E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দিনাজপুরে জনবসতি এলাকায় ময়লার ভাগাড়, হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য 

২০২৪ মার্চ ৩১ ১৭:১০:১৩
দিনাজপুরে জনবসতি এলাকায় ময়লার ভাগাড়, হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য 

শাহ্‌ আলম শাহী, দিনাজপুর : দিনাজপুরে জনবসতি ও প্রাতিষ্ঠানিক দপ্তরের মাঝে স্থাপিত ময়লার ভাগাড় পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যেও জন্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে।ময়লার ভাগাড়ের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হাজার হাজার মানুষ। রাস্তায় চলাচল, বাসা-বাড়ি, উপসানলয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে অবস্থান, ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছে না অনেকেই। ময়লার ভাগাড়ের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা যে কোন সময়। এ সমস্যার কথা স্বীকার করলের তা নিরসনের কোন উদ্যোগ নেই পৌর কর্তৃপক্ষ'র। 

১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর পৌরসভা। ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৯০ সালে।প্রথম শ্রেণির পৌরসভা ঘোষণার ৩৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আজোবধি ময়লার শোধনাগার নির্মাণ করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। দিনাজপুর পৌরসভার একমাত্র ময়লা গাড্ডাটি এখন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি এলাকা।ময়লা গাড্ডার দুর্গন্ধের বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

এলাকার মর্জিনা বেগম জানায়, ময়লার দুর্গন্ধে বাড়িতে থাকাতো দূরের কথা রাস্তায় চলাচল করা যায় না। অমার বাঁচ্চারা অসুস্থ্য পড়েছে। টিউওবলের পানিতেও দুর্গন্ধ। কাক মুখে ময়লা আবর্জনা এনে বাড়িতে ফেলাচ্ছে। বিশ্রী অবস্থায় আমরা জীবন-যাপন করছি। দেখার কেউ নেই।'

রংপুর বদরগঞ্জ থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা কনিকা জানালেন, 'ভাই বমি আসতেছে। আমি গতকাল সন্ধ্যায় বিশেষ কাজে খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। এসেই বিপদে পড়েছি। সাথে ছোট বাচ্চা থাকায় রাত হয়ে যাইয়ায় বাড়ি ফিরতে পারিনি। এখন চলে যাচ্ছি।এখানে থাকলে আমরা মা-বাঁচ্চা মারা যাবো।যে দুর্গন্ধ! থাকায় দুষ্কর।'

মোকসেদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ক্ষোভের সাথে জানালেন, 'এখানে আমরা মানুষ বসবাস করিনা।করলে অবশ্যই এর একটা সুরাহা হতো। এই ময়লা গাড্ডা অন্যত্র সরিয়ে নিতো। আগে লোক সংখ্যা কম ছিলো। এখন অনেক মানুষ বাড়ি করেছে।দোকান-পাট,হাট-বাজার, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। দুর্গন্ধ নিয়ে নাক মুখ ঢাকিয়ে এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন চিরিবন্দর, পার্বতীপুর, বদরগঞ্জ, ক্যান্টনমেন্ট, রংপুর, দিনাজপুর শহরে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করছে। কিন্ত, এই ময়লার ভাগাড়টি সরিয়ে ফেলার কেউ উদ্যোগ নিচ্ছেনা।'

এলাকার আরেক ব্যক্তি মজিবর রহমান জানালেন, 'এই কারণে কেউ আমাদের এলাকায় আত্মীয়তা করতে চায় না।ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিতে চায়না এই এলাকার মানুষের সাথে। আমরা মহা বিপদে আছি। এই বিপদ থেকে কেউ উদ্ধার করছেনা। এনিয়ে আমরা আন্দোলন করতে গিয়ে আরো বিপদে পড়েছি।ময়লা গাড্ডার সীমানা প্রাচীর ভাংগার অভিযোগে আমাদের পুলিশ পিটিয়েছে।মামলা হয়েছে। তাই,ভয়ে আর কেউ কথা বলেনা।'

এ নিয়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলার সময় ৯ বছরের শিশু নাবিলা আবেগ তাড়িত হয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে 'আমরা কি মানুষ না? আমাদের কি বাঁচার শখ নাই। আমরা বাড়িতে পড়তে পারিনা। পথ দিয়ে স্কুলে যাইতে পারিনা। কেমন যেনো খারাপ গন্ধে বমি আসতে চায়। আপনারা কি করেন ? এইটা সরাইতে পারেন না। সাংবাদিক হইছেন কেনো? ’

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ময়লার ভাগাড় সংলগ্ন দিনাজপুর কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র ও প্রবাসী ব্যাংক। সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। বিদেশগামী ও তাদের স্বজনেরা আসেন ব্যাংকে।

কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণার্থী আলমগীর হোসেন জানালেন, 'আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ময়লার গাড্ডার পাশে হওয়ায় আমরা খুবই যন্ত্রণায় আছি। দুর্গন্ধ নিয়েই আমরা এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। প্রশিক্ষণ করে শেষ করতে পারবো, এখন এই চিন্তায় আছি। শেষ হলেই বাঁচি।'

মাতা সাগর মোড়ের বাজারে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। আছে, মসজিদ-মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাতাসাগর, আদিবাসীপাড়া, মেদ্যাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় এক হাজার পরিবারের বসবাস। তারপরও পৌর সভার পরিবহণে করে শহরের পয়োনিষ্কাশন এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য এবং বিভিন্ন প্রাণির মরদেহও উন্মুক্তভাবে ফেলা হচ্ছে এখানে। মাতাসাগরস্থ ৮ দশমিক ৬০ একর জমিতে অবস্থিত ময়লার ভাগাড়টি বর্তমানে পুরোপুরি ময়লা-আবর্জনা দিয়ে পরিপূর্ণ।

