E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

ভূমিহীন নেতা কামরুল হত্যা 

জামিন পেলেন আজিজুর, গোলাম ফারুক বাবু ও  সিরাজুল

২০২৫ জানুয়ারি ১৬ ২৩:৪৭:৪০
জামিন পেলেন আজিজুর, গোলাম ফারুক বাবু ও  সিরাজুল

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার দেবহাটার খলিষাখালির ভূমিহীন নেতা কামরুল ইসলামকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামী কালিগঞ্জের নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, দেবহাটার পারুলিয়া ইউপি’র বর্তমানে চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু ও সাবেক চেয়ারমান সিরাজুল ইসলাম। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে বৃহষ্পতিবার তারা সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হলে বিচারক চাঁদ মোঃ আব্দুল আলীম আল রাজী তাদেরকে আগামি ১১ ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাািমন মঞ্জুর করেন।

দেবহাটা থানা ও সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা যায়, দেবহাটার খলিষাখালির আবু বক্করের ছেলে খলিষাখালি ভ‚মিহীন সমিতির সহসভাপতি কামরুল ইসলামকে গত ১ নভেম্বর সকালে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগে তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম বাদি হয়ে কালিগঞ্জের নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, দেবহাটার পারুলিয়া ইউপি’র বর্তমানে চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু ও সাবেক চেয়ারমান সিরাজুল ইসলামসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে ১০ নভেম্বর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

গ্রেপ্তার এড়াতে ওই মামলার ১নং আসামী নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, পারুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলঅম ফারুক বাবু ও পারুলিয়া ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান শেখ সিরাজুল ইসলাম গত ২ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি শেখ তাহসির আলীর বেঞ্চ থেকে ছয় সপ্তাহের অন্তবর্তীকালিন জামিন নেন।

জামিনের শর্ত অনুযায়ি গত ৯ জানুয়ারি তারা সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন। এর আগে গত ৮ জানুয়ারি সাক্ষী হিসেবে আল আমিন পাড়কে নূর আমিন ইসলাম বানিয়ে তার সঙ্গে ওয়াছেল গাজীর ছেলে আবুল হোসেনের যৌথভাবে এফিডেফিড সম্পাদন করা হয়। এ ছাড়াও হামলাকারিদের দলে থাকা বাবুরাবাদের জেহের আলীর ছেলে আব্দুস সবুরের একই দিনে এফিডেফিড করানো হয়। জামিন শুনানীর আগেই আদালতের বারান্দায় হত্যা মামলার আসামী চিংড়িখালির অস্ত্রধারী ক্যাডার শহীদুল ইসলাম মামলার বাদি মর্জিনা বেগম ও তার ছেলে ওয়াদুদকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেয়।

জামিন আবেদনপত্রে আসামী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. আব্দুল মজিদ (২) স্বাক্ষী আবুল হোসেন, আল আমীন পাড় ওরফে নূর আমিন ইসলাম ও আব্দুস সবুরের করা এফিডেফিডের অংশ বিশেষ উল্লেখ করেন যে, ডাকাতির প্রস্তুতিকালে উৎসুক জনতা ও সেনাবাহিনী ডাকাতি ও লুটপাট প্রতিহত করাকালে কামরুলকে মারপিট করে। সেনাবাহিনীর নির্দেশে কামরুলকে আহত অবস্থায় আব্দুস সবুর মটর সাইকেলে করে সখীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এ আসামীরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত না।

আবার রামনাথপুরের আলীম গাইন ২ নভেম্বর থানায় যে মামলা করেছেন তাতে নিহত কামরুলসহ অপর ছয়জনকে সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলে। সখীপুর হাসপাতাালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ আসামীদের বিরুদ্ধে ঘটনার ১০দিন পর থানায় মামলা করা হয়েছে এ আসামীদের বিরুদ্ধে।

জামিনআবেদনপত্রের একাংশে তিন আসামীর মধ্যে দু’জন বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। আসামীগণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি ও অংগ সংগঠণ যুব দলের সহিত জড়িত এবং বিভিন্ন সময়ে তারা দলের বিভিন্ন পদ পদবী প্রাপ্ত হইয়া সক্রিয়ভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে আসছে।

