E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্যামনগরে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের জমি জবরদখলের চেষ্টা

বাধা দেওয়ায় তিন নারীসহ চারনজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম, ঘরবাড়ি ভাঙচুর লুটপাট

২০২২ আগস্ট ১৯ ১৮:৩২:০১
বাধা দেওয়ায় তিন নারীসহ চারনজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম, ঘরবাড়ি ভাঙচুর লুটপাট

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : জমি জবরদখলে বাধা দেওয়ায় আদিবাসি মুণ্ডা সম্প্রদায়ের তিন নারীসহ চারজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ সময় ভাঙচুর করা হয়েছে মুণ্ডাদের দুটি বসত বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট অন্তাখালি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।


আহতরা হলেন, শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট অন্তাখালি পশ্চিমপাড়ার সনাতন মুণ্ডার স্ত্রী রিনা মুণ্ডা(৩৫), একই পরিবারের লক্ষীন্দ্র মুণ্ডার স্ত্রী সুলতা মুণ্ডা(৪০), ফণীন্দ্র মুণ্ডার স্ত্রী বিলাশী মুণ্ডা (৩৬) ও মুল্লুক চদি মুণ্ডার ছেলে নরেন্দ্রনাথ মুণ্ডা(৭০)।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন বিলাশী মুণ্ডা জানান, তার স্বামী ও শরীকদের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সাড়ে ২৭ বিঘা জমির একাংশে শুক্রবার সকালে তিনিসহ রিনা মুণ্ডা, সুলতা মুণ্ডা ও কাকা শ্বশুর নরেন্দ্র মুণ্ডা কাজ করছিলেন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলার শ্রীফলকাটি গ্রামের গফুর সরদারের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ও এবাদুল ইসলামের নেতৃত্বে বংশীপুর গ্রামের মুনসুর গাজীর ছেলে ফিরোজ , সুজন, ছিদ্দিকের চেলে রইবুল, শ্রীফলকাটি গ্রামের ফারেজ মহাজনের ছেলে মকিমসহ শ্রীফলকাটি, বংশীফুর ও ঈশ্বরীপুর গ্রামের দুই শতাধিক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হাতে দা, বল্লভ, লাঠি, লোহার রড, বেলচা, কুড়াল ও একটি বড় পাওয়ার টিলার নিয়ে তাদের জমিতে ঢুকে পড়ে। এ সময় ওই সন্ত্রাসীরা তাদের এক বিঘা জমিতে লাগানো ধানের পাতা পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করে নষ্ট করার একপর্যায়ে বাধা দিলে তাদের চারজনকে বিলের মধ্যে কাদার মধ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়। তাদেরকে রক্ষায় এগিয়ে এলে নিরাপদ মুণ্ডা, প্রদাস মুণ্ডা, মণীষা মুণ্ডা ও নমিতা মুণ্ডা লাঞ্ছিত হন।

প্রত্যক্ষদর্শী নিরাপদ মুণ্ডা ও নমিতা মুণ্ডা জানান, হামলাকারিরা ফণীন্দ্র মুণ্ডা ও সনাতন মুণ্ডার এসবেস্টারের চাল ভাঙচুর করে। লুটপাট করা হয় ঘরের জিনিসপত্র। মারপিট ও ভাঙচুরের ছবি তুলতে গেলে রিানা মুণ্ডার হাতে দা দিয়ে কোপ মেরে জখম করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় তার মোবাইল ফোনটি। এ সময় বিলাশী মুণ্ডার কান থেকে সোনার দুল কেড়ে নিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দুই ঘন্টা ধরে তাল্ডব চালায় হামলাকারিরা। প্রথমে থানায় উপপরিদর্শক তরিকুলের কাছে ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে মোবাইল ফোনে জানিয়েও কোন লাভ না হওয়ায় ৯৯৯ এ ফোন করলে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে উপপরিদর্শক রিপন হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ এসে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে।

