E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সাতক্ষীরায় ঋণ দান সমিতি খুলে গ্রাহকদের শত কোটি টাকা প্রতারণা

২০২৪ সেপ্টেম্বর ১৩ ১৯:৫৩:৩১
সাতক্ষীরায় ঋণ দান সমিতি খুলে গ্রাহকদের শত কোটি টাকা প্রতারণা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : গ্রাহকদের শতকোটি টাকা প্রতারণা করে বর্তমানে কারাগারে অবস্থানকারি সাতক্ষীরায় প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক প্রাণনাথ দাসের এপার -ওপার কাহিনী এখন জনসম্মুৃখে আসতে শুরু করেছে।

প্রাণনাথ দাস (৪৬) সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টিকেট গ্রামের মৃত জুড়ন দাসের ছেলে ও বর্তমাসে পুরাতন সাতক্ষীরার বাসিন্দা।

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টিকেট গ্রামে বেড়াতে আসা প্রাণনাথ দাসের এক আত্মীয় সজীব কুমার দাস ভারতের স্পেশাল টাক্স ফোর্সের উপপরিদর্শক বৈদ্যুর্য্য ঘোষের বরাত দিয়ে এ প্রতিনিধিকে জানান, গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সাতক্ষীরায় প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক প্রাণনাথ দাস প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা দিতে না পেরে স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস ও দুই মেয়েকে নিয়ে অবৈধপথে ভারতে চলে যান। সেখানে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে প্রাণনাথ দাস চলতি বছরের ১৭ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে গোবরডাঙা থানাধীন ঠাকুরনগরের নিকটবর্তী খাটুরা-জামদানি মোড়ে সন্দিগ্ধভাবে ঘোরাঘুরির সময় স্পেশাল টাক্সফোর্সের উপপরিদর্শক বৈদ্যুর্য্য ঘোষ ও উপপরিদর্শক সাদিকুল ইসলামের হাতে ধরা পড়েন।

গোপনে খবর পেয়ে প্রাণনাথকে ধরতে যাওয়ার আগে উপপরিদর্শক বৈদ্যুর্য্য ঘোষ চলতি বছরের ১৭ মার্চ সন্ধ্যা ৬টা ০৫ মিনিটে থানায় ৩৭৩ নং সাধারণ ডায়েরী করেন। তাকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিন হাজারের বেশি গ্রাহককে অধিক মুনাফা দেখিয়ে বহু টাকা জমা করে তা ফেরৎ দিতে না পেরে জীবন বাঁচাতে স্বপরিবারে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত দিয়ে ভারতের ঘোজাডাঙায় আসেন বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান। রাতেই তাকে গোবরডাঙা থানায় সোপর্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাণনাথ ভারতে অবস্থানের কোন বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

এমনকি বাংলাদেশে অবস্থানকারি তার কোন আত্মীয়ের মোবাইল নং দিতে পারেননি। একপর্যায়ে ১৭ মার্চ রাতেই প্রাণনাথ দাসের বিরুদ্ধে ১৪(এ) ফরেনার এক্ট এ (৭৮/২৪ নং) মামলা হয়। পরদিন গোবরডাঙা থানার উপপরিদর্শক সুব্রত কুমার ঘোষ তাকে বারাসাত সিজেএম আদালতে পাঠান। আদালত তাকে ১৪ দিন কারা হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

এদিকে প্রাণনাথ দাসের কাছ থেকে সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি প্রাণনাথ দাসকে জামিনে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন। একপর্যায়ে পিডব্লিউ মূলে আদালতে হাজির রেখে চলতি বছরের ২৪ জুন প্রাণনাথ দাসকে জামিন দেওয়া হয়। জামিনের শর্ত হিসেবে তিন হাজার টাকার মধ্যে দেড় হাজার টাকা লোকাল ও দেড় হাজার টাকা রেজিষ্টার জামিনের কথা বলা হয়। ওই দিন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাবড়া থানাধীন খোশদেলপুর গ্রামের বেলায়েত আলী সাহাজীর ছেলে আমজাদ আলী সাহাজী স্থানীয় জামিনদার হিসেবে গুমা মৌজার, জেএল-৯১, ৬০৬ নং খতিয়ানের ৮৪৪ দাগের তিন শতক জমি (১৯৯৭ সালে ২৩৮৮ নং রেজিষ্ট্রি কোবালা মূলে কেনা) যার বাজার মূল্য এক লাখ ৮০ হাজার টাকা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিক্রি, বন্ধক বা যে কোন প্রয়োজনে হস্তান্তর না করার ব্যাপারে এফিডেফিড করে দেন। এফিডেফিডে ওই জমি হস্তান্তর হলে তিনি সম্পূর্ণ টাকা সরকার বাহাদুৃরকে দিতে বাধ্য থাকিবেন বলে উল্লেখ করা হয়।

