E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

অভয়নগরে মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৯ বাড়িতে লুটপাট অগ্নিসংযোগ

পোড়া বাড়িগুলোতে সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চলছে সংস্কার কাজ

২০২৫ জুন ১০ ২৩:০৪:৫০
পোড়া বাড়িগুলোতে সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চলছে সংস্কার কাজ

* নিহতের দলীয় লোকজনের হুমকি অব্যহত

রঘুনাথ খাঁ, অভয়নগর থেকে ফিরে : যশোর জেলার অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নের ডহর মশিয়াহাটির বাড়েদাপাড়ার মতুয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত ১৯টি পরিবারের ৮টি বাড়িতে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত রবিবার থেকে এ কাজ চলছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের গৃহকর্তাসহ ওই এলাকার অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাতে পুলিশ টহল দিচ্ছে। এরমধ্যে নিহত কৃষকদল নেতকা তরিকুল ইসলাম জীবনের পক্ষের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ ওই পাড়ার মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজনদের হুমকি অব্যহত রেখেছেন।

সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে অভয়নগরের ডহর মশিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়ায় যেয়ে দেখা গেছে, মহিতোষ বিশ্বাস, বিষ্ণুপদ বিশ্বাস, সুশান্তবিশ্বাস ও শংকর বিশ্বাসের বাড়িতে সেনাবাহিনীর উপস্তিতিতে ঘরবাড়ি সংস্কারের কাজ চলছে। একইসাথে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতাপ বিশ্বাস, প্রণব বিম্বাস, পবন বিশ্বাসের বাড়িতে সংস্কারের কাজ চলছে। পবন কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে আগামি রবিবার থেকে কাজ শুরু হবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত সকল বাড়ি সংস্কার করা হবে বলে জানালেন স্বানীয়রা। পোষা গরু ছাগলগুলো আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বাড়ির গোয়ালঘরে রাখা আছে।

ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবার আগুনের ক্ষতচিহ্ন মুছে ফেলে আবারো স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্রতী হয়েছেন। তবে একই দিনে একই সময়ে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা দিল্লিশ্বর বিশ্বাসের ছেলে তরিকুল হত্যা মামলায় জেল হাজতে থাকা দীনেশ বিশ্বাসের বাড়িটি এক পাশে হওয়ায় তাদের সরকারি সহায়তাসহ দয়ালু মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্য যথেষ্ট কম। সকাল সোয়া ৯টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শণে যাওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা বিশ্বনাথ ঘোষ, নিত্যানন্দ আমিন, গৌর দত্ত, বলাই দে, সুভাষ ঘোষ ,পলাশ দেবনাথ এর সাথে কথা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত স্মৃতি রানী বিশ্বাস, পবিত্রা বিশ্বাস, স্বাস্থ্য কর্মী নুপুর বিবিশ্বাসসহ অনেকেই। তারা তাদের পরিবার প্রধান ছাড়া বিদ্যুৎবিহিন বাড়িতে কিভাবে বসবাস করছেন তার বর্ণনা দেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলেন, নিহত তরিকুল ইসলামের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা হত্যা মামলায় পরিকল্পিত আসামী করা দীনেশ বিশ্বাসসহ আট আসামীর আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর অন্য কাউকে ঘেরের লিজ ডিডে সাক্ষর করলে তাদের জান খালাস করে দেওয়া হবে।

এ হুমকি গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার লোকজন সব কিছু জেনেও ওইসব লোকজনের বাড়েদাপাড়ায় আসা- যাওয়া বন্ধ করতে পারেনি। এ ছাড়া মামলা নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর লোকজনদের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করায় গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকে কিভাবে আত্মগোপনে রয়েছেন তাদের দুর্দশার পাশাপাশি দরিদ্র সাগর বিশ্বাসসহ কারাগারে থাকা দীনেশ বিশ্বাসের আইন সহায়তা পেতে খরচ যোগাড় না করতে পারার কথা তুলে ধরেন তারা বই, খাতা, ল্যাপটপ, শিক্ষা সনদ পুঁড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা ব্যহত হওয়ার কথা তুলে ধরেন। তাই ১২ জন শিক্ষার্থীর বইপত্র ও একজন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম পূরণের জন্য নগদ আর্থিক সহাংতা দেন সাতক্ষীরার সংখ্যালঘু সংগঠণের নেতৃবৃন্দ। তবে সুন্দলী বাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ১৫জন ব্যবসায়ির পক্ষ থেকে সোমবার পর্যন্ত থানায় কোন মামলা করা হয়নি। পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে তরিকুল খুন হলেও তার বাড়ি ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ও তাকে হত্যা মামলার আসামী করার নিন্দা জানান স্থানীয়রা। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা শাহবাগের পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাড. কালিপদ মৃধার নেতৃত্বে ওই কমিটির কয়েকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শণ শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দেন।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার সময় বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ও তাদের ধর্মীয় প্রতষ্ঠিানের উপর হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চলে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা প্রতিকার পাচ্ছে না। ফলে এখন একজন ধর্ষিতাও প্রতিবাদ বা মামলা করতে সাহস পাচ্ছে না। তাই এদেশে বসবাস করতে হলে ও সম্পদ রক্ষায় আমাদের একতাবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