ফণীন্দ্র মুণ্ডা জানান, তার ঠাকুর দাদা মুল্লুক চাদ এর ধুমঘাট মৌজার ৯,১০,১৩ ও১৪ দাগে ৯ একর ১৭ শতক বাদা বা বন কাটা সম্পত্তি রয়েছে। সাবেক ও এসএ খতিয়ানে ওই জমি মুল্লুক চাদ এর নামে রেকর্ড হয়। মুল্লুক চাদ এর কাছ থেকে শ্রীফলকাটি গ্রামের আব্দুল গফুর সরদার ১৯৫০ সালে দুই একর ৬৬ শতক বা ৫ বিঘা জমি পাট্টা দলিল মূলে কিনেছেন দাবি করে আসছে গফুর সরদারের দুই ছেলে রাশেদুল সরদার ও এবাদুল সরদার। ২০১৭ সালে রাশেদুল ও এবাদুল জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে তাদেরকে কোন প্রকার নোটিশ না দিয়েই আদালত থেকে এক তরফা ডিক্রী করে নেয়। বিষয়টি তারা জানতে পেরে ওই বছরেই তার কাকা নরেন্দ্র মুণ্ডা বাদি হয়ে ডিক্রি রদের মামলা করেন সাতক্ষীরা জজ আদালতে। বিবাদী রাশেদুল ও এবাদুল দীর্ঘদিন মামলায় হাজির না হলেও গত ২৫ জুলাই রায় এর দিনে হাজির হয়ে জবাব দেওয়ার জন্য সময় চায়। আদালত আগামি ২৯ আগষ্ট বিবাদীদের জবাব দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।

ফণীন্দ্র মুণ্ডা আরো জানান, তাদের মোট জমি চারটি দাগে হলেও রাশেদুল ও এবাদুল ১৪ দাগে ৫ বিঘা জমি বর্তমান জরিপে রেকর্ড করিয়ে মামলা চলাকালিন সময়ে জবরদখলের চেষ্টা করে আসছিল। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে ও থানায় শালিসী বৈঠক হয়েছে কয়েকবার। গত ৩ জুলাই শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক তরিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে শালিসি বৈঠকে ওই জমিতে রাশেদুল ও এবাদুলকে যেতে মানা করা হয়। এরপরও তারা ওই জমি জবরদখলের চেষ্টা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে তাদরেকে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সকালে রাশেদুল ও এবাদুলের নেতৃত্বে দুই শতাধিক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী তাদের জমি জবরদখলের চেষ্টা চালায়।

শ্রীফলকাটি গ্রামের এবাদুল ইসলাম জানান, দলিলদূলে ৫ বিঘা জমি তাদের দখলে ছিল দীর্ঘদিন। কয়েক বছর আগে মুণ্ডারা ওই জমি দখলে নিলে শুক্রবার তারা জমি চাষ করে দখলে নিয়েছেন। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে হাতহাতি হয়েছে।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডাঃ মোঃ শিরুজ্জামান জানান. মুণ্ডা সম্প্রদায়ের চারজনকে শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ভর্তি করা হয়। তাদের শরীরে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত ও ধারালো দা দিয়ে কোপানোর চিহ্ন রয়েছে।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. অসীম কুমার মণ্ডল জানান, ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ি মুণ্ডাদের জমি হস্তান্তর নিষিদ্ধ। তবে জেলা কালেক্টর বা জেলা প্রশাসক ওই জমি হস্তান্তরের অনুমতি দিলেই তা হস্তান্তর সম্ভব হবে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এলাকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাসহ বিভিন্ন প্রভাবশালীরা মুণ্ডাদের পদবী পরিবর্তন করে তাদের জমি কিনে নিচ্ছেন। ক্ষেত্র বিশেস জেলা প্রশাসকের অনুমতিপত্র জালিয়াতিও করা হয়েছে। ফলে মুণ্ডা সম্প্রদায় এখন অস্তিত্ব সংকটে।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। তবে শুক্রবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত মুণ্ডাদের পক্ষে থানায় কোন লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। লিখিত অভিযোগ পেলে মামলা নিয়ে হামলাকারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(আরকে/এসপি/আগস্ট ১৯, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test