E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অবরোধে স্থলবন্দর বেনাপোলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস

২০১৫ এপ্রিল ০৬ ১৮:৪৫:৫১
অবরোধে স্থলবন্দর বেনাপোলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস

যশোর প্রতিনিধি : বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধে ৯০ দিনে বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্যক্রমে বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থলবন্দরটি ব্যবহারকারী আমদানি ও রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের প্রায় হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অথচ দেশের অন্যসব স্থলবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে তেমন কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি বা বিরূপ প্রভাব পড়েনি।

ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সরকারেরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি। এর আগের ৩টি অর্থবছরেও বিভিন্ন কারণে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে লক্ষমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২,৫৬৭ কোটি টাকা। ৩১ মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১,৭৯৫ কোটি ৭ লাখ টাকা।

সংশিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমদানিপণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ,বন্দরে আটকে থাকা পণ্যের জন্য অতিরি সেড ভাড়া ও সড়কে নাশকতার ভয়। প্রধানত এই তিনটি কারণে ব্যবসায়ীরা ঠিকমত বাণিজ্য করতে পারেননি। লাভের মুখ দেখার বদলে তারা উল্টো বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে দেশের স্থলপথে আমদানি-রফতানি হওয়া পণ্যের ৭০ শতাংশই বেনাপোল বন্দর দিয়ে খালাস হয়। এ-পথে নিয়মিত আমদানিকারক রয়েছেন প্রায় দুই হাজার প্রতিষ্ঠান। আর রপ্তানিকারক রয়েছেন তিন শতাধিক।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আবার একই সাথে সরকার ও বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে আছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। টানা অবরোধের মধ্যে বন্দরের কার্যক্রম সচল রাখতে তাদের সকলের সহযোগিতার সুবাদে পণ্য আমদানিতে তেমন কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি। তবে বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ ও মহাসড়কে নিরাপত্তার অভাব ছিল প্রকট। ফলে আমদানি করা পণ্য দিনের পর দিন বন্দরে পড়ে থেকেছে। এ কারণে আমদানি করা পণ্যের জন্য অতিরিক্ত মাসুল গুনতে হয়েছে তাদের। লোকসানের কারণে তারা বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে এসময় সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়েছে পণ্য রপ্তানি। রপ্তানি পণ্য নিয়ে ট্রাক চালকরা ঠিকমত বেনাপোল বন্দরে আসতে পারেননি। এ কারণে সর্ববৃহৎ এই বন্দরটি দিয়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে খুবই কম। এতে ওই সকল ব্যবসায়ীদের লোকসানের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে না পারলেও অংকটা প্রায় হাজার কোটি টাকা -এমন ধারণাই পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে।

বেনাপোল বন্দর ও কাস্টমসের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, অবরোধের আগে গত ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ভারত থেকে ২৫ হাজার ৬৬৬টি ট্রাকে আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ৯২৭ মে:টন পণ্য। বেনাপোল বন্দরের গুদাম থেকে ৩১ হাজার ৪৫১ টি ট্রাকে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬ মে:টন আমদানিপণ্য খালাস হয়েছে। খালাস হওয়া পণ্য থেকে সরকারের রাজস্বআয় হয়েছিল ৬৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। শুল্ক বেশি আদায় হয়েছে এমন আমদানিপণ্যের মধ্যে রয়েছে থ্রি হুইলার,সিনথেটিক ফেব্রিক্স, কাপড়, গার্মেন্টস সামগ্রী,শিল্পকারখানায় উৎপাদন-পণ্যের কাঁচামাল(কেমিক্যাল),ট্রাক চেসিস, মেশিনারিজ, স্টিল সিড ইত্যাদি। এসময় বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য ভারতে রফতানি হয়েছে ৬৭ হাজার ৭৫১ মে:টন।

