E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফতেপুর ও চাকদাহে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

১১ বছরেও বিচার পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা

২০২৩ মার্চ ৩১ ১৭:৩৮:৪৮
১১ বছরেও বিচার পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের ফতেপুর  মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মঞ্চস্ত হুজুরে কেবালা নাটকে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকার মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ ও পহেলা এপ্রিল যথাক্রমে ফতেপুর ও চাকদাহ গ্রামে ১২টি হিন্দু বাড়িসহ ১৫টি বাড়ি, দুটি স্কুল, সংস্কৃতিক পরিষদে ভাঙচুর, লুটপাঠ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার দীর্ঘ ১১ বছর কেটে গেলেও বিচার পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। এ ছাড়া সরকারি সাহায্য স্বল্পতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। 

সরেজমিনে বৃহষ্পতিবার কালিগঞ্জের ফতেপুর ও চাকদাহ গ্রামে গেলে দেখা গেছে, ২০১২ সালের ৩০ মার্চ সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ফতেপুর সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার করা হয়েছে। এরপরও ক্ষতির চিহ্ন মোছেনি একেবারে। সংস্কার করা হয়েছে ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ ও আব্দুল হাকিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষিকা মিতা রানী বালা, লক্ষীপদ মণ্ডল, শাহীনুর রহমান ও আব্দুল হাকিমের বাড়ি সংস্কার করা হয়েছে। চাকদাহের শ্যামপদ সরদারের বাড়ি ভালভাবে সংস্কার করা হয়েছে গত বছর। কৃষ্ণপদ সরদার, পরেশ সরদার, কল্যাণী সরদারের তিন ছেলেসহ সাতটি ক্ষগ্রিস্ত পরিবারের ঘরবাড়ি আংশিক সংস্কার করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে কল্যাণী সরদার পাগল হয়ে গেছে। সকল সময় ভুল বকছেন। শোকে মারা গেছেন সুধীর সরদার। কৃষ্ণপদ সরদার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দেগঙ্গা থানার চ্যাংদানা গ্রামে চলে গেছেন।

ফতেপুর গ্রামের লক্ষীপদ মণ্ডলের স্ত্রী অরুনা মণ্ডল বলেন, “২০১২ সালের ২৭ মার্চ ফতেপুর হাইস্কুলে কি হয়েছিল আমি জানি না। অথচ ৩১ মার্চ দুইবার লুটপাট শেষে তার ঘরবাড়ি, ধানের গোলা ও বিচালী গাদায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ শোক সইতে না পেরে তার স্বামী গত বছর মারা গেছেন। তিনি নিজেও দুশ্চিন্তা করতে করতে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঘরবাড়ি লুটপাট ও জ্বালিয়ে না দিয়ে বলে দিলেই হতো এলাকা ছেড়ে চলে যেতাম। ১১ বছর কেন,এর বিচার কোন দিনও পাব না।”

মিতা রানী বালার শ্বাশুড়ি ঘটনার পর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ২০২১ সালে মারা গেছেন।

ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রেজোয়ান হারুন বলেন, “আমি, সহকারি শিক্ষিকা মিতা রানী বালা ও ৮ম শ্রেণীর ছাত্র সাঈদুর রহমান এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জেল খেটে জামিনে মুক্তি পাই। দীর্ঘদিন হয়রানির পর কেস থেকে মুক্তি পাই। যারা দুটি স্কুল ও মিতা রানী বালাসহ কয়েকজনের বাড়ি ভাঙচুর করে অদ্যাবধি তাদের কোন শাস্তি হয়নি।”

১০ম শ্রেণীর ছাত্র সালাহ রিয়াদ বলেন,“ প্রধানশিক্ষক, সহকারি শিক্ষককে কারাবরণ করতে হয়। জেলে যান তাদেরই বড় ভাই সাঈদুর রহমান। হাইস্কুল ও প্রাইমারি স্কুল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মিথ্যা গুজব রটনাকারিদের শাস্তি চাই।”

বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হক বলেন,“স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে হুজুরে কেবালা নাটক মঞ্চস্ত করাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়। ৩১ মার্চ স্কুল, মিতা রানী, লক্ষীপদ, শাহীনুর ও হাকিমের বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পহেলা এপ্রিল চাকদহের আটটি বাড়ি পোড়ানো হয়। দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নুর ইসলামসহ ছয় জন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী নিম্ন আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এটা আমাকে হতাশ করেছে।”

বিশিষ্ঠ সমাজসেবক সমীর মণ্ডল বলেন,“মহানবীকে কোন কটুক্তি করা হয়নি। দৃষ্টিপাত পত্রিকার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা হয়েছে।” শঙ্কর সরদার বলেন,“আসামীরা বাদির সঙ্গে সখ্যতা রেখে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলাকার হিন্দুরা ভীতসন্ত্রস্ত।”