প্রসঙ্গত, বাড়েদাপাড়ায় বিল বোকড় বিলে ডহর মশিয়াহাটি, হাটগাছা, বাজে কুলটিয়া, ভাটবিনা, সড়াডাঙা, সুজাতপুর ও ধোপাদী গ্রামের ৯৯ ভাগ হ্দিু সম্প্রদায়ের মানুষের ২৪০ বিঘা জমি রয়েছে। ওই জমি লীজ নিয়ে কেশবপুরের পাজিয়া এলাকার ফেরদৌস বাবু ওরফে চিকন বাবু ২০১৩ সাল থেকে ইজারা নিয়ে ঘের করতেন। তিনি ঠিকমত ইজারার টাকা না দেওয়ায় দুই গত মার্চে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে আর ইজারার মেয়াদ না বাড়িয়ে অন্য কোন ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বাড়েদাপাড়ার মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন। এ নিয়ে কয়েকদিন আগে মাইকিং করা হয়।এক সপ্তাহ আগে বাড়েদাপাড়ার বটতলায় গ্রামবাসিদের সভা আহবান করা হলেও প্রবল বৃষ্টির কারণে সভা হয়নি। এরপর থেকে নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল সরদার ও যশোরের এক সাবেক বিএনপি মন্ত্রীর আত্মীয় ফিরোজ খান ওই ২৪০ বিঘা জমি লীজ নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন। গত ২২ মে সন্ধ্যায় জমির মালিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিনা টাকায় লীজ ডিডে তরিকুল ও ফিরোজ খানের দুই গ্রুপের লোকজন সাক্ষর করিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকালে ফিরোজ খান গ্রুপের হাতে পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে খুন হন তরিকুল।

কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর তরিকুলের লাশ পিল্টু বিশ্বাসের ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। তরিকুলকে বহনকারি সুমন সরদার বিষয়টি ভিন্নভাবে তরিকুল সমর্থকদের মোবাইল ফোনে জানান। এতে ক্ষুব্ধ তরিকুল সমর্থকরা সুন্দলী বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে প্রেট্রাল ও গান পাউডার দিয়ে ১৯টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শেষে অঅগুন লাগিয়ে ভষ্মীভূত করে। ঘটনার ৫ দিন পর নিহত তরিকুলের ভাই রফিকুল ইসলাম পরিকল্পিতভাবে বোকড় বিলের জমি মালিক ও ক্ষতিগ্রস্ত আট মতুয়া সম্প্রদায়ের পরিবার প্রধানের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাসকে মহিতোষ বিশ্বাসের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের পর গোয়েন্দা পুলিশে সোপর্দ করে হামলাকারিরা। ২৪ মে তাকে ৫৪ ধারায় ও ২ জুন তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৯টি পরিবারের ঘরবাড়ি পোড়ানো ও লুটপাটের ঘটনায় ২৬ মে সুশান্ত বিশ্বাসের স্ত্রী কল্পনাবিশ্বাস কারো নাম উল্লেখ না করে অভয়নগর থানায় একটি মামলা (১৭ নং) দায়ের করেন। একই দিনে নিহত তরিকুলের ভাই রফিকুল ইসলাম বাদি হয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের ৮ জনসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২৫ জনের নামে মামলা (১৬) দায়ের করেন। পোড়ানো মামলায় চারজন ও হত্যা মামলায় তিনজনকে ২ জুন আদালত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করে।

হত্যা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা যশোর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরুল কবীর ভুঁইয়া ও পোড়ানো মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আলীম বলেন, বাড়েদীপাড়ার পরিস্থিতি ক্রমশঃ শান্ত হয়ে আসছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কোন প্রকার হুমকির বিষয়ে তাদেরকে অবহিত করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(আরকে/এসপি/জুন ১০, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৮ জুন ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test