E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ ২৫ এপ্রিল:বরিশালে প্রথম পাক হানাদার প্রতিরোধ দিবস

২০১৫ এপ্রিল ২৫ ১১:৫৪:৫৭
আজ ২৫ এপ্রিল:বরিশালে প্রথম পাক হানাদার প্রতিরোধ দিবস

আঞ্চলিক প্রতিনিধি(বরিশাল):বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেও আর চাকুরিতে ফিরে যাওয়া হয়নি। দেশ মাতৃকার টানে সেদিন যোগদিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। জীবন বাঁজি রেখে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলাম সবুজে রক্তে লাল বিজয় পতাকা।

জীবনের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধেই হারিয়েছি সহযোদ্ধা চার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। সেইদিনের স্মৃতি আজো পীড়া দেয়। আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অবঃ) আব্দুর রাজ্জাক চোকদার।

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে সড়ক পথে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্থ হয়েছিলো পাক সেনারা। সেদিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে পাকসেনারা দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বর্তমান আগৈলঝাড়া তৎকালীন গৌরনদী উপজেলার সাউদেরখালপাড়ে (কটকস্থল) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। ওইদিন সম্মুখযুদ্ধে সাত জন পাক সেনা নিহত ও মুক্তিবাহিনীর চারজন বীর সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। দিনটিকে স্মরণ করতে পালিত হয়ে আসছে ২৫ এপ্রিল প্রতিরোধ দিবস। সেইদিনের রণাঙ্গন কাঁপানো বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অবঃ) আব্দুর রাজ্জাক চোকদার পাক সেনাদের সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধের বর্ননা দিতে গিয়ে বলেন জীবনে এমন একটি সুযোগ তৈরী হবে ভাবতেই পারিনি। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে যোগদান করে চাকুরির সুবাধে পাকিস্তানেই বসবাস শুরু করেছিলাম। ১৯৭১ সালে ছুটিতে দেশে আসার কিছুদিন পরেই শুরু হয় স্বাধীনতার মুক্তি সংগ্রাম। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে এলাকার যুব সমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করার লক্ষে আর চাকুরীতে ফিরে যাওয়া হয়নি। তখন আমাদের এলাকায় ছুটিতে থাকা তৎকালীন সেনা সদস্যরা একত্রিত হয়ে সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আমিসহ বন্ধু সুবেদার গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আবুল হাসেম, সৈয়দ অলিউল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স, আব্দুল হাকিম, মোসলেম উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই স্থানীয় এমপি (চাঁদশী গ্রামের) এ্যাডভোকেট করিম সরদারের সাথে দেখা করেছিলাম। তখন তিনি (এমপি) তৎকালীন সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনা ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যদেরকে নিয়ে প্লাটুন তৈরি করে বেসামরিক লোকদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করার জন্য। তখন তিনি (এমপি করিম সরদার) আমাদের ছয়টি থ্রী নট থ্রী রাইফেল, দুটি দোনালা বন্দুক ও কিছু গুলি দিয়েছিলেন। এরপর আমরা গৌরনদী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হরলাল গাঙ্গুলির বাড়ির পূর্বপাশের কলেজ ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে বেসামরিক যুবকদের শসস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি।

এরইমধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল সকাল ১০ টার দিকে আকস্মিকভাবে তৎকালীন এমপি এ্যাডভোকেট আব্দুর করিম সরদার আমাদের ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে পুরো প্লাটুন নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ভুরঘাটার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। তাৎক্ষনিক বেসামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্লাটুন অন্তুর্ভুক্ত করে তিনটি সেকশনে ভাগ হয়ে ভুরঘাটার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথিমধ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সাউদেরখালপাড় (কটকস্থল) নামকস্থানে পৌঁছলে আমরা দেখতে পাই পাক হানাদার বাহিনী কনবাই নিয়ে বরিশালে প্রবেশ করছে। এটা দেখামাত্রই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মহাসড়কের দু’পাশে অ্যামবুশ (যুদ্ধ প্রস্তুতি) নেই। পাকসেনাদের কনভয় গাড়ির চাকার ওপর গুলিবর্ষন করার পর পাক সেনারা আমাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ওইদিন সাতজন পাক সেনা আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) হাতে নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানীরা ক্ষিপ্ত হয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। ফলশ্র“তিতে ভাগ্যক্রমে আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘটনাস্থলেই শহিদ হন আমাদের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাঠৈর সৈয়দ আবুল হাসেম, বাটাজোরের মোক্তার হোসেন, গৈলার আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও চাঁদশীর পরিমল মন্ডল। এটাইছিলো সড়ক পথে দক্ষিণাঞ্চলে পাক সেনাদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ ও এরাই হচ্ছেন সম্মুখ যুদ্ধের প্রথম চার শহীদ।

সম্মুখ যুদ্ধে নিহত চারজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ তিনদিন পর অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে শহীদ সৈয়দ আবুল হাসেম, আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও পরিমল মন্ডলের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেও শহীদ মোক্তার হোসেনের লাশটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। যে কারনে শহীদ মোক্তার হোসেনকে উত্তর ধানডোবা গ্রামের ফকির বাড়িতে দাফন করা হয়। বর্তমানে শহীদ সিপাহী মোক্তার হোসেনের ছেলে আক্তার হোসেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

আক্ষেপ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. রইচ সেরনিয়াবাত বলেন, প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল আসলেই আমরা ছুঁটে যাই সেইদিনের ঘটনাস্থল সাউদেরখালপাড়ে। কিন্তু আজো ঘটনাস্থলে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যথিত হতে হয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও দক্ষিণাঞ্চলের সর্বপ্রথম সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনাস্থল (সাউদেরখালপাড়ে) আজো নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। এখনও দুইজন শহীদের সমাধী রয়ে গেছে অরক্ষিত। দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম প্রতিরোধ দিবসে সরকারি ভাবে এখানে পালন করা হয়না কোন কর্মসূচী। যেকারনে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সাউদেরখালপাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবের ইতিহাস (২৫ এপ্রিল) সর্ম্পকে কোন ধারনা-ই নেই। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষ্যে সাউদেরখালপাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সাউদেরখালপাড়ে শহীদ চার মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান, চার শহীদ পরিবারকে তাদের স্বীকৃতিসহ তাদের (চার শহিদের) নামে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।

(টিবি/এসসি/এপ্রিল২৫,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test