E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উদ্ভাবক ভাইরাল সঞ্জু নয়, আদিবাসীদের মজাদার খাবার বাঁশ বীজ

২০২৪ এপ্রিল ২৪ ১৮:০০:৩৫
উদ্ভাবক ভাইরাল সঞ্জু নয়, আদিবাসীদের মজাদার খাবার বাঁশ বীজ

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : বাঁশ ফুলের বীজ দানা'র চাল তৈরি ও বিক্রি করা ভাইরাল শ্রমজীবী যুবক সাঞ্জু রায় (২৪) প্রকৃত উদ্ভাবক নয়, স্থানীয়ভাবে এর উদ্ভাবক ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আদিবাসী সম্প্রদায়ের যোশেফ মুর্মু (৬৫)। মূলত: বংশপরম্পরায় এই সম্প্রদায়ের মানুষ বাঁশ ফুলের ফল বা বীজ থেকে চাল সংগ্রহের মাধ্যমে ভাত-পায়েস-খিচুড়ি-রুটি, ছাতুসহ মাজাদার খাবার তৈরি করে খাচ্ছেন।

আজ বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে সরজমিনে গিয়ে এ ভাইরাল বিষয়টি নিয়ে অনেকের কথা হয়েছে। মিলেছে এর প্রকৃত তথ্য ও উপাত্ত।

ওই এলাকায় অসংখ্য বাঁশ ঝাড়। জনাজীর্ণ কয়েকটি বাঁশ ঝাড়ে ঝরে গেছে লালচে শুকনা পাতা। বাঁশ ও কঞ্চির ফোঁড়ে ফোঁড়ে ঝুলছে ধানসদৃশ দানাদার ফল। সেই ফল সংগ্রহ করছেন অনেকেই। ময়লা পরিষ্কার করে, ঝেরে, রোদে শুকিয়ে চলছে মাড়াই। হাসটিং মিলে ছাঁটাই করার পর উৎপাদিত ‘চালে’ রান্না হচ্ছে ভাত, পায়েস-খিচুড়ি-রুটি,ছাতুসহ তৈরি হচ্ছে মাজাদার খাবার।

'আগে এমনটি ছিল না।সঞ্জু রায়ের মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর বাঁশ ফুলের ফল বা বীজ সংগ্রহের সারা পড়েছে এই এলাকায়।দেখার জন্য অনেকেই ছুটে আসছেন দূর দুরান্ত থেকে।'

এমনটাই জানালেন, স্থানীয় যুবক আশিকুল রহমান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেন। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছিলেন। কিন্তু প্রচন্ড তাপদাহের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। তাই বাড়িতে এসেই, অনলাইনে ক্লাস করছেন তিনি। এবার বাড়িতে এসে তাদের এলাকার বিষয়টি ভাইরাল হতে দেখেছেন। এর আগে শুনেছেন, আদিবাসীরা এসব খায়। এখন তিনি নিজে তা স্বচক্ষে দেখছেন।বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর অনেকেই বাঁশ ঝাড় থেকে ফল বা দানা সংগ্রহ করছেন। অনেকে দেখতে আসছেন।এই চাল কিনেও নিয়ে যাচ্ছেন।আমি এখনো খাইনি। খাওয়ার ইচ্ছা আছে।

এনিয়ে ভাইরাল ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের শ্রমজীবী যুবক সঞ্জু রায়। তিনি এখনো ব্যস্ত এই বাঁশ ফুলের বীজ দানা সংগ্রহে। বাড়িতে বস্তায় বাঁশ ফল বস্তায় ভরছিলেন।হাসকিং মিলে তা ভাঙ্গাবেন।

এ বিষয়ে সাঞ্জু রায় বলেন, ‘আমি দিনমজুরি করে খাই। আজ থেকে এক মাস আগে পাশের গ্রামে কাজ করতে যাই। সেখানে কাজের ফাঁকে যোশেফ নামে পরিচিত একজনকে বাঁশের বীজ থেকে দানা সংগ্রহ করে খাওয়ার তৈরি করতে দেখি। তার কথামতো আমিও সেগুলো সংগ্রহ করে প্রথমে নিজে খাই, ভালো লাগায় এর পর থেকে তা সংগ্রহ করে যাচ্ছি। এতে নিজেদের খাবারের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে, পাশাপাশি এই চাল ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছিলাম। এখন ৫০ টাকা কেজি। এতে আমার বাড়তি আয় হচ্ছে।'

