E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

প্রজনন মৌসুমেও চলছে কাঁকড়া নিধনের মহোৎসব

২০১৬ জানুয়ারি ২৩ ১৮:০০:১৪
প্রজনন মৌসুমেও চলছে কাঁকড়া নিধনের মহোৎসব

বাগেরহাট প্রতিনিধি : সুন্দরবনে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া শিকারের মহোৎসব চলছে। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মণ মা শিলা কাঁকড়া অবাঁধে আহরন করা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ এই বন থেকে। এভাবে প্রজননকালীন শিলা কাঁকড়া শিকার চলতে থাকলে চিংড়ির চেয়েও অর্থনৈতিক ভাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই সম্পদ অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন শিলা কাঁকড়া খামরিরা।

সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম মৎস্য সম্পদ শিলা কাঁকড়ার প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র। এখান থেকে ছোট শিলা কাঁকড়া আহরন করে কাঁকড়া খামারে তা বড় করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হয়ে থাকে। শিলা কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হচ্ছে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি এই দুই মাস। প্রজনন মৌসুমে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের লোনা পানিতে এরা ডিম ছাড়ে থাকে। আর মাঘ মাসের প্রথম অমাবস্যায় সবচেয়ে বেশি ডিম দিয়ে থাকে স্ত্রী এই শিলা কাঁকড়া।

শিলা কাঁকড়া খামারীরা জানান, এই প্রজনন মৌসুমে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিদেশীদের এসব উৎসবের খাদ্য তালিকায় থাকে ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়ার।

এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি এবং এ সময় দামও থাকে সর্বোচ্চ। তাই বেশি দামের আশায় এবং সুন্দরবন এলাকায় প্রজননকালীন এই কাঁকড়া শিকারে কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ থাকলেও বাসাতবে দেখার কেউ নেই। ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়ার শিকার বন্ধে উদ্যোগ না থাকার ফলে সুন্দরবনে এখন চলছে ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া শিকারের মহোৎসব। প্রজননকালীন এই কাঁকড়া শিকারে কারেন্ট, বেহুন্দিসহ ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ শিকার করার সময় পিল (রেণু) কাঁকড়া ধরা পড়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসহ নানা কারণে উপকূলের জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক পরিবেশও ব্যাহত হচ্ছে।

এসব কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক ভাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় সম্পদ এই শিলা কাঁকড়া। এভাবে প্রজনন মৌসুমেও ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া শিকারের ফলে বাগেরহাটসহ উপকূলের শিলা কাঁকড়ার শত-শত খামারে পিল (রেণু) কাঁকড়ার সংকট প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। ফলে খামারগুলোতে পিল (রেণু) কাঁকড়ার সংকট থাকায় রপ্তানী বানিজ্যেও এর প্রভাব পড়ছে।

কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা জানান, চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ার চাষ সহজ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ও চাহিদাও বেশি। চিংড়ির চাষে নানা ধরনের রোগ-বালাই লেগেই থাকে। অপরদিকে কাঁকড়ার তেমন রোগ-বালাই নেই বললেই চলে। এছাড়া চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া চাষে ব্যয়ও কম। প্রাকৃতিকভাবে পিল কাঁকড়া ২-৩ মাসের মধ্যে ১৮০ গ্রাম ওজনের গ্রেড হয়। যার স্থানীয় বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৫-৬শ’ টাকা। একারনে প্রতি বছরই চিংড়ি খামারীরা শিলা কাঁকড়ার খামার গড়ে তুলছেন।

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় সরেজমিনে গুরে দেখাগেছে, শত শত লোক সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া শিকার করছে। মংলার জয়মনিরঘোল এলাকার কাঁকড়া শিকারি প্রফুল্ল মিস্ত্রী (৫৪) ও তার ছেলে প্রকাশ মিস্ত্রী (২০) জানান, তারা জাল পেতে প্রতিদিন ৫-৭ কেজি ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া পান। ২টি কাঁকড়ায় এক কেজি হয় এবং প্রতি কেজি ছয় থেকে ৮শ’ টাকায় বিক্রি করেন। এখন কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ছে এবং দামের দিক দিয়েও ভালো বলেও জানান।

সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণকারী জেলে আজিজুর রহমান (৩৫), স্বপন মন্ডল (৩০) ও মহসীন আলম (৪৫) জানান, বর্তমানে সরকারীভাবে কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ থাকার কারণে তারা মাছের পাশ নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে শিলা কাঁকড়া শিকার করছে। স্থানীয় কাঁকড়ার আড়ৎদাররা জানান, এখন ডিমওয়ালা কাঁকড়া পাওয়া যায় বলে ঢাকার আড়তে এসব কাঁকড়ার বেশ চাহিদা রয়েছে এবং দামের দিক দিয়েও ভালো। অন্য সময় ডিমওয়ালা কাঁকড়া পাওয়া যায় না বলে তেমন চাহিদা থাকে না।

মংলাসহ আশপাশ এলাকার অর্ধ শতাধিক আড়ৎদার প্রতিদিন কয়েকশ’ মণ ডিমওয়ালা কাঁকড়া ঢাকায় পাঠান বলেও জানান। গত ৩ সপ্তাহ ধরে মংলার মাছ বাজারে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সেখানে ঝুড়িতে করে বিপুল পরিমান ডিমওয়ালা শিরা কাঁকড়া বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রেতাদের সাথে কথা বললে তারা জানান, সুন্দরবনের অভ্যন্তরের মাছ ধরা জেলেদের কাছ থেকে তারা এ কাঁকড়া কিনে এনে বিক্রি করছেন। তারা আরো জানান, সুন্দরবন বিভাগের অসাধু বনকর্মীদের উৎকোচ দিয়ে জেলেরা মাছের পাশাপাশি ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া আহরন করছেন।

পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, বছর শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ার রপ্তানী মূল্য ও চাহিদা কয়েক গুন বেশী থাকে।

চিংড়ির চেয়েও অর্থনৈতিক ভাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই সম্পদটি লালনে এখনই জরুরী পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন। এজন্য শিলা কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুমে শিকার বন্ধ ও মূল্যবান এই মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অভায়আশ্রম ও আইনি পদক্ষেপসহ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন জরুরী হয়ে পড়েছে। এটা করতে পারলেই আমাদের রপ্তানী বানিজ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই সম্পদটিতে সাফল্য আসবে।

মংলা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, ম্যানগ্রোভ অঞ্চল শিলা কাঁকড়ার প্রজনন ক্ষেত্র হলেও শুধু সুন্দরবন এলাকায় প্রজননকালীন শিকার নিষিদ্ধে আইন রয়েছে। সুন্দরবনের দেখবাল করার দায়িত্ব একমাত্র সুন্দরবন বিভার্গে। তারা দায়িত্ব পালন না করলে আমাদের করণীয় কিছু নেই।

এছাড়া প্রজননকালীন রপ্তানী পন্য শিলা কাঁকড়া শিকার বন্ধে তেমন কোন নির্দেশনা না থাকায় মৎস্য বিভাগ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না। এখন সময় এসেছে অর্থনৈতিক ভাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই সম্পদটিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন দেশের গোটা উপকূল জুড়ে প্রজনন মৌসূমে শিলা কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধের আইন করার।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জানান, প্রজনন মৌসুমকে ঘিরে সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরনের পাস-পারমিট বন্ধ রয়েছে। তবে চোরাই পথে কাঁকড়া আহরনের প্রবনতা বন্ধে সুন্দরবন বিভাগের টহল ও নজরদারীও বাড়নো হয়েছে। তিনি আরো জানান, শুধু মাত্র সুন্দরবনের নদ-নদীতে প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া আহরন নিষিদ্ধ থাকলেও লোকালয়ের জলাভুমিতে এ আইন কার্যকর না থাকায় তেমন কোন সফলতা আসছে না।

(একে/এএস/জানুয়ারি ২৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test