এদিকে জামিন আদেশের একটি স্থানে আসামীপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য তুলে ধরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আসামীরা বিএনপি’র দলীয় চেয়ারম্যান।

অপরদিকে জামিন আদেশের একটি অংশে রাষ্ট্রপক্ষের পিপির বক্তব্যের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে ডাকাতি করতে যেয়ে ভিকটিম মৃত্যুবরণ করেন। আসামীরা ঘটনার সাথে জড়িত নন। আসামীদের জামিনে তার আপত্তি নেই।

গত ৯ জানুয়ারি প্রত্যেক আসামীকে ৫ হাজার টাকা বন্ডে আগামি ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তবর্তীকালিন জামিন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন আদালতের সিএসআই মনিরুজ্জামান।

প্রসঙ্গত, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ২০২১ সালের জুলাই মাসে খলিষাখালি বিলে চন্ডীচরণ ঘোষের ফেলে যাওয়া ১৩১৮ বিঘা জমি লাওয়ারিশ সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করলে সাপমারা খালের দু’পাশের ভ‚মিহীনসহ প্রায় আটশত ভ‚মিহীন ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে বসবাস শুরু করে। আইডিয়ালের নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম, শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, তার ছেলে সুরুজ কাজী, সখীপুরের আব্দুল আজিজ, পারুলিয়ার আনারুল, আহছানিয়া মিশনের ইকবাল মাসুদ, সিরাজুলসহ জবরদখলকারি সহলটি পুলিশের সহায়তায় ভ‚মিহীনদের উপর দফায় দফায় হামলা করে। দেওয়া হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা।

গত বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি ওই জমি লাওয়ারিশ হিসেবে চুৃড়ান্ত রায় দিলে কালিগঞ্জের নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, তার ব্যবসায়িক অংশীদার মাছ আনারুল, পারুলিয়া ইউপি চেয়ারেম্যান গোলাম ফারুক বাবু, সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামসহ একটি মহল ভ‚মিহীন নেতাদের একাংশকে মাছ বিক্রির লভ্যাংশ ও মাসিক বেতনে কাজ করার সুবিধা দেখিয়ে ওই জমি দখলে নেন। আজিজুর রহমানের পক্ষে থেকে সন্ত্রাসীরা দফায় দফায় ভ‚মিহীনদের একাংশের উপর হামলা চালায়।

নিজেদের আশ্রয়স্থল বজায় রাখতে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চেয়ারম্যান আজিজুর, তার ব্যবসায়িক অংশীদার মাছ আনারুল, পারুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু, শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, ভ‚মিহীন নেতা রবিউল, তার ভগ্নিপতি আনারুল, বাবুরাবাদের জেহের আলীর ছেলে আব্দুস সবুর এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন রিয়াজুল ইসলাম ও পহেলা নভেম্বর নিহত কমারুল ইসলাম গাজী। গত ৯ অক্টোবর সিনিয়র সহকারি সচীব আব্দুল হাই স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অভিযোগের বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহল করে প্রতিবেদনসহ গৃহীত কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মহদোয়কে এক নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এছাড়াও ৩ অক্টোবর ভ‚মিহীনদের পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সাতক্ষীরা ক্যাম্পের সেনা কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

শ্যামনগর থানার লুট হওয়া দুটি অস্ত্র খলিশাখালির আকরাম ও আব্দুল গফুরের কাছে আছে এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে গত বছরের পহেলা নভেম্বর সকালে সোর্স সেজে সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করায় কালিগঞ্জের নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ও তার পরিষদের সাবেক সেনা সদস্য ও নলতা ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমানসহ আজিজুরের ব্যবসায়িক অংশীদার মাছ আনারুল। এতে সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পারুলিয়া ইউপি চেয়ারেম্যান গোলাম ফারুক বাবু, সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামসহ আইডিয়ালের নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম, শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, তার ছেলে সুরুজ কাজী, সখীপুরের আব্দুল আজিজ, পারুলিয়ার আনারুল, আহছানিয়া মিশনের ইকবাল মাসুদ, সিরাজুলসহ একটি মহল।

