E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ শওকত হোসেন হিরণের প্রথম মৃত্যুবাষির্কী

২০১৫ এপ্রিল ০৯ ১৬:১৪:১৫
আজ শওকত হোসেন হিরণের প্রথম মৃত্যুবাষির্কী

বরিশাল প্রতিনিধি :  দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক সচেতন খ্যাত বরিশাল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য, আধুনিক বরিশাল নগরী গড়ার একমাত্র রূপকার, সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণ। ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল সকালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে টানা ৩২ বছরের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ১৯দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে তিনি (হিরণ) পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। বরিশালের একমাত্র মুকুটহীন সম্রাট আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই লেখা।

নগরীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজল ঘোষের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কালীশুরি ইউনিয়নের আড়াইনাও গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর আব্দুল হাসেম সরদার এবং গৃহিনী জয়নব বেগম দম্পত্তির ৪ পুত্র ও ৬ কন্যার মধ্যে শওকত হোসেন হিরণ ছিলেন তৃতীয়। বরিশাল শহরের আলেকান্দা এলাকার নানা বাড়িতে ১৯৫৬ সালের ১৫ অক্টোবর শওকত হোসেন হিরণ জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়ার সুবাধে ছোট বেলা থেকেই নানা বাড়ি বরিশাল শহরে তার বসবাস। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের ১৮ দফা কর্মসূচীর দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বরিশালের রাজপথে নতুন ধারা ছাত্র সমাজের ব্যানারে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমেই তার (হিরণের) রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ। এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি তাকে। একে একে যুব সংহতি, ১৯৮৪ সালে ফ্রন্টেরও বরিশালের নেতৃত্বদানকারী নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি গঠনের পর শওকত হোসেন হিরণ রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হন। সে সময় তিনি (হিরণ) বরিশাল শহর জাতীয় পার্টির সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের দ্বিতীয় নির্বাচনে মাত্র ২৯ বছর বয়সী শওকত হোসেন হিরণ বিপুল ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার পথচলা। জনপ্রতিনিধি হিসেবে বেশ স্বল্পসময়েই হিরণ বরিশাল শহরবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
১৯৯৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মাধ্যমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে শওকত হোসেন হিরণ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ফলে সহজেই বরিশাল শহর আ’লীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এরপর থেকেই পাল্টে যেতে শুরু করে বরিশাল মহানগরীর রাজনৈতিক দৃশ্যপট। প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে দলীয় নেতাকর্মীদের একত্রিত করার মাধ্যমে রাজপথে তার ছিলো বলিষ্ঠ ভূমিকা। তিনি ছিলেন আন্দোলন সংগ্রামের ১৪ দলের সমন্ময়ক। যে কারনে বিএনপি অধ্যুষিত বরিশাল নগরী থেকে ২০০৮ সালের ওয়ান ইলেভেন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে শওকত হোসেন হিরণ জনগনের বিপুল ভোটের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম নগরীতে সকল দলের অংশগ্রহণে সহঅবস্থানের রাজনীতির ধারা চালু করেছেন। হিরণের নিরলস প্রচেষ্ঠার কারনেই বরিশাল নগরী সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও ছিনতাইকারী মুক্ত হয়েছিলো। অবশ্য এজন্য তাকে দলের কতিপয় নেতার চক্ষু শুলও হতে হয়েছিলো।
সূত্রে আরো জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের পর থেকে বরিশাল নগরীছিলো সকল প্রকার উন্নয়ন বঞ্চিত। সিটি কর্পোরেশনে আ’লীগ সমর্থিত মেয়র হিসেবে হিরণ-ই একমাত্র মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার দুরদর্শীতার কারনেই রাতারাতি পাল্টে যেতে শুরু করে নগরবাসীর জীবনচিত্র। নগরীতে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন হিরণ। বরিশালকে তিনি একটি শিশু বান্ধব নগরীতে পরিনত করেছেন। এছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন, নগরবাসীর জন্য একাধিকস্থানে বিনোদন কেন্দ্র, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতিকরনসহ ভ্রমন পিপাসুদের জন্য তিনি বরিশালকে একটি আদর্শ নগরীতে পরিনত করেছেন। ফলশ্রুতিতে দলমত নির্বিশেষে তিনি চলে গিয়েছিলেন সাধারন মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়।
রাজনীতিতে তিনি (হিরণ) দীর্ঘদিন বরিশাল শহর আ’লীগের সাধারন সম্পাদক, মহানগর আ’লীগের আহবায়ক ও ২০১৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দলের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শওকত হোসেন হিরণ বরিশাল-৫ (সদর) আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। হিরণের সহধর্মীনি জেবুন্নেছা আফরোজ স্বামীর পাশাপাশি বরিশালের অবহেলিত নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে সর্বত্রই বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। একজন সফল নারীনেত্রী হিসেবেও তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। হিরণের জীবনের শেষ ইচ্ছেছিলো বরিশাল শহরকে তিনি এশিয়ার মধ্যে একটি সৃজনশীল শহরে উপনিত করবেন। সেলক্ষ্যে তার পরিকল্পনা মোতাবেক উন্নয়নমূলক কাজও চলছিলো। এরইমধ্যে ২০১৪ সালের ২২ মার্চ রাত ১০টার দিকে বরিশাল ক্লাবে