E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সিলেটে সিআইডি পুলিশের উপর হামলা

এক মাসেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, অভিযোগের তীর জৈন্তাপুরের ওসি তাজুলের দিকে

২০২৩ নভেম্বর ১২ ১৭:৫১:২০
এক মাসেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, অভিযোগের তীর জৈন্তাপুরের ওসি তাজুলের দিকে

রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : সিলেটে সিআইডি পুলিশের উপর দুর্বৃত্তদের হামলার একমাস পেরিয়ে গেলেও কোন আসামী গ্রেফতার করতে পারেনি জৈন্তাপুর থানা পুলিশ। স্থানীয় সূত্র বলছে, ইচ্ছে করেই আসামীদের গ্রেফতার করেনি জৈন্তাপুর থানা পুলিশ। সূত্রমতে, চিহৃিত ওইসব চোরাকারবারিদের (আসামী) গ্রেফতার করলে জৈন্তাপুর থানার ওসি'র লাইন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাই এতো অনিহা দেখাচ্ছে পুলিশ।

গত ১৩ অক্টোবর শুক্রবার ভোর ৪ টা ৩০ মিটিটের দিকে সিলেট সিআইডির পরিদর্শক (ওসি) আব্দুল আওয়াল-এর নেতৃত্বে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় মাদক ও চোরাচালান রোধে অভিযান চালায় সিআইডির একটি টিম। এসময় সিলেট সিআইডির কর্তব্যরত ওই টিমের উপর অতর্কিত হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এতে নাজমুল নামে সিলেট সিআইডির এক উপ-পরিদর্শকের হাত ভেঙ্গে যায় এবং পরিদর্শক আব্দুল আওয়ালসহ বেশ কয়েকজন সিআইডির পুলিশ সদস্য আহত হন। দুর্বৃত্তরা ওই সময়ে সিআইডি পুলিশের একজোড়া হাতকড়াসহ একজন আসামীকেও ছিনিয়ে নেন।

ঘটনাস্থল থেকে ভারতীয় চা পাতা ভর্তি একটি ডিআই পিকআপ গাড়িসহ আজগর আলী (৩৫) নামে একজন এক দুর্বৃত্তকে আটক করে পুলিশ। এই বিষয়ে সিআইডি পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন যা দীর্ঘ একমাস যাবত দেখভাল করে আসছে জৈন্তাপুর থানা পুলিশ। আসামীদের ছিনিয়ে নেয়া একজোড়া হাতকড়া উদ্ধার করা ছাড়া কোন সাফল্য নেই জৈন্তাপুর থানা পুলিশের। পুলিশ অভিযান চালিয়ে হাতকড়া উদ্ধার করার কথা গর্বের সহিত বললেও স্থানীয় সূত্র বলছে, কয়েকজন আসামী পুলিশকে ডেকে নিয়ে হাতকড়া ফিরিয়ে দিয়েছেন! এদিকে আসামী গ্রেফতারে দৃশ্যমান তেমন কোন তৎপরতা চোখে না পড়লেও স্থানীয়দের চোখ এড়াতে পারেনি ওসির সাথে আসামীদের সখ্যতা। জৈন্তাপুর বাজারে একাধিক আসামীর সাথে জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলামকে একাধিকবার কথাবার্তা বলতে দেখেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

এই মামলা দুটি নিয়ে অনুসন্ধানকালে স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, 'পুলিশ চেষ্টা করলে কি না পারে? আসামীর বাড়ীতে অভিযান চালিয়ে হাতকড়া পাওয়া যায় কিন্তু আসামী নয়! আবার আসামী নিয়ে বাজারে বসে চা পান করা যায়, খাসগল্প করা যায়, কিন্তু গ্রেফতার ইস্যুতে রহস্যময় কারণে তাদের খুঁজে পায় না!' এসবকিছুই ওসি তাজুলের সাজানো নাটক ছাড়া আর কিছুই নয় বলেও জানান তারা।’

এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দারা উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে আরো বলেন, 'ওসি এসব নাটক করছেন কারণ, জৈন্তাপুর থানায় ওসি তাজুলের নিজস্ব লাইন চলে সীমান্তে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কোন টিম যথা-র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি উক্ত থানা এলাকায় অভিযান চালালে তিনি নাখোশ হন। আর, জৈন্তাপুর থানাকে না জানিয়ে কোন টিম উক্ত থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করলে কোন রেজাল্ট আসেই না বরং তাদের উপর মাঝে মাঝেই হামলা করানো হয়! এর আগে র‌্যাবের উপরও হামলা হয়েছে, মামলা হয়েছে। কিছুই হয়নি।’

মাঝে মধ্যেই সীমান্তে এমন ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। র‌্যাবের উপর হামলার বিষয়টিও র‌্যাব ও মামলার সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এমনকি এর আগে বিজিবির উপরও হামলা হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন তারা, যা স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হয়েছে। প্রশাসনের উপর এসব হামলার ঘটনায় মামলা না হয়ে বেশিরভাগ সময় মীমাংসা হয়।

জানা যায়, সম্প্রতি সিআইডি অভিযান চালিয়ে কিছু চোরাকারবারিদের ধরেছেন, মালামাল জব্দ করেছেন, মামলা দিয়েছেন। তাই হয়তো সিআইডি উপর চটেছেন ওসি তাজুল ও তার নিজস্ব সিন্ডিকেটের চোরাকারবারিরা। আর সেজন্যই তাদের সায়েস্তা করতে ওসি জ্ঞাতার্থেই তার লাইনের লোকজন এমন হামলা করে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

লাইনের লোক কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তাদের একজন জানান, 'আরে বাবা এটাও বুঝেন না, ওসি তাজুল যেসব বোঙ্গা (চোরাকারবারি) থেকে নিয়মিত টাকা খেয়ে ছেড়ে দেন বা যাদের টাকার বিনিময়ে লাইন দেন, তাদের যদি অন্য কোন টিম অর্থাৎ ডিবি, সিআইডি, র‌্যাব ধরে ফেলে তাহলে কি ওসির ইজ্জত থাকে?- ইজ্জত থাকে না, ব্যবসারও ক্ষতি হয়! ওসি কি তা চাইবেন?"