চাকদাহ গ্রামের সুজিত সরদার বলেন, “আমাদের বাড়িসহ ৮টি বাড়ি লুটপাট করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিএনপি -জামায়ত ক্ষমতায় এলে কি করে বাস করিস দেখে নেবো বলে আসামীরা হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে ঘরবাড়ি প্লাস্টার করিনি, লাগানো হয়নি ভাল দরজা। ১০/১১ বছরেও বিচার পায়নি। আমরা এখানে কিভাবে থাকবো। একইভাবে নমিতা সরদার বলেন,“ পোড়া ঘরবাড়ি নিয়ে কোনভাবে বাস করছি। সরকারিভাবে যে ৬৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল তাতে কি পুড়ে যাওয়া সংসারের জিনিসপত্র কেনা যায়?”

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাড. আব্দুল লতিফ বলেন,“ ১২ সালের ২৭ মার্চ কালিগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে গুজবের ঘটনায় ফতেপুর ও চাকদাহে সৃষ্ট সহিংসতায় পাঁচটি মামলা হয়। ৭৯/১২ মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। বাকী চারটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চেষ্টা চলছে।” তবে চারটি মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ মঞ্চস্ত ‘হুজুরে কেবালা’ নাটকে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে এমন একটি মিথ্যা খবর ২৯ মার্চ দৃষ্টিপাত পত্রিকায় ছাপা হয়। এরই জের ধরে ৩০ মার্চ দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপি সদস্য জাফর সাঁফুই এর মামলায় ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজোয়ান হারুন,সহকারি শিক্ষিকা মিতা রানী বালা ও ৮ম শ্রেণীর ছাত্র সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

৩১ মার্চ সকালে কৃষ্ণনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ও তৎকালিন কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান আনছারউদ্দিন ও চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালিন সুপার আব্দুল কাদের হেলালী ও জাপা নেতা জুলফিকার সাঁফুই এর নেতৃত্বে চারটি মিছিল ফতেপুর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহীনুর মীর, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য আব্দুল হাকিম, শিক্ষিকা মিতা রানী বালা ও লক্ষীপদ মণ্ডলের বাড়িসহ কয়েকজনের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ ভাঙচুর ও লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

ফতেপুরের সহিংসতার জের ধরে ২০১২ সালের পহেলা এপ্রিল চাকদহ গ্রামের কাপালিপাড়ায় নমিতা সরদারসহ আটটি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করে তাদের সর্বস্ব প্রেট্রোল ঢেলে আগুণ ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিচালী গাদার পিছনে আত্মগোপন করা চাকদাহ গ্রামের এক হিন্দু গৃহবধুকে ধর্ষণ করা হয়।

সহিংসতার ঘটনায় ৫ এপ্রিল দায়েরকৃত চারটি মামলায় ৯৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা দু’ হাজার ২০০ লোককে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হককে বাগেরহাটে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করা হয়।

২০১২ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ এপ্রিল তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নির্দেশে দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয়। ১২ এপ্রিল অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার দৃষ্টিপাত পত্রিকার সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে গাজীপুর সদরের একটি ব্যাচেলার ছাত্রবাস থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৫ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভৎর্সনা করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ১২ জুন অতিরিক্ত যুগ্ম সচীব একেএম জহরুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজে তদন্ত করেন।

দুটি স্কুল, সাংস্কৃতিক পরিষদ, মিতা রানী বালা, লক্ষীপদ মণ্ডলসহ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান বাদি হয়ে থানায়(জিআর-৮৪/১২ নং) মামলা করেন। তথ্য গোপন করে মালাটির কার্যক্রম হাইকোর্টে নিয়ে বিচার কাজ বিলম্ব করা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই উপপরিদর্শক নকীব অয়জুল হক রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ১২০(ক) ধারায় আদালতে দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা, তৎকালিন বার্তা সম্পাদক ডিএম কামরুল ইসলাম, আবু তালেব মোল্লা, মিজানুর রহমান, যুবলীগ নেতা মিন্টুসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

পূণঃতদন্তে গতবছরের ২১ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশ পুলিশ পূর্ব চার্জশীট বহাল রাখেন। এর ১৮ দিন পর বাদি ও সাক্ষীদের ম্যানেজ করে ওই ছয আসামী জামিনে মুক্তি পান।

এ ছাড়া ফতেপুরের তিনটি মুসলিম বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হাবিবুর রহমান ও চাকদাহে সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মোট তিনটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হলেও মামলা চলছে মন্থরগতিতে।

(আরকে/এসপি/মার্চ ৩১, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

১৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test