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের লালদিঘী আদিবাসী পাড়ায় দীর্ঘদিন থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসবাস। এই এলাকায় প্রচুর কাঁটা যুক্ত বেড়া জাতের বাঁশ ঝাড় রয়েছে।

স্থানীয় ভাবে বাঁশ ফুলের বীজ দানা'র চাল ও খাদ্য তৈরির উদ্ভাবক আদিবাসি গ্রামের দিনমজুর যোশেফ মুর্মু (৬৫) বলেন, 'আমার মায়ের বিয়ে এ চাউল দিয়ে হয়েছে বলে শুনেছি। আমাদের গ্রামে বহুবছর থেকে এর ব্যবহার হয়ে আসছে। আমি নতুন করে ৪০ বছর আগে এর ব্যবহার নতুন করে শুরু করেছি।আমাদের ব্যবহার দেখে আশে পাশের অনেকেই এর ব্যবহার করছে।'

অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল,বংশপরম্পরায় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আদিবাসী সম্প্রদায় বাঁশ ফুলের বীজ থেকে দানা সংগ্রহের মাধ্যমে ভাত-পায়েস-খিচুড়ি-রুটি,ছাতুসহ মাজাদার খাবার তৈরি করে খেয়ে আসছেন।

আদিবাসি গ্রামের গৃহবধূ মাইকো বাস্কে (৫৫) জানান, 'আমরা বাপ দাদার সময় থেকে এ চাউল খেয়ে আসছি। বাঁশের ফুল হলে সংগ্রহ করি। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চাউল আটা করে খাই। অতীতে বিয়েসহ বিভিন্ন আয়োজনে এ বাঁশের ফুলের চাল ব্যবহার করা হতো।'

আদিবাসি গ্রামের আর এক গৃহবধু রোজিনা বাস্কে (৫৫) বলেন, 'এগুলো বেড়া বাঁশের ফল। স্বাধীনতার পরে একবার খেয়েছি। এবছর আবার খেলাম।'

ভাইরাল হওয়া এবিষয়টি নিয়ে দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. নুরুজ্জামান বলেছেন, 'উদ্বিতাত্বিক দিক থেকে বাঁশ এবং ধান গাছ একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। বিশেষ করে দানা উৎপাদনের ক্ষেত্রে। বাঁশের বীজ হুবহু ধানের মতোই। দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে কিছু বাঁশ ঝাড়ে ফুল এবং ফল এসেছে। সেই বীজ দানাগুলো লোকজন সংগ্রহ করে চাল বানাচ্ছেন। রান্না করে খাচ্ছেন। বিষয়টি আমি অবগত রয়েছি। এ চাল খাবার উপযোগি, পুষ্টি সমৃদ্ধি ও ঔষুধি গুণাগুণ রয়েছে।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর আক্তার হোসেন বলেছেন ,পরিবেশ সংরক্ষণে বাঁশের ভূমিকা অপরিসীম। কার্বন নিঃসরণ, পানি সংরক্ষণ, পানি পরিশোধন, পরিবেশ সংরক্ষণে বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছর পরে বাঁশের জীবনচক্র শেষান্তে ফুল ও ফল বা বীজ আসতে পারে। ফল ও বীজ দেওয়ার পর ওই বাঁশ সাধারণত মারা যায়। বাঁশের বীজ পুষ্টিকর খাবার তা সাধারণত আদিবাসীরা খেয়ে থাকে। কিন্তু, আমাদের দেশে তা খাওয়া উচিৎ নয়। খেয়ে ফেলতে বাঁশ বংশ বিস্তারে বাঁধাগ্রস্ত হবে এবং বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই, সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচিত বাঁশের এই ফল বা বীজগুলোর সংরক্ষণ করে বন বিভাগের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেয়া। যাতে করে এই বাঁশ পরিবেশ সংরক্ষণে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।'

তিনি আরো বলেন, 'বাঁশের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বাম্বুসা ভালগারিস’। এটি মূলত ফাঁপা কাণ্ডবিশিষ্ট ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে।'

(এসএস/এসপি/এপ্রিল ২৪, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test