এ বিষয়ে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের নিকট জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ তাজুল ইসলামের একমাত্র বক্তব্য হচ্ছে, 'আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে!'

সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) শেখ মো: সেলিম উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, 'নানা ঝামেলার কারণে হয়তো সিআইডির মামলাগুলোর কোন আসামী গ্রেফতার করতে পারেনি থানা পুলিশ। তবে হামলার সময় দুর্বৃত্তরা সিআইডির যে একজোড়া হাতকড়া ছিনিয়ে নিয়েছিল তা উদ্ধার করেছে পুলিশ।'

এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মোঃ সেলিম আরো জানান, 'এক মাসে একজোড়া হাত কড়া উদ্ধার করেছে, সেটিই বা কম কি, এটার জন্য ধন্যবাদ দেয়া উচিত পুলিশকে।' আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ মোঃ সেলিম জানান, 'আমরা সব মামলাই গুরুত্বের সহিত দেখি।'

সিআইডি পুলিশের উপর এমন নেক্কারজনক হামলা, আসামীদের কর্তৃক হাতকড়াসহ অপর আসামী ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা, সিআইডি কতৃক একাধিক মামলা হওয়ার এক মাস সময় পেরিয়ে গেলেও কেন জৈন্তাপুর থানা পুলিশ কোন আসামী গ্রেফতার করতে পারেনি? এমন এক প্রশ্নের জবাবে সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি সুজ্ঞান চাকমা উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'জৈন্তাপুর থানা কেন কোন আসামী গ্রেফতার করতে পারেনি সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এতোদিনেও একটি আসামী গ্রেফতার না হওয়া দুঃখজনক ও হতাশাজনক।' এটি সিআইডি পুলিশের জন্য দুর্ভাগ্যই বলেও মন্তব্য করেন সুজ্ঞান চাকমা।

উল্লেখ্য, পুলিশ পরিদর্শক মোঃ তাজুল ইসলাম সিলেট জেলায় যোগদানের পর সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ থানার পর কানাইঘাট থানার ওসি হন। সেখানে ২ বছর অতিক্রম করার পর তিনি বদলী হন সিলেটের অপেক্ষাকৃত দুর্বল থানা বিয়ানীবাজারের ওসি হিসাবে। কিন্তু সেখানে তিনি নিজেকে বেমানান মনে হওয়ায় মাত্র ৬ মাসের মাথায় তিনি কায়দা করে চলে আসেন সিলেটের সীমান্তবর্তী ক্রাইমজোন হিসাবে পরিচিত জৈন্তাপুর থানার ওসি হিসেবে। যেখানে এখন তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন বলে মনে করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। সীমান্তে চোরাকারবারিদের প্রায় প্রতি রাতেই লাইন দেন জৈন্তাপুর থানার ওসি তাজুল ইসলাম। তার এসব কাজের জন্য জৈন্তাপুর সীমান্তের অঞ্চল ও প্রোডাক্ট ভিত্তিক রয়েছে তার আলাদা আলাদা লাইনম্যান। যারা ওসির নির্দেশে লাইন দেন, টাকা তুলেন।

অনেকের ধারণা ওসি তাজুল ইসলাম এসব করতেই তদবির করে সীমান্ত এলাকায় এসেছেন। তার পরিবার ঢাকায় বসবাস করলেও তিনি দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন সিলেট সীমান্তবর্তী বিভিন্ন থানায়। এখানে চোরাকারবারিদের যোগসাজশে গড়ে তুলেছেন বিশাল চোরাচালান সিন্ডিকেট। আর এসব সিন্ডিকেটে তার সাথে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি, অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ অসাধু কর্মকর্তা। যারা ওসিকে বিভিন্নভাবে সেল্টার দেন ও ওসির লাইনের চাঁদার টাকার ভাগ বসান।

জানা যায়, ওসি মোঃ তাজুল ইসলাম সিলেট সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ থানা থেকে কানাইঘাটের ওসি সিহেবে ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারি যোগদান করেন। সেখানে তিনি ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। এরপর তিনি সিলেট সীমান্তের আরেক থানা বিয়ানি বাজারে ওসি হিসেবে যোগ দেন। বিয়ানি বাজার থানা তিনি ২০২৩ এর জানুয়ারি শেষ থেকে আগস্টের ২৮ তারিখ পর্যন্ত ওসি হুিসেবে নিযুক্ত থাকেন। আগস্টের শেষে যোগদেন সিলেটের আরেক সীমান্তবর্তী থানা জৈন্তাপুরে। স্থানীয় সূত্র বলছে, তিনি দীর্ঘদিন সিলেট সীমান্তে কাজ করায় তার একটি নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও বলয় তৈরি হয়েছে। যা এখন স্থানীয়ভাবে 'জৈন্তা থানার লাইন' বা 'জৈন্তার ওসির লাইন' হিসেবে পরিচিত।

(আরআর/এসপি/নভেম্বর ১২, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test