E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পাঁচ বছরে বাঘ কমছে ৩৪৪টি, ‘বিলুপ্তপ্রায়’ রয়েল বেঙ্গল টাইগার

২০১৫ জুলাই ২৮ ১৮:২৭:২৫
পাঁচ বছরে বাঘ কমছে ৩৪৪টি, ‘বিলুপ্তপ্রায়’ রয়েল বেঙ্গল টাইগার

বাগেরহাট প্রতিনিধি  : আমাদের সুন্দরবন থেকে মাত্র পাঁচ বছরে ‘হারিয়ে গেছে’ ৩৪৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যেখানে ২০১০ সালে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাষ্ট অব বাংলাদেশ সুন্দরবনে ৪০০-৪৫০টি বাঘ রয়েছে বলে যৌথ জরিপে উল্লেখ করেছিলো সেখানে ক্যামেরা পদ্ধতিতে চলতি মাসে সর্বশেষ বাঘ গণনা জরিপে উঠে এসেছে গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ঙ্কর চিত্র।

২০১৫ বাঘ গণনা জরিপে সুন্দরবনে খোঁজ মিলেছে মাত্র ১০৬টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। অস্তিত্ব সংকটে থেকে ক্রমাগত বিলুপ্তির দিকে যখন সুন্দরবনের বাঘ এমনই প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোসহ সরকারি ও বিভিন্ন পরিবেশবাদি সংগঠন সভা,সমাবেশ,র‌্যালীসহ নানান কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করছে।

বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ টিকে আছে এমন ১৩টি দেশে এই দিনটি বিশ্ব বাঘ দিবস হিসাবে পালন করে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস হিসাব পালন হলেও গত বছর বাংলাদেশে ওই দিন ঈদ থাকায় ৭আগস্ট বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়। রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ শহরে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুন করার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারনে অন্যতম স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে কমছে বাঘের সংখ্যা।

সুন্দরবন বিভাগের হিসেবে, গত ১৬ বছরে চোরা শিকারী, লোকালয়ের ক্ষুব্দ জনতাসহ বিভিন্ন অপঘাতে মারা গেছে সুন্দরবনের ৫২টি রয়ের বেঙ্গল টাইগার। পরিবেশবিদদের হিসেব মতে ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত ৩০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ১৬টি বাগেরহাটের পূবর্ সুন্দরবনে আর ১৪টি পশ্চিম বিভাগে মারা য়ায। গত দেড় র‌্যাব সদস্যরা চোরা শিকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে ৬টি বাঘের চামড়া, মাতার খুলীসহ বিপুল পরিমান বাঘের হাড়। সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের হিসেবে সুন্দরবনে গত ১৪ মাসে চোরা মিকারীদের হাতে মারা গেছে ১০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ৮০টি অধিক হরিণ। বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদন্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার বিধান করলেও ঠেকানো যাচ্ছেনা চোরা শিকারীদের বন্যপ্রানী হত্যা।

মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সিমান্তের আন্তর্জাতিক চোর বাজার ‘গোল্ডেন ট্রাঙ্গলে’ এক-একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় চোরাশিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। স্থানীয় সূেত্র জানাগেছে, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়।

বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, গুলি করে বাঘ হত্যা করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার করে। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশের চোরা বাজারে একটি বাঘের চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
সুন্দরবনের বন্যপ্রানী ও জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করা ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’ চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, এতোদিন আমরা সুন্দরবনে আশঙ্কাজনক হারে বাঘ শিকার বাড়ছে বলে জানালেও বন বিভাগ তাতে গুরুত্ব দেয়নি। সর্বশেষ সুন্দরবনে জরিপে বাঘের সংখ্যা কমে আসার প্রমান মিলেছে। এই বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে বাঘের প্রকৃত আবাস বলতে বোঝায় বাংলাদেশের ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনকে। সুন্দরবনে বর্তমানে উজানে মিটা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবনের পরিমান বেড়েই চলেছে। মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেল ছাড়াও সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে বর্তমানে ভারতে বাগেরহাটের পর্ব সুন্দরবনের শ্যালা ও সাতক্ষীরার পশ্চিম সুন্দরবনের আন্টিহারা দিয়ে দু’টি নৌপ্রটোকল রুট চালু থাকায় এই ম্যানগ্রোভ বনটি কার্যত চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। চোরা শিকারীদের তৎপরতা বৃদ্ধি, জাহাজ ও র্কাগোর হর্ণসহ ভেসেলগুলোর বিকট শব্দ, একের পর এক র্কাগো ডুবিতে সুন্দরবন দূষন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, আশঙ্কাজনক হারে মানুষের উপস্থিতি, লবন পানির আধিক্য, বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় কারনে এখন করুন অবস্থা সুন্দরবনের প্রকৃত পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। একদিকে তাপমাত্র হেরফেরে মৌসুমি বায়ু নিদিষ্ট সময়ে সক্রিয় না হয়ে সময় মতো পরিমিত বৃষ্টি না হওয়া। আবার কখনও কখনও অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে পরিমানের চেয়ে ঢের বেশি যার প্রভাবে সুন্দরবনের গাছ মরছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। আবার সুপার সাইক্লোন সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভেতর প্রবেশ করে আর বের হতে পারছে না। এতে বনের মিষ্টিপানির পুকুরগুলো লোনা পানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টি পানির আশায় লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে মানুষের অবাধ বিচারন, বন উজাড়, বাঘের আবাসস্থল সংকটসহ নানা কারনে বাঘের প্রজনন প্রকৃতিক পরিবেশ হারাচ্ছে। বাঘের স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এসব কারনে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে।
বাঘকে রক্ষা ও বংশ বৃদ্ধি করতে তিনি সুপারিশ আকারে বলেন, বাঘ বনের যেখানে থাকতে পছন্দ করে সেখানে বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। কয়েকটি এলাকাকে অভায়শ্রম ঘোষনা করতে হবে। সঠিক ভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজণীয় লজিষ্টিক সার্পোট থাকতে হবে। এছাড়া মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাহলে বাঘের বংশ বৃদ্ধি সম্ভব বলে তিনি দাবী করেন। অতীতে বাঘ গণনায় নানা গোজামিল ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, গঙ্গা অববাহিকার যে মিষ্টি জল গড়াই ধরে সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ত তা ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারনে আবশ্যিক সময়ে না পাওয়ায় লবনের মাত্রা হঠৎ করে বেড়ে গিয়ে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে বনের জীববৈচিত্র্যে। যার প্রভাবে গাছপালা, তরুলতা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি,জলজসহ অন্যান্য বন্যপ্রানী ও সুন্দরবনের পাহারাদার প্রকৃত পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জীবনযাত্রা হুমকিতে পড়েছে। সরকার আবার সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে বিশাল কয়লা ভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ নির্মান করা হচ্ছে। এতে করে আমাদের গর্ভ সুন্দরবনের বাঘ ‘বিলুপ্তপ্রায়’ তালিকা থেকে দ্রুত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে। সুন্দরবনে বাঘের বিলুপ্ত ঠেকাতে রাশিয়ায় প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে নেয়া সিদ্ধান্ত সমুহ দ্রুত বাস্তবায়নে তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান ।
তবে, সুন্দরবনে আশঙ্কাজনক হারে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার তথ্য মানতে নারাজ বন বিভাগ। তারা বলছেন, বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাষ্ট অব বাংলাদেশ যৌথ ভাবে ২০১০ সালে সুন্দরবনে বাঘের বিচারন ও পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে পরিচালিত জরিপটি বিজ্ঞান সম্মত ও আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় বাঘের সংখ্যাটিও সঠিক ছিল না। সর্বশেষ বাঘ গণনা জরিপের প্রধান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুর কবীর বলেন, এবারে সুন্দরবনে বাঘ গণান জরিপটি বিজ্ঞান সম্মত ও আন্তর্জাতিক মানের। তাই জরিপে সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘের সঠিক চিত্র উঠে এসেছে। এখন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে দ্রুত কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে।


(একে/এসসি/জুলাই ২৮, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test