E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় ১০১ প্রতিমায় সরস্বতী পূজা, সাত দিনব্যাপি পঞ্চমী মেলা

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১৩ ২০:২৫:১৫
সাতক্ষীরায় ১০১ প্রতিমায় সরস্বতী পূজা, সাত দিনব্যাপি পঞ্চমী মেলা

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি :  সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রাম। ১৯ শতকের প্রথম দিকে এখানকার জমিদার প্রাণনাথ সরদার  পুকুর খনন করে তার পাশে নির্মাণ করেন কাছারি ঘর। এ ছাড়াও জ্ঞান চর্চায় তৈরি করেন বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ।

বাঙালী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নির্মাণ করেন দোল মঞ্চ, গৌড়ীয় মঠ, চড়ক স্থান, দু’টি মদিনা দরগা, কালিমন্দির ও দুর্গাপুজা মণ্ডপ। স্থাপন করেন বিষ্ণুপুর বাজার। কালের বিবর্তনে এ সবের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এরপরও বন্ধুমহল ও প্রান্তিক সংঘ দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বিষ্ণুপুর মাঠে সার্বজনীন সরস্বতী পুজা উপলক্ষে র‌্যালী, আলোকসজ্জা করে আসছে। পাশাপাশি তারা সাত দিনব্যাপি পঞ্চমী মেলার আয়োজন করে। মেলা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, যাত্রাপালার আয়্জোন করা হয়। বসে নাগর দোলা ও পুতুল নাচ। জমিদারদের হারানো সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতে প্রান্তিক সংঘ এবার সরস্বতীর সঙ্গে ১০১টি মুর্তি তৈরি করে পুজা করছে। বন্ধুমহল আয়োজন করেছে অত্যাধুনিক আলোচ সজ্জার।

সরেজমিনে শনিবার দুপুরে বিষ্ণুপুর গ্রামে গেলে কথা হয় বন্ধুমহলের সভাপতি বাচ্চু সরদার, প্রান্তিক সংঘের সভাপতি শিবুপদ বৈদ্য, সাংস্কৃতিক কর্মী শঙ্কর সদোর, সুশান্ত সরদার, তন্ময় মণ্ডল ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক সরদারের সঙ্গে। তারা জানান, ১৯ শতকের প্রথম দিকে বিষ্ণুপুরের জমিদার প্রাণনাথ সরদার বিভিন্ন জনহিতৈষী,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নিজের জমিতে নির্মাণ করেন একটি উচ্চ বিদ্যালয়,বোডিং হাউজ ও বিষ্ণুপুর বাজার। এছাড়া একটি মনোরম