দলীয় বৈঠক শেষে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হিরণ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মেঝেতে পরে গিয়ে তার মস্তিস্কে রক্তক্ষরন হয়। তাৎক্ষণিক তাকে শেবাচিম ও পরে ওইদিন রাতেই ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার মস্তিস্কে ‘ডিকমপ্রেসিভ ক্রানেকটমি’ নামে একটি অস্ত্রোপাচার করা হয়। পরে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছরের ২৪ মার্চ রাতে সাংসদ হিরণকে থাই এয়ার এ্যাম্বুলেন্সযোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেখানে ২৫মার্চ তার মাথায় আরো একটি অস্ত্রোপাচার করা হয়। এরপর বিপদের শঙ্কা কিছুটা কেটে গেলে পরে তাকে মাউন্ট এলিজাবেথ থেকে গ্লেনঈগলস হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘদিনেও হিরণের জ্ঞান ফিরে না আসায় চিকিৎসকেরা লাইফ সার্পোট খুলতে চাইলেও সাংসদ হিরণের একমাত্র কন্যা রোশনী হোসেন তৃষা লাইফ সাপোর্ট চালিয়ে নেয়ার পক্ষে ছিলেন। যে কারনে আমৃত্যু পর্যন্ত লাইফ সার্পোটে সজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন এমপি হিরণ। সিঙ্গাপুর থেকে ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল গভীররাতে হিরণকে (স্থায়ীভাবে বোধশক্তিহীন অবস্থায়) দেশে ফিরিয়ে এনে পুনরায় ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে লাইফ সার্পোট দিয়ে রাখা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ এপ্রিল সকালে হিরণ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে হিরণ স্ত্রী, ১ পুত্র ও ১ কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।
হিরণের মৃত্যুর পর বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনতা গভীর শোকে বিমূর হয়ে পরেছিলেন। স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো গোটা নগরীর কর্মচাঞ্চল্য। ১১ এপ্রিল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে মুকুটহীন এ সম্রাটের নামাজে জানাজা শেষে মুসলিম গোরস্তানে মায়ের কবরের পার্শ্বে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বরিশাল জেলা জাতীয় পার্টির সাধারন সম্পাদক অধ্যাপক মহসিন-উল ইসলাম হাবুল, সাংস্কৃতিক কর্মী শুভঙ্কর চক্রবর্তী পৃথক প্রতিক্রিয়ায় জানান, হিরণ কীংবদন্তী হয়ে থাকবেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মনে। তার সহঅবস্থানের রাজনীতি ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড মানুষের কাছে উপমা হয়ে ফিরবে যুগ থেকে যুগান্তর।
বরিশাল মহানগর আ’লীগের সাধারন সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজালুল করীম জানান, বরিশালবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ও জনপ্রিয় নেতা শওকত হোসেন হিরণের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিরণের শূণ্য আসনে তারই সহধর্মীনি জেবুন্নেছা আফরোজকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। হিরণের ভালবাসায় বরিশালবাসী ২০১৪ সালের ১৫ জুনের উপ-নির্বাচনে জেবুন্নেছা আফরোজকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করেছেন। তিনি আরো জানান, যথাযোগ্য মর্যাদায় জনপ্রিয় নেতা মরহুম শওকত হোসেন হিরণের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের লক্ষ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুই দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ৯ এপ্রিল ভোর ছয়টায় সদর রোডের শহীদ সোহেল চত্ত্বর সংলগ্ন আ’লীগের দলীয় কার্যালয়ে কালোপতাকা উত্তোলন এবং দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, মহানগর ও তাদের আওতাভুক্ত ওয়ার্ড আ’লীগের নেতাকর্মীদের কালো ব্যাচ ধারন, সকাল ৯টায় মুসলিম গোরস্তানে মরহুমের কবর জিয়ারত ও ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন। পাশাপাশি সকাল থেকে দিনব্যাপি দলীয় কার্যালয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, বাদ মাগরিব দলীয় কার্যালয়ে স্মরণ সভা ও মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া-মিলাদ। দলীয় কার্যালয় ছাড়াও নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি মসজিদে ৯ এপ্রিল তিন বার কোরআন খতম ও বাদ আসর দোয়া-মিলাদ। ১০ এপ্রিল শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া-মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।
অপরদিকে নগরীর রাজনৈতিক অঙ্গনে সহাবস্থান সৃষ্টি করা প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে বিএনপি নেতা ও বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আহসান হাবীব কামালের উদ্যোগে ৯ এপ্রিল দিনভর ব্যাপক কর্মসূচী পালনের ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে নগর ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, দিনভর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, দুপুরে স্মরণ সভা ও দোয়া-মিলাদ। শওকত হোসেন হিরণের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীকে ঘিরে গত এক সপ্তাহ জুড়ে গোটা নগর জুড়ে চলছে মৃত্যুবার্ষিকী পালনে নানা প্রস্তুতি। নগরী ছেয়ে গেছে চিরমলীণ কালো কাপড়ে মোড়া ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড ও একাধিক তোরনে। এসব বিলবোর্ডগুলোতে শোভা পেয়েছে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের চিত্র ও প্রয়াতের স্মৃতি বিজড়িত নানা ছবি। দলীয় ও পারিবারিক ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের নানা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে।

(টিবি/পিবি/ এপ্রিল ০৯,২০১৫)


পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test