মামলার পরবর্তী দিন ৭ জুলাই ধার্য করা হয়। সকল প্রক্রিয়া শেষে ২৪ জুন বিকেলে প্রাণনাথ জামিনে মুক্তি পান। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সুব্রত ঘোষ ১৫ জুন আদালতে প্রাণনাথ দাসের বিরুদ্ধে ১৪(এ) ফরেনার এক্ট এ অভিযোগ দাখিল করলেও ২৫ জুন তা আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

২৯ জুন শনিবার ভোরে দেশে ফিরে প্রাণনাথ প্রতারণার অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর থানায় আটক হন। পরদিন রবিবার ২২ জন গ্রাহকের পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা প্রতারণার অভিযোগে শহরের কাটিয়া কর্মকারপাড়ার কালিপদ গাইনের ছেলে প্রশান্ত কুমার গাইনের দায়েরকরা মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলায় প্রাণনাথ দাস, তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস, বড় ভাই বিশ্বনাথ দাস ও ভায়রা ভাই পুরাতন সাতক্ষীরার প্রদীপ কুমার দাসকে আসামী করা হয়। তবে গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচতে গত ৫ আগষ্ট জেলখানা ভেঙে প্রায় সকল আসামী পালালেও তিনি কোন প্রকারে কারাগারের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। গত ৭ জুলাই আদালতে হাজির না হওয়ায় বারাসাতের সিজেএম তার জামিন বাতিল করেছেন ।

প্রসঙ্গতঃ প্রাণনাথ দাস ২০০২ সালে রুপালী লাইফ ইনসিওরেন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জেলা ও জেলার বাইরে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে বহু টাকা আত্মসাৎ করেন। পরে ২০১২ সালে ১২১ নং সমবায় রেজিষ্ট্রেশন মূলে প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি খোলেন প্রাণনাথ দাশ। সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বড় ভাই বিশ্বনাথ দাশকে নিযুক্ত করে গত ১০ বছরে ডিপিএস ও ফিক্সড ডিপোজিট এর মাধ্যমে কয়েক শত গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা প্রতারণা করেন। প্রতারণার টাকা দিয়ে তিনি পুরাতন সাতক্ষীরায় বাড়িসহ গাভায় চার বিঘা জমি, সদুরডাঙিতে দুটি বাড়ি, বুধহাটায় দুটি অফিস, মুন্সিপাড়ায় চার শতক জমি ও পুরাতন সাতক্ষীরায় দুটি শোরুম খোলেন। জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে প্রাণনাথ সাতক্ষীরা মন্দির সমিতির সাংগঠণিক সম্পাদক, বাস মলিক সমিতির সাংগঠণিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন সংগঠনের ভাল ভাল পদ অলঙ্কৃত করেন। করেন কুলিয়া ইউপি নির্বাচন।

একপর্যায়ে প্রাণনাথ টিকেট গ্রামে নিজের পৈতৃক ১১ বিঘা জমি, মুন্সিপাড়ার চার শতক জমি, গাভার জমিসহ সদুরডাঙার একটি বাড়ি, কুল্ল্যার দুটি অফিস বিক্রি করে দেন। বিক্রি করেন তার কয়েকটি বাস ও প্রাইভেটকার। সদুরডাঙির একটি বাড়ি ও পুরাতন সাতক্ষীরার বাড়ি প্রাইম ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে এক কোটি ১৩ লাখ টাকার ঋণ নেওয়ায় তা আর হস্তান্তর হয়নি। এসব জমি বিক্রি করার খবর পেয়ে গ্রাহকরা মুনাফা ও আসল টাকা ফেরৎ চাইলে প্রাননাথ টালবাহানা শুরু করেন। একপর্যায়ে ভারতে পালিয়ে যান গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে।

(আরকে/এএস/সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০৬ অক্টোবর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test