এ সময় ভূমিহীন নেতা কামরুল ইসলামকে ওই চক্রটি পিটিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। ছয়জন ভূমিহীনকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য মজুত রাখা গোলা বারুদ দিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। হামলাকারি দলের লোক বাবুরাবাদের আব্দুস সবুর চেয়ারম্যান আজিজুরের নির্দেশে একজনের সহায়তায় কামরুলের লাশ মটর সাইকেলে বসিয়ে সখীপুর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে ফেলে আসে (প্রত্যক্ষদর্শী ও সখীপুর হাসপাতালের সিসি টিভি ফুটেজ অনুযায়ি)।

সখীপুর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অবহিত করেন যে, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পহেলা নভেম্বর সকাল ৯টায় কামরুলকে মৃত অবস্থায় রেখে চলে গেছে। কামরুলতে হত্যার আগে তার বাড়ির শ্যালো মেশিন, গরু, ছাগল ও বিভিন্ন জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়। ঘটনা পহেলা নভেম্বর সকালের হলেও তা ২ নভেম্বর ভোর চারটায় উল্লেখ করে ওই দিন বিকেল আটককৃত ছয়জনসহ নিহত কামরুলের নামে মামলা দেয় রামনাথপুরের আব্দুল আলীম। যদিও মামলাটি (জিআর-৯২/২৪ দেবঃ) এক মাস আগে ২ অক্টোবর রেকর্ড দেখানো হয়।

পরবর্তীতে ওই মামলার পাঁচ আসামীর জামিন শুনানীকালে এক মাস আগে মামলা রেকর্ড দেখানোর বিষয়টি জেলা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সভায় উপস্থাপন করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের পিপি অ্যাড. আব্দুস সামাদকে নির্দেশনা দেন। কামরুলকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম বাদি হয়ে ৩ নভেম্বর আজিজুর রহমান, মাছ আনারুল, গোলাম ফারুক বাবু, সিরাজুল ইসলাম, নোড়ারচকের এছাক আলী, তার ছেলে আনারুল ইসলাম, আনারুলের শ্যালক রবিউল ইসলাম, চিংড়িখালির শহীদুল ইসলাম, তার ভাই রবিউল ইসলাম বুল্লা, তালার পাখরা হালিম, গোদাড়ার মহিউদ্দিন, মহাজনপুরের হাবিব, তুজুলপুরের জাহাঙ্গীর আলমসহ ২৩ জনের নামে থানায় অভিযোগ দিলে মামলা নিতে গড়িমসি করলে বাদি তার ছেলে ওয়াদুদকে নিয়ে পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করেন। বিষয়টি ১০ নভেম্বর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মিটিংএ উপস্থাপন করা হয়।

ওই দিন সন্ধ্যায় মামলা রেকর্ড করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর সদর হাসপাতালের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে কামরুলকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। পরে আজিজুর, গোলাম ফারুক বাবু ও সিরাজুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের জন্য অন্তবর্তীকালিন জামিন নিলেও অন্য আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বিষয়টি বাদি মর্জিনা বেগম ও ভাইপো ওয়াদুদ মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তাকে অবহিত করার পাশপাশি সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার ও র‌্যাব অফিসকে অবহিত করেন। এরপরও ঘটনার পর থেকে কোন আসামী গ্রেপ্তার হয়নি। এমনকি আসামীরা স্বাক্ষীদের ম্যানেজ করতে খলিষাখালির সরকারি জমি সাক্ষী আবুল হোসেনসহ কয়েকজন সাক্ষীকে কয়েক বিঘা করে জমি দিয়ে আসামীদের পক্ষে এফিডেফিড করিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়।

সর্বোপরি হত্যা মামলার আসামী নোড়ারচকের এছাক আলী, তার ছেলে আনারুল ইসলাম, আনারুলের শ্যালক রবিউল ইসলাম, চিংড়িখালির শহীদুল ইসলাম, তার ভাই রবিউল ইসলাম বুল্লা, তালার পাখরা হালিমসহ কয়েকজন খলিষাখালি সড়কের পাশে প্রকাশ্যে সমাবেশ করে বক্তব্য রেখেছে। এক সময়কার “ খলিষাখালি বঙ্গবন্ধু ভূমিহীন আবাসন প্রকল্প” এর নাম পরিবর্তণ করে নিহত কামরুল ইসলামের নামে নামকরণ করার ঘোষণা দিয়েছে।

(আরকে/এএস/জানুয়ারি ১৬, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test