E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ঐতিহ্যবাহী তারক গোঁসাইয়ের বাড়িতে মতুয়া ভক্ত-অনুরাগীদের ঢল

২০২৪ মার্চ ০৮ ১৫:১০:০৩
ঐতিহ্যবাহী তারক গোঁসাইয়ের বাড়িতে মতুয়া ভক্ত-অনুরাগীদের ঢল

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : মতুয়া ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় তীর্থক্ষেত্র লোহাগড়ার জয়পুর গ্রামের তারক গোঁসাইয়ের বাড়ি সেজেছে অপরুপ সাজে। তারক গোঁসাইয়ের তিরোধান তিথিতে হাজার হাজার মতুয়া ভক্ত ও অনুসারীদের পদচারণায় মুখরিত গোঁসাই বাড়ি। জয় ঢংকার শাব্দিক ছন্দে মুখরিত গোঁসাইবাড়িসহ আশেপাশের এলাকা।

বাংলা কবিগানের অন্যতম পথিকৃৎ কবিয়াল তারক গোঁসাইয়ের ১০৯ তম তিরোধান দিবস আজ শুক্রবার। এ উপলক্ষে নড়াইলের লোহাগড়ার কবিধাম জয়পুর গ্রামে তিনদিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া অশ্বিনী গোঁসাইয়ের বাড়ি, পরশমনি মহাশশ্মান, সাধনা মায়ের বাড়ি এবং শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালিমাতা মন্দিরেও অনুরুপ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

শুক্রবার শুভ অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে তিরোধান তিথির অনুষ্ঠান। শনিবার মহোৎসব আর রবিবার মীন মহোৎসব অনুষ্টিত হবে।

তিরোধান দিবসকে সামনে রেখে বুধবার সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকার ভক্ত অনুরাগী কবিধাম জয়পুর গ্রামে আসতে শুরু করেছেন। গোঁসাইবাড়ি সেজেছে অপরুপ সাজে। এ উপলক্ষে কবিধামসহ আশেপাশের এলাকাজুড়ে গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। দোকানীরা হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার জয়পুুর গ্রামের ‘গোঁসাইবাড়ি’ একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী তীর্থক্ষেত্র। গোঁসাইবাড়ি দেশের মতুয়া স¤প্রদায়ের কাছে অতি পরিচিত ও পূজনীয় নাম। তারক গোঁসাইয়ের বাড়িটি মতুয়া ধর্মাবলম্বীদের কাছে ’দ্বিতীয় তীর্থক্ষেত্র‘ হিসেবে পরিচিত। এমন কোন মতুয়া খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি লোহাগড়ার জয়পুর গ্রামের গোঁসাই বাড়ি দর্শন করেন নাই। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক এই গোঁসাই বাড়ি। এ বাড়িতেই জন্মেছিলেন রসরাজ তারক গোঁসাই, যিনি কবিগানের ¯্রষ্টা।