দিনাজপুর পৌরসভার ময়লা পরিবহনের গাড়ি সারা দিন,রাতে শহরের ময়লা সংগ্রহ করে এনে এখানে ফেলে যায়। এমনকি দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালসহ শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিভিন্ন অপারেশনের বর্জ্যও এখানে উন্মুক্তভাবে ফেলা হচ্ছে। এমনকি দিনাজপুর শহরে মারা যাওয়া বিভিন্ন প্রাণির মরদেহও এই গাড্ডায় ফেলা হয়। আর সেই বর্জ্য ও প্রাণীর মরদেহের টুকরো কাক নিয়ে যাচ্ছে যেখানে-সেখানে।

মেডিকেলের বর্জ্য বহনকারী কাভার্ড ভ্যানের চালক শাহজাহান আলী জানালেন, 'মেডিকেলের বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলা নিষেধ রয়েছে। এটা পৌরসভার জায়গা,তাই এখানে এনে ফেলি। শুধু আমি না, এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে অপারেশনের বর্জ্য নিয়ে এসে এখানেই ফেলা হয়।'

প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও শহরটিতে আজ পর্যন্ত আবর্জনা শোধনাগার নির্মাণ হয়নি। ফলে দিন দিন গাড্ডায় ময়লার পরিমাণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্গন্ধের পরিমাণ। বর্তমানে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এলাকাটি। বর্ষার সময় মহা দূর্যোগ সৃষ্টি হয় এলাকায়। দুর্গন্ধ থাকতে পারে না এলাকাবাসী।

পরিবেশ ও সাংস্কৃতিককর্মী রহমতুল্লাহ রহমত জানান, 'রাস্তায় চলাচল,বাসা-ববাড়ি,উপসানলয়,শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে অবস্থান, ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছেন না অনেকেই।গাড্ডার ময়লা ও পানি মাটির নিচে যাওয়ায় আশপাশের টিউবওয়েলে উঠছে দুর্গন্ধযুক্ত পানি। একারণে যেকোনো সময় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ নিয়ে আন্দোলনও করেছেন এলাকাবাসী। কিন্তু, কোন সুফল পাওয়া যায়নি এখনো। অথচ, রিসাইক্লিনের মাধ্যমে এ ময়লা গাড্ডাটি হতে পারে মহা সম্পদ। রিসাইক্লিনের মাধ্যমে এই ময়লা থেকে তৈরি হতে পারে মুল্যবান গ্যাস। কিন্ত, এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেই, পৌরকর্তৃপক্ষর। এখানে রিসাইক্লিনের ব্যবস্থা করা হোক না হয় তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোন। তা না হলে এই ময়লার ভাগার এলাকার মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে যেতে পারে। পৌর কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে, এই ময়লার গাড্ডা এখন থেকে সরিয়ে এখানে আন্তঃজেলা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল করতে পারেন। এতে শহরের আরেক যন্ত্রণা যানজট অনেকাংশই লাঘব হবে।'

দিনাজপুর সিভিল সার্জন ডা. বোরহান-উল ইসলাম বলেন, যে কোন ময়লা-বর্জ্যের উন্মুক্ত ভাগাড় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে মাছিবাহিত ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, কলেরা, এলার্জি, চুলকানি মতো রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। পাশাপাশি ময়লার ভাগাড় থেকে কুকুর বা শিয়াল যেসব বর্জ্য খায় এবং পাখি যদি খেয়ে থাকে তাহলে পাখিবাহিত রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়াও মেডিকেল থেকে যেসব বর্জ্য ভাগাড়ে যায় সেগুলো কোনো অবস্থাতেই উন্মুক্ত জায়গায় ফেলা উচিৎ নয়। পাশাপাশি ময়লার ভাগাড় থেকে বের হওয়া মিথেন গ্যাস পৃথিবীর ওজন স্তরকে ছিদ্র করে কমিয়ে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এই সব ময়লার ভাগার পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য উভয়ের জন্য মারাত্মক হুমকি।'

বিশ্রী দুর্গন্ধে সেইসর বর্জ্য ও প্রাণি মরদেহের টুকরো কাক নিয়ে যাচ্ছে যেখানে-সেখানে। প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও শহরটিতে আজ পর্যন্ত আবর্জনা শোধনাগার নির্মাণ হয়নি। ফলে দিন দিন বাড়ছে ময়লার ভাগার।

এ সমস্যার কথা স্বীকার করে দিনাজপুর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আবু তৈয়ব আলী দুলাল জানালেন, 'যদিও মাতা সাগরের ময়লা গাড্ডাটি এখন আমাদের কাছে, মরার উপর খাড়ার ঘা। তা অত্র এলাকাবাসীর জন্য চরম দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্গন্ধে মানুষের বসবাসের অনুপযোগ হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছেন ওই এলাকার মানুষ। কিন্তু, এ মুহুর্তে করার কিছু নেই। এটিই এখন পৌরসভার একমাত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান। শহর পরিষ্কার রাখার জন্য আন্তরিকভাবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেইসব ময়লা-আবর্জনা সেখানে ফেলা হয়। তবে, এ নিয়ে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। সেখানে ময়লা শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে।রিসাইক্লিনের মাধ্যমে সেই ময়লা আবর্জনা সম্পদের পরিণত করা হবে।'

(এসএস/এসপি/মার্চ ৩১, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test