E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা দিবস আজ

২০১৫ এপ্রিল ২১ ১১:০৮:৫৯
ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা দিবস আজ

ফরিদপুর প্রতিনিধি: ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল। ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন আশ্রমে ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জঘন্যতম নারকীয় গণহত্যার একটি। পাকিস্তানি সেনারা আশ্রমে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছিল কীর্তনরত ৮ সাধুকে।

শ্রী অঙ্গন প্রভু জগদ্বন্ধু ব্রহ্মচারী আশ্রমের এ গণহত্যা ছিল ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম গণহত্যার ঘটনা। গৃহত্যাগী আট সন্ন্যাসী হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের প্রথম শহীদ।

আজ মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে পালিত হতে যাচ্ছে নারকীয় সেই গণহত্যার ৪৪তম বার্ষিকী।

আশ্রমে থাকা নয়জনের মধ্যে সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান সেবায়েত হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী। ঘাতকদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমানে ৮২ বছরের এই সাধু।

হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে, আমার চোখের সামনেই গুলি করে মারলো ৮ জন সংসারত্যাগী সন্যাসীকে। ব্রাউনিয়া ফুল গাছ আর জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে বেঁচে গেলাম। আমরা তো কারো ক্ষতি করি না, কারো অকল্যাণ করি না। আমাদের হত্যা করলো কেন ওরা?

ফরিদপুর শহরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনে সেদিন পাকিস্তানি সেনারা কীর্তনরত অবস্থায় যে ৮ সন্ন্যাসীকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে সেই শহীদেরা হচ্ছেন, কীর্তনব্রত ব্রহ্মচারী, নিদানবন্ধু ব্রহ্মচারী, অন্ধকানাই ব্রহ্মচারী, বন্ধুদাস ব্রহ্মচারী, ক্ষিতিবন্ধু ব্রহ্মচারী, গৌঢ়বন্ধু ব্রহ্মচারী, চিরবন্ধু ব্রহ্মচারী ও রবিবন্ধু ব্রম্মচারী। মুক্তিযুদ্ধের পর শ্রী অঙ্গন মন্দিরের চালতে তলার নিচে ৮ শহীদ সাধুর স্মরণে ৮টি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।


মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একমাস পর গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ফরিদপুরে ঢোকে পাকিস্তানি সেনারা। তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে ফরিদপুরে নিয়ে এসে সেনাক্যাম্প আর রাজাকার ক্যাম্প গড়ে দেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা।

ফরিদপুরে পাকিস্তানি সেনা আসছে এ খবর পেয়ে প্রভু জগদ্বন্ধুর ভাবশিষ্য মহানাম সম্প্রদায় প্রধান মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ও অন্য সাধু-সন্ন্যাসীরা হামলার নির্ধারিত দিন ২১ এপ্রিল একাত্তরের আগেই শ্রীঅঙ্গন থেকে সরে যান।

কিন্তু আশ্রমে থেকে যান নয় সাধু। মানবমুক্তির মহাকল্যাণকামী এ নয়জনের আটজনই মা মাটি মাতৃভূমি আর স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও শ্রীঅঙ্গনের সাধুরা জানান, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা ২১ এপ্রিল ভোরে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই শহরের দিকে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করতে থাকে একের পর এক। সন্ধ্যার পরে শহরে ঢুকে প্রথমেই গোয়ালচামট শ্রীঅঙ্গনে মহানাম সম্প্রদায়ের ৮ সাধুকে কীর্তনরত অবস্থায় হত্যা করে। গৃহত্যাগী এ ৮ সন্ন্যাসীই হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের প্রথম শহীদ।

শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন আশ্রমের বর্তমান প্রধান মহানাম সম্প্রদায়ের সভাপতি শ্রীমৎ কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী জানান, সেদিন পাকিস্তানি সেনারা কীর্তনরত সাধুদের হুকুম দিয়ে বলে, ‘বাহার মে আও’। কিন্তু সাধুরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কীর্তন চালিয়ে যান। মানুষরূপী হায়েনার দল প্রথমে মন্দিরে ঢুকে কীর্তনরত নয় সাধুকে বের করে মন্দিরের পাশে চালতা তলায় নিয়ে আসে।

এ সময় পেছন দিক থেকে সাধু হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী সিঁড়ি কোঠায় ও পরে আশ্রমের ব্রাউনিয়া ফুলগাছের জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এরপর মাঠে নিয়ে ৮ সাধুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। সাধুরা তখনও একমনে ‘জয় জগদ্বন্ধু’ জপছিলেন।

তিনি আরো জানান, পরদিন ২২ এপ্রিল ভোরে ফরিদপুর মিউনিসিপ্যালটির ট্রাক এসে শহীদদের মরদেগুলো নিয়ে যায়। এ দিন পাকিস্তানি সেনারা দাঁড়িয়ে থেকে শ্রীঅঙ্গনে বিহারি ও রাজাকারদের দিয়ে লুটপাট চালায়। ২৬ এপ্রিল ডিনামাইট দিয়ে শ্রীঅঙ্গনের মূল ভবনের একাংশ ও মন্দিরের চূড়া ধ্বংস করে দেয় তারা।

অলৌকিকভাবে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী বলেন, সেদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে (২১ এপ্রিল) নিত্যদিনের মতো নামকীর্তন করছিলাম আমরা নয়জন সাধু। হঠাৎ হামলা, কামান আর গোলাগুলির শব্দ। আমরা তারপরও কীর্তন বন্ধ করিনি, এ যে এক মুহূর্তের জন্যও থামানোর নয়। তারপর সেনারা ঢুকলো আমাদের কীর্তনের আশ্রমঘরে। তাদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালি, কয়েকজন বিহারি। আমি ঘরের থামের (সিঁড়ি কোঠা) আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। সেখান থেকে পেছনমুখো হয়ে পা টিপে টিপে কয়েক গজ পিছিয়ে লুকিয়ে পড়লাম ফুলগাছের (ব্রাউনিয়া) জঙ্গলের আড়ালে।

চোখের সামনে দেখলাম, লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে মেলেটারিরা খুন করলো আটজন প্রভুর ভক্তকে। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম রে বাবা। প্রাণের ভয়ে তারপরও চেচামেচি করিনি, যদি শব্দ শুনে মেরে ফেলে। তারপর ওরা মৃতদেহগুলো টেনে নিয়ে ফেললো চালতা তলায় (এখন যেখানে সাধুদের সমাধি)। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ। রক্তের আঁচড় ছড়িয়ে রইলো। এরপর ওরা আশ্রমে লুট করে চলে গেলো।

জীবন সায়াহ্নে চলে আসা এই গৃহত্যাগী সন্যাসী বয়সের ভারে কথা ঠিকমতো বলতে পারেন না। কথাবার্তা জড়িয়ে যায়, স্মৃতিভ্রষ্টতা এসে ভর করে মাঝে মাঝেই। জীবনের শেষ মুহূর্তে তার শেষ চাওয়া রাজাকারদের বিচারের মাধ্যমে ৮ শহীদ সাধু-ব্রহ্মচারীর আত্মার শান্তি দেওয়া হোক।

এই আশ্রমবাসীর মতোই একই চাওয়া সকল ভক্তেরও।


(এসডি/এসসি/এপ্রিল২১,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test