ইতিহাস থেকে জানা গেছে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার জয়পুর একটি প্রাচির ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ। ছোট, শান্ত ও শীর্ণকায় বহমান নবগঙ্গা নদীর উত্তর-পশ্চিম পাড়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোঁসাইবাড়ি। লৌকিক সংস্কৃতির লীলাভূমি এই গোঁসাইবাড়ি। আর এই জয়পুর গ্রামে বাংলা ১৯৫২ সালের ১৫ অগ্রহায়ণ অমাবস্যা তীথিতে জন্মগ্রহণ করেন মতুয়া ধর্মের অন্যতম ধর্মগুরু যোগসিদ্ধ মহাপুরষ তারক চন্দ্র সরকার। ভক্তকুলে তিনি ‘তারক গোঁসাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ছিলেন। তার পিতার নাম কাশীনাথ সরকার ও মাতার নাম অন্নপূর্ণা সরকার। কাশীনাথ ছিলেন একজন পেশাদার শিল্পী। কবিগান গেয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। এজন্য তিনি কবিগানের একটি দল গড়ে ছিলেন। এ গান গেয়ে তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু কাশীনাথ ও অন্নপূর্ণার ঘরে কোন সন্তান ছিল না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়শই ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। দীর্ঘদিন ধরে কোন সন্তান-সন্ততি না থাকায় কাশীনাথ ‘পুত্রেষ্টী’ যজ্ঞ করেন এবং পরবর্তীতে অন্নপূর্ণার গর্ভে তারক গোসাই জন্মগ্রহণ করেন। তারক গোঁসাই ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। সুদর্শন ও সৌম্যকান্তি তারক গোঁসাই বাল্যকাল থেকেই মানব সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। গায়ক পিতা কাশিনাথ কখনোই চাননি, তারক গায়ক হোক। তিনি চেয়েছিলেন, সে লেখাপড়া শিখে অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত হোক। এজন্য তারককে পাশের গ্রাম ছাতড়ার পাঠশালায় ভর্তি করা হয়। কাশীনাথের বাড়ির সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতি ও অন্য কবিয়ালদের আগ্রহে ছোট বেলা থেকেই তারক গোঁসাই সংগীতের সাথে জড়িয়ে পড়েন। আশে পাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তার গানের সুনাম। তিনি বহু কবিগান ও কবিতা রচনা করে ছিলেন। এতদাঞ্চলের নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে তিনি ‘দেবদূত’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

পিতা কাশীনাথ মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেন তারক গোঁসাই। পুরোপুরি লেগে পড়েন কবিগানের দল নিয়ে। নিজেই দল গড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কবিগান গাইতে শুরু করেন। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে কবিয়াল তারক গোঁসাইয়ের নাম ও খ্যাতি। তিনি শুধু কবিগানই গাইতেন না, তিনি অজ¯্র কবিগান রচনা করেছিলেন। নিজের লেখা কবিগান গুলো সুর দিয়ে ছন্দের তালে হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন। অপূর্ব সুরের জাদুকরী কন্ঠের অধিকারী ছিলেন তারক গোঁসাই। কবিগানের অন্যতম দিকপাল তারক গোঁসাই রচিত কবিতা ও কবিগানের সংখ্যা দু’সহ¯্রাধিক। বাংলা ১৩২১ সালের ১৭ ফাল্গুন শিব চতুদর্শীর রাতে তারক গোঁসাই ইহলোক ত্যাগ করেন।

কবি রসরাজ তারক গোঁসাই এর স্মৃতি বিজড়িত জয়পুর পরশমনি মহা শশ্মান ও শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালিমাতা মন্দির আজও স্ব মহিমায় ভাস্বর। এই দুই তীর্থক্ষেত্রে তীরধান দিবস উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।

জয়পুর মহাশশ্মান পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সচিব কমলেশ চন্দ্র দাস কানু বলেন, “এ বছর মহাসাধক তারক গোঁসাইয়ের তিরোধান দিবসে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটবে। তাদের সেবায় পরশমণি মহাশশ্মানের স্বেচ্ছাসেবকরা ইতোমধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহন করেছে।”

শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালিমাতা মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সহ সম্পাদক কিশোর রায় জানান, মহা শিবরাত্রি ব্রত উৎসব উপলক্ষে শিব মন্দিরে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া কবিয়াল তারক গোঁসাইয়ের প্রয়াণ তিথি যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হবে।

কবিগানের পথিকৃৎ তারক গোঁসাইয়ের জন্ম ও মৃত্যূতিথীর অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় ভাবে পালনের দাবি জানিয়ে গোঁসাই বাড়ির অন্যতম কর্ণধার পরীক্ষিত সিকদার বলেন, 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার'। তারকের উৎসব সার্বজনীন। সুস্থ ও শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব সম্পন্ন করার আহবান জানান।

(আরএম/এএস/মার্চ ০৮, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test