E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রায়পুরে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ০১ ১২:৪৬:০৯
রায়পুরে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছ। নদী-নালা, খাল-বিল, গর্ত-ডোবা ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, ছাট বড় জলাশয় সেচে মাছ ধরা, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধনের কারণে অনেকপ্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে । আশংকা করা হচ্ছে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না চিরতরে হারিয়ে যাবে দেশীয় মাছের ঐতিহ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ছোটমাছ না ধরে প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ করা, ডিমওয়ালা মাছ প্রকৃতিতে অবমুক্তকরণ, ছোট মাছের উপকারিতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, জেলে পরিবারগুলোকে এ সময়ে এসব মাছ মারার পরিবর্তে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, কীটনাশকের মাত্রারিক্ত ব্যবহার কমানো  পাবলে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে । না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবে প্রকৃতিক উৎসের  নানা প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ। বিপন্ন হবে আপন কৃষ্টি, হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য।

জানা গেছে, বর্তমানে আমাদের দেশে উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্বই বিপন্ন। ইতোমধ্যে এ অঞ্চল থেকে খয়ড়া, মায়া, লালচাঁদা, কাকলে, রিটা, আইড়, পাবদা, তপসে, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, ঝায়া মাছসহ ১৫ প্রজাতির ছোটমাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। অস্তিত্বসংকটে রয়েছে টেংরা, খলুই, ভেদা, শিং, কৈ, মাগুর, বেলে, টাকি, খলিশা, চলাপুঁটি, গোরকুতে, বাঁশপাতা, বাইম, পাকাল, তোড়াসহ দেশি প্রজাতির অনেক মাছ। অবশ্য বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কিছু কিছু হাইব্রিড জাতের কৈ ও আফ্রিকান জাতের মাগুর মাছের চাষ হচ্ছে। তবে এ মাছের খুব একটা স্বাদ নেই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের মৎস্য জাদুঘর ও জীববৈচিত্র কেন্দ্রের দেশব্যাপী পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, হুমকির মুখে পড়া মাছের সংখ্যা এখন ১’শতে দাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে ২৫ প্রজাতির মাছ। বছর দশেক আগেও উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে পাওয়া যেত অনেক রকম দেশী প্রজাতির ছোট মাছ। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে মাঝে-মধ্যে যাও বা কিছু আমদানি হয় তাও আবার চলে যায় ভাগ্যবান পয়সাওয়ালাদের বাজার ব্যাগে। এসব মাছের দাম অত্যন্ত চড়া হওয়ায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যে এসব মাছ আর জুটছে না।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলায় জলাশয়সহ সরকারি ও বেসরকারি ছোট বড়প্রোয় দুই হাজার পুকুর। উন্মুক্ত জলাশয় ও নদ-নদীতে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ বিচরণ করতে পারে। কয়েক বছর যাবৎ এ জনপদে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এলাকার খাল-বিল, পুকুর ও নদী-নালাগুলোর অধিকাংশই পানিশূন্য। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ বৃষ্টির পানির তোড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ভেসে এসে বদ্ধ পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বংশ বিস্তার করে। পানির অভাবে এরা বর্ষা মৌসুমেও নদী-নালা খাল-বিলে বংশ বিস্তার করতে পারছে না।
বামনী গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী শাহাব উদ্দিন। বাড়ির আশপাশের খাল-বিল, ডোবা ও নদী থেকে সারা বছর মাছ ধরে সংসার চালাতেন। গত কয়েক বছর ধরে ওই মাছ পাচ্ছেন না। এতে তিনি পেশা বদল করেন। আক্কাছ মিয়া বলেন, ‘৪-৫ বছর আগে হত্যেক দিন ৪০০-৫০০ টিয়ার মাছ বেইচতাম। ২-৩ বছর ধরি অন আর মাছ হাইনা। অন মাছ ধরা বাদদি রিক্সা চালাই।’
এলাকার মৎস্যজীবী রবি জলদাস, কুন্তল ও নান্টু হালদার বলেন, বর্তমানে স্থানীয় সরকারি খাল-বিল-প্রকৃত মৎসজীবীরা ইজারা পায় না। স্থানীয় প্রভাবশালীরা মৎস্যজীবী সেজে প্রভাব খাটিয়ে খাল-বিল ইজারা নিচ্ছে। যার কারণে আমরা প্রকৃত মৎস্যজীবী হয়েও খাল-বিল ইজারা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। আমরা বর্তমানে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। অনেক জেলেরা তাদের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে উপার্জন করতে না পেরে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। প্রভাবশালীরা খাল-বিল ও জলাশয়ে পোনা জাতীয় মাছ চাষ করে অধিক লাভের সুযোগ খোঁজে। খাল-বিল ও সরকারি জলমহালগুলো ইজারা নিয়ে কারেন্ট জাল ব্যবহার করে দেশী প্রজাতির মাছের বংশ ধ্বংস করে বিদেশি শংকর ও হাইব্রিড জাতের মাছ চাষ করছে। দেশী প্রজাতির মাছের প্রতি তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে চলতে থাকলে এ জনপদে আগামী এক দশকে জলাশয়গুলো দেশীয় প্রজাতির মাছ শূন্য হয়ে পড়বে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, কৃষি জমিতে অপরিমিত মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার দেশীয় প্রজাতির মাছের বর্তমান বিপর্যয়ের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিষের ছোবলে ডিএনএ এবং আরএনএর পরিবর্তন ঘটে। সেই সাথে ডিম ধারণ ক্ষমতা ৪০ ভাগ, ডিম নিষিক্তের হার ১৫ ভাগ এবং বাচ্চা প্রস্ফুটনের হার ২৫ ভাগ কমে যায়। এ ছাড়া অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নদী-নালা, খাল-বিল, গর্ত-ডোবা ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, ছাট বড় জলাশয় সেচে মাছ ধরা, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন ইত্যাদি।
রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এসএম মহিব উল্যা বলেন, গত কয়েক দশকে নদ-নদীগুলোর প্রবাহ ব্যাপক হারে কমে গেছে। নির্বিচারে খাল-বিল সেচে বা কীটনাশক ব্যবহার করে মাছ নিধনের ফলে মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে। এছাড়াও হ্যাচারিতে পানি সংকট দেখা দিলে খাল থেকে পানি সেচে ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন খাল সেচে বা কীটনাশক ব্যবহার হওয়ায় তাও সম্ভব হয় না।
(পিকেআ/পিবি/ফেব্রুয়ারি ১ ,২০১৫)


(

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test