ধরলে পরিবেশ ও নদীর কোন ক্ষতি হয় না। তাই ঠুনকো অজুহাতে কাঁকড়া ধরার পাস বন্ধ করার বিষয়ঢটি সরকারের বিবেচনা করা উচিত।

বুড়িগোয়ানিতে “এ্যাকোয়া ম্যাক্স সী ফুড” কাঁকড়ার প্রসেসিং স্টোরের স্বাধিকারী কালিগঞ্জ উপজেলার কাশীবাটি গ্রামের প্রয়াত বিএনপি নেতা ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসের ছেলে শাহীদুল ইসলাম জুয়েল বলেন, সাড়ে পাঁচ বছর আগে চার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে স্ত্রী ভিয়েতনামের নাগরিক আইভি মালালাকে সঙ্গে নিয়ে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু করেন তারা। শুরুতেই সাতক্ষীরায় প্রথম সফট্ ক্রাব বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান সহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে প্রক্রিয়াজাত করে পাঠাতেন। ব্যবসা চলছিলও ভালো। করোনাকালিন সময়ে কিছু সসমস্যা হলেও প্রচুর অর্ডার পেয়েছেন। কিন্তু বনে কাঁকড়ার পাস না দেওয়ায় তার প্রতিষ্ঠানটি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তিনি অবিলম্বে কাঁকড়ার পাস খুলে দেওয়ার দাবি জানান।

এ ব্যাপারে বুধবার বিকেলে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারি বণসংরক্ষক (এসিএফ) এমএ হাসানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।

তবে বুড়িগোয়ালিনি স্টেশনের সহকারী বন কর্মকর্তা এস এম সুলতান আহমেদ বলেন, গত বছর মন্ত্রী পরিষদ থেকে চিঠি দিয়ে সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়াসহ সকল ধরনের পাশ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা পাস বন্ধ রেখেছেন। পাস বন্ধ থাকার কারণে প্রতি জেলেকে মাথা পিছু ৪০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মহোদয়কে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হবে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির সাংবাদিকদের বলেন, কাঁকড়া ধরার পাস এর বিষয়টি তার জানা নেই। বন বিভাগের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(আরকে/এসপি/জুলাই ২৮, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test