বর্তমানে টানা অবরোধের মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ভারত থেকে ২৩ হাজার ৪০৩ টি ট্রাকে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৮ মে:টন পণ্য। বন্দর গুদাম থেকে ৩১ হাজার ৪৫১ টি ট্রাকে খালাস হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫১৩ মে:টন পণ্য। খালাস হওয়া পণ্য থেকে সরকার রাজস্ব আয় করেছে ৫৯৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এসময় বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৬২ হাজার ৩৫৬ মে:টন। যা গত বছরের ওই সময়ের তুলনায় ৫ হাজার ৩শ ৯ মে:টন কম রফতানি হয়েছে।
সর্বশেষ (৩১মার্চ ২০১৫) ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৩৪১ ট্রাক পণ্য,ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৬৫ ট্রাক পণ্য, বন্দর গুদাম থেকে ২৩৫ টি পণ্য চালানে পণ্য খালাস হয়েছে ৩৩৩ ট্রাক। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বারের সাব কমিটির সভাপতি মতিয়ার রহমান জানান, বিশেষ করে রপ্তানিবাণিজ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু টানা অবরোধের কবলে পড়ে কাঁচামালের অভাব ও শ্রমিক সংকটের কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখন তা থমকে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া দেশে চলমান সহিংসতার কারণে বিদেশি ক্রেতারাও দেশে আসতে চাচ্ছেন না। এতে রফতানি ব্যবসায় মারাত্মক ধস নেমেছে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, বর্তমানে বন্দর অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ভারত থেকে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকচালকদের দিনের পর দিন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মূল্যবান পণ্য সামগ্রী বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে খালাস করতে হচ্ছে। এতে ওই সব পণ্য প্রায়ই চুরি বা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। এসব খেসারত দিতে দিতে পথে বসার যোগাড় ব্যবসায়ীরা। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে এসব পণ্যের দামও বাড়ছে।

বেনাপোল ট্রাক ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দীন গাজী বলেন, অবরোধ কিছুটা শিথিল হলেও এখনও সড়কে নাশকতার আশঙ্কা রয়েই গেছে। জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক চালকেরা পণ্য পরিবহন করছে। এছাড়া সড়কে পণ্য পরিবহনে খরচও বেড়েছে। ১ দিনের পথ পার হতে এখন ২ দিন লাগছে। একারণে ট্রাকভাড়া আগের তুলনায় বেশি নিচ্ছে চালকরা। তবে নাশকতার আশঙ্কামুক্ত হওয়ার সাথে সাথে ট্রাকভাড়া আবার সহনীয় পর্যায়ে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদ মহাসিন মিলন বলেন, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে অবরোধকারীরা পণ্যবাহী ট্রাক পুড়িয়েছে। এতে অনেক ব্যবসায়ী এখনও আতংকিত। পণ্য খালাস আগের তুলনায় কমে যাওয়ায় বন্দরে ব্যাপক পণ্যজটও সৃষ্টি হয়েছে। এতে আটকে থাকা পণ্যে যে কোনো সময় নাশকতা হতে পারে বলে শঙ্কায় ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনিক নিরাপত্তা বাড়ানো হলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেনাপোল কাস্টমস হাউজের যুগ্ম-কমিশনার আতিকুর রহমান বলেন, অবরোধ আস্তে আস্তে শিথিল হতে থাকায় ব্যবসায়ীরা বন্দরে আটকে থাকা পণ্যখালাস বাড়িয়েছেন। এতে রাজস্ব আয়ে যে ধ্বস নেমেছিল তা আস্তে আস্তে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক ( ট্রাফিক) আবদুল জলিল জানান, এখানে অবরোধকারীদের কোনো বাধা না থাকায় বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক চলছে। অবরোধ শুরুর প্রথম দিকে পণ্য খালাস কমে যাওয়ায় বন্দরে মারাত্মক পণ্য জট সৃষ্টি হয়েছিল। এখন খালাস বৃদ্ধি পাওয়ায় তা কমতে শুরু করেছে। যে কোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে বন্দর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

(জেকেএম/এএস/এপ্রিল ০৬, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test