E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

 “নিভে গেল স্বপ্নের প্রদীপ”

কলাপাড়ায় নিখোঁজের সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর উদ্ধার ছাত্রের লাশ

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১০ ২১:১২:৫৬
কলাপাড়ায় নিখোঁজের সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর উদ্ধার ছাত্রের লাশ

কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : ও তো মাত্র সাড়ে চার বছরের। কি এমন শত্রুতা এই দুধের বাচ্চার সাথে। মানুষের মধ্যে কি কোন বিবেক নাই, এই ঠাণ্ডার মধ্যে কারা ওরে মাইর‌্যা পুকুর পাড়ে ফালাইয়া রাখলো। অরা কি মানুষ? মঙ্গলবার রাত থেকে সন্তান হারিয়ে এভাবেই বিলাপ করে চলছে মাহিয়ান তাসিনের মা খাদিজা বেগম।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরের রহমতপুর এলাকা থেকে গত মঙ্গলবার সন্ধায় নিখোঁজ হয় অ্যালফাবেট কিন্ডার গার্টেনের প্লে গ্রুপের ছাত্র মাহিয়ান তাসিন (সাড়ে ৪ বছর)। তাসিনের সন্ধানে পৌরশহরে মাইকিং করা হয়। আত্মীয়স্বজনসহ শতশত মানুষ তার সন্ধানে বের হয়। রাত সাড়ে ১০টায় বাসা থেকে মাত্র একশ ফুট দূরে পুকুর পাড়ে পাওয়া যায় তাসিনের নিথর দেহ। তার লাশটি উপর হয়ে পড়েছিলো। তাকে শ্বাষরোধ করে হত্যা করায় মুখ-নাক থেকে ফ্যানা বের হচ্ছিলো। গালে, নাকে ও গলায় নকের আচড়ের চিহ্ন, যা থেকে রক্ত বের হচ্ছিলো। তাসিনকে উদ্ধারের পর তাৎক্ষণিক তাকে কলাপাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিখোঁজ হওয়ার সাড়ে পাঁচ ঘন্টা তার লাশ উদ্ধারের খবর শুনে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে তার বাসায়। এ সময় একহৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণ হয়। খবর পেয়ে রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। বুধবার সকালে তাসিনের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পটুয়াখালী মর্গে প্রেরণ করা হয়। এদিকে তাসিন হত্যার ঘটনায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে অ্যালফাবেট কিন্ডার গার্টেন ছুটি ঘোষণা করা হয়।

বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এখনও সেই রকমই সাজানো তাসিনের সেই নরম বিছানা। খাটের উপর এলোমেলো তার বই-খাতা ও শীতের জামা। টেবিলের উপরে রাখা বিস্কুটের প্যাকেটটিও সেভাবে পড়ে আছে। একটু পরই সন্ধা হবে তাই আদরের সন্তানের জন্য সবকিছুই গুছিয়ে রেখেছিলো মা। কিন্তু তাসিন না ফেরার দেশে চলে যাওয়ায় ওই বিছানা সেভাবেই পড়ে আছে।

যেভাবে নিখোঁজ হয় তাসিনঃ

কলাপাড়া পৌর শহরের বীমাকর্মী গাজী মজিবুর রহমান ও শিক্ষিকা খাদিজা বেগমের প্রথম সন্তান মাহিয়ান তাসিন। তাদের ছোঁয়া নামের সাড়ে চার মাসের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে ঘুম থেকে উঠে তার বয়সী বন্ধুদের সাথে খেলতে বের হয় তাসিন। কিন্তু সেটাই তাসিনের শেষ যাওয়া। তার পিতা গাজী মজিবুর রহমান জানান, বিয়ের দীর্ঘ ১৩ বছর পর তাসিনের জন্ম। ও ছিলো তাদের প্রথম স্বপ্ন। তার সেই স্বপ্নের প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ভেবেছিলেন হয়তো কারো সাথে ঘুরতে বের হয়েছে তাসিন। কিন্তু সন্ধা গড়িয়ে যখন রাত নেমে আসে তখনও ফিরে না আসায় গোটা কলাপাড়ায় মাইকিং করেন। এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা, প্রতিটি ঘর খোঁজা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। যে পুকুর পাড়ে তাসিনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে সেখানেও তারা খুঁজেছিলেন। কিন্তু কখন,কিভাবে ঘাতকেরা তাকে সুযোগ বুঝে ওই স্থানে ফেলে রেখে গেছে তা বুঝতে পারছেন না।

ঘটনাস্থলঃ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পৌরশহরের রহমতপুর এলাকার তাসিনদের বাসা। আশেপাশে আরও ৬টি পরিবার। তাদের বাসা থেকে মাত্র একশ ফুট দূরে ওই পুকুর। প্রতিবেশী ছত্তার ফকিরের ওই পুকুরের চারপাশে প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার টিনের বেড়া। যে টিনের বেড়া বেয়ে বড়দের উঠতেও কষ্ট হয়,সেই বেড়ার ভিতরে পুকুর পাড়ে উপর হয়ে পড়েছিলো তাসিন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাঃ স্থানীয় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ও এসহাক খলিফা বলেন, রাতে তাসিনের খোঁজে এলাকার তিনটি পুকুরে জাল টানা হয়েছে। তারা ভেবেছিলেন হয়তো পুকুরে পড়ে যেতে পারে। কলাপাড়াসহ পাশ্ববর্তী তালতলী ও আমতলী এলাকায় খোঁজা হয়েছিলো লোক পাঠিয়ে। কিন্তু রাত সাড়ে ১০ টায় প্রতিবেশী একজন ওই পুকুর পাড়ে তাসিনের লাশ পড়ে থাকতে দেখে। অথচ ওই জায়গা একাধিকবার খোঁজা হয়েছিলো।

এদিকে সন্তান হারিয়ে বিলাপ করতে করতে একটু পরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে খাদিজা বেগম। ছোট্র তাসিনের মৃত্যুসংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বুধবার ভোর থেকে হাজার হাজার মানুষ ও তাসিনের সহপাঠীরা তাদের বাসায় ভীড় করে। এ সময় তাসিনের সহপাঠীদের বুকে টেনে বিলাপ করতে থাকে সে“ তোমাদের লগে আর স্কুলে যাইবে না তাসিন। আর খেরার বায়না করবে না। খাওয়া নিয়ে দুষ্টামি করবে না”। তার বিলাপ শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে উপস্থিত মানুষ।

অ্যালফাবেট কিন্ডার গার্টেন’র অধ্যক্ষ মোস্তফা জামান সুজন জানান, তাসিনের মৃত্যুর ঘটনায় বুধবার স্কুল বন্ধ ছিলো। তিনিসহ স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকরা এ শিশুহত্যাকারীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করার দাবি জানান। কলাপাড়া হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ডা. জুনায়েদ খান লেলীন জানান, তাসিনকে রাত পৌনে ১১টায় যখন নিয়ে আসা হয় তার আগেই সে মারা গেছে। তারা ধারনা সন্ধা ৭টার মধ্যেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। কারন মৃতদেহের গলায় ও নাকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাদের ধারনা তাকে শ্বাষরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

কলাপাড়া থানার ওসি(তদন্ত) মো. মনিরুজ্জামান জানান, প্রাথমিকভাবে তারাও ধারনা করছেন তাসিনকে শ্বাষরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত শিশুর পিতা গাজী মো. মজিবুর রহমান অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় একট এজাহার দাখিল করেছেন।

(এমকেআর/পি/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test