E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দেড় কেজি সোনা আত্মসাতের দায়ে সাতক্ষীরার সাবেক পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন চাকুরিচ্যুত

২০২২ মে ২১ ১৪:৪৭:৫৬
দেড় কেজি সোনা আত্মসাতের দায়ে সাতক্ষীরার সাবেক পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন চাকুরিচ্যুত

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : এক সময়কার সাতক্ষীরার দাপুটে পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন ১২০ ভরি সোনার বার আত্মসাতের দায়ে চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গত ১৮ মে এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। চানুরিচ্যুত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলতাফ হোসেন সিলেচ রিজিওনাল ট্যুরিষ্ট পুলিশের পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাকুরিচ্যুত হওয়ার পর আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে  বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর কাহিনী।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করে আলতাফ হোসেন। ।

সাতক্ষীরার একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে শহরের কেষ্ট ময়রার ব্রীজের পাশে অদ্রি জুয়েলার্সের তালা ভেঙে ভিতর দিয়ে আধুনিক জুয়েলার্সে ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটে। পরদিন পুলিশ গোপী দে, বকচরার নবাব আলী ও ১৭ জানুয়ারি বাকালের মুকুল চোরকে আটক করে। ওই বছরের পহেলা ফেব্র“য়ারি গোপী ও নবাব আলীর জামিন শুনানীকালে টেচার মুকুল আদালতের অনুমতি নিয়ে জানায় যে, তাকে ধরার পর হাটের মোড়ের বলাকা অয়েল মিলের পাশ থেকে ৩১৫ ভরি সোনার গহনা, দু’ লাখ ১২ হাজার টাকাসহ একটি টোপলা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আসাদের(গাল কাটা) হাতে তুলে দেয় সে।

এমনকি কাঠগড়ায় উপস্থিত আসাদকে সে দেখিয়ে দেয়। যদিও মুকুলের বক্তব্য আদালতে নথিভুক্ত হয়নি। বাধ্য হয়ে মামলার বাদি সুভাষ রায় তদন্তকারি কর্মকর্তা পরিবর্তনের জন্য ডিআইজি ও সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেন। বেগতি বুঝে ৬ ফেব্র“য়ারি উপপরিদর্শক আসাদুজ্জামান জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুকুলকে পাঁচ দিনের রিমাণ্ড আবেদন করেন। মঞ্জুর হওয়া তিন দিনের রিমাণ্ এর দ্বিতীয় দিনেই মুকুলকে আদালতে হাজির করিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে সক্ষম হন আসাদুজ্জামান। তবে সে থানা লকআপে থাকাকালিন সুলতানপুরের ছাত্রলীগ নেতা ইমন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত রনিকে মাথা নীচের দিকে ঝুলিয়ে উপপরিদর্শক আসাদের নির্যাতনের একপর্যায়ে পায়ের বুড়ো আঙুলেন নখ তুলে নেওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেয়।

জামিনে মুক্তি পাওয়ার কয়েক দিন পর মুকুলকে স্থ্নাীয় কয়েকজন ধরে বাকালের একটি ক্লাবে ধরে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পরদিন ভোরে বাইপাস সড়কের মাসের সেট এলাকায় গলায় তার পেচানো অবস্থায় লাশ পাওয়া যায়। আধুৃনিক জুয়েলার্সে চুরির ঘটনায় প্রমান লোপাট করতে মুকুলকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারের পরবির্তে গলায় তার পেচিয়ে হত্যা করেছে বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন মুকুলের মা। আধুনিক জুয়েলার্সের চুরি যাওয়া সোনার গহনা ও টাকা পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন ও উপরিদর্শক আসাদ ভাগ করে নেয় বলে প্রচার ছিল। ওই বছরের ১৯ মার্চ মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে দুইজন সোনার কারিগর সাতক্ষীরার খান মার্কেট এলাকার এক জুয়েলারী ব্যবসায়ির অর্ডার অনুযায়ি ২০০ ভরি সোনা নিয়ে পরিবহনে আাসার সময় শহরের পলিটেকনিক মোড়ে তাদেরকে নামিয়ে নেন তৎকালিন গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক আবুল কাশেম, উপপরিদর্শক বোরহানউদ্দিন ও উপপরিদর্শক নাসিরউদ্দিন। পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তারা ওই সোনা ছিনতাই করেন বলে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এসে অভিযোগ করা হয়। ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেও বিশেষ কারণে তৎকালিন পুলিশ সুপার কোন ব্যবস্থা নেননি।

সূত্রটি আরো জানায়, ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর খুলনার সোনাডাঙা থেকে বিপ্লব চ্যাটার্জী নামের এক চোরাচালানি ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে তিন কেজি সোনা নিয়ে সাতক্ষীরায় আসছিলেন। গোপন খবরের ভিত্তিতে পাটকেলঘাটার বাসিন্দা ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার সহকারি উপপরিদর্শক আব্দুর রউফ পল্টু ও সিপাহী মারুফ তাকে পথিমধ্যে আটক করে সেনেগাতি বাজারে নিয়ে যায়। ওই সোনা ছিনতাই করে নেওয়ার চেষ্টাকালে বিপ্লবের চিৎকারে জনতা ওই দু’ পুলিশ সদস্য ও বিপ্লব চ্যাটার্জীকে পাটকেলঘাটা থানায় সোপর্দ করে। বিষয়টি থানা ভরাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিবুল ইসলাম পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেনকে অবহিত করেন। সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার ওই সোনা থানা থেকে নিজের জিম্মায় নিয়ে ওই দু’ পুলিশ সদস্যকে ছেড়ে দিয়ে বিপ্লব চ্যাটার্জীকে ২১১ পিস ইয়াবাসহ মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিয়ে পরদিনর বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে খবর ছাপা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার সোনা আত্মসাতের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছুই জানাননি। পরবর্তীতে এ ঘটনার তদন্তে তিন কেজির পরিবর্তে ১২০ ভরি সোনা আত্মসাতের অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।

এদিকে আলতাফ হোসেনের সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বপালনকালে ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে শহরতলীর কুকরালির হোমিও চিকিৎসক ডাঃ মোখলেছুর রহমানকে লাবনী সিনেমা হলের সামনে ফটোস্টাট করার সময় সদর থানার উপপরিদর্শক হিমেল ধরে নিয়ে যায়। সদর থানা লকআপে তিন দিন দেখা কর ও খাবার দেওয়ার পর জনিকে আর ফিরে পাননি তার বাবা আব্দুর রাশেদ ও স্ত্রী জেসমিন নাহার রেশমা। তিনদিন থানা লকআপে থাকার সময় মোখলেছুর আল্লার দলের খুলনা বিভাগীয় প্রধান উল্লেখ করে তাকে ক্রমফায়ারের ভয় দেখিয়ে এক কোটি টাকা চান ওসি এমদাদ হোসেন। এ ঘটনায় বারবার চেষ্টা করেও পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি তার পরিবারের সদস্যরা। ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর থানায় জিডি নেননি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি স্বামীকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রেশমা। ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে ২৮৩৩/১৭ নং রিট পিটিশন দাখিল করেন রেশমা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মহাপুলিশ পরিদর্শক, উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (খুলনা), সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপপরিদর্শক হিমেল ও সাতক্ষীরা কারাগারের জেলরকে বিবাদী করা হয়। রিট দায়েরের পর গত ৬ মার্চ শুনানী শেষে আদালত রুল জারির পাশাপাশি নিখোঁজের বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যা চেয়ে ১৯ মার্চ দিন ধার্য করেন। ১৯ মার্চ রোববার আদালতে উপস্থাপন করা পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিখোঁজ মোখলেছুর রহমান নিষিদ্ধ সংগঠন ‘আল্লাহর দল’ এর সঙ্গে যুক্ত এবং তাকে গ্রেফতার করা হয় নাই। পরবর্তীতে হাইকোর্টে ডাঃ মোখলেছুর রহমান থানা লক আপ থেকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জুডিশিয়াল তদন্তের নির্দেশ দেন। সাতক্ষীরার তৎকালিন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ ২০১৭ সালের ৪৩ জুলাই হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাকে থানা লক আপ থেকে ডাঃ মোখলেছুরকে নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ হোেিসন ও উপপরিদর্শক হিমেলের সম্পৃক্ততরা আছে বলে উল্লেখ করেন।

একই প্রতিবেদনে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইল কল লিষ্ট যাঁচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করেও তাকে দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। এ প্রতিবেদন সাতক্ষীরার ইতিহাসে একটি মাইল ফলক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদিও এ প্রতিবেদন দেওয়ার কারণে ওই বিচারকের জামায়াত শিবিরের সংশ্লিষতা আছে বলে আলতাফ হোসেন ব্যাখা দিয়ে তাকে শাস্তিমূলক বদলী করান। বর্তমানে ওই বিচারক সিরাজগঞ্জে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে আলতাফ হোসেন প্রবাব খাটিয়ে নিজে সেযাত্রায় রক্ষা পেলেও ওসি এমদাদ হোসেন শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও এসআই হিমেলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও ডাঃ মোখলেছুর রহমানের বাবা আব্দুর রাশেদ বাদি হয়ে আদালতে মামলা করেছেন। বিভাগীয় মামলার পর এমদাদ শেখ ও ফিরোজ হোসেন মোল্লাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এমদাদ শেষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যান। বর্তমানে তিনি বান্দরবনে গোয়েন্দা পুলিশের ওসি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

এদিকে আলতাফ হোসেন পুলিশ সুপার থাকাকালে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ রাতে বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য তালার মাগুরাঘোনার বিদ্যুৎ বাছাড়, বাউখোলার আবু তালহা ও সুজনশাহ গ্রামের গোপাল দাসের কিশোর ছেলে সুমনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পরদিন মহান্দি ঋষিপাড়ার আমাবাগানে বিদ্যুৎ বাছাড় ও আবু তালহার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এর ২১ দিন পর গোয়ানডাঙা ও ইসলামকাটির মধ্যবর্তী একটি কালভার্টের পাশ থেকে একটি পিস্তলসহ গোপাল দাসের ছেলেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

বিদ্যুৎ বাছাড়ের মা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, পূর্বের অপমানের বদলা নিতে একজন সাংসদ পুলিশ সুপার আলতাফকে দিয়ে তার ছেলে বিদ্যুৎ বাছাড়কে ক্রসফায়ারে দিয়েছে। ওই ভচরের ১০ এপ্রিল যুবলীগ নেতা শহরতলীর কুচপুকুরের রাসেল কবীর শহরের রাজারবাগানের ভাড়া বাসার সামনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির গুলিতে নিহত হন। এ ছাড়াও ওই বছরের আগষ্ট মাসে আশাশুনির আনুলিয়া ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী ইউনুস আলী যশোরের সাগরদাড়িতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আটকের পর পর্যাপ্ত টাকা না পেয়ে তৎকালিন পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন ওই চারটি ক্রসফায়ারের নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ ছিল।

(আরকে/এসপি/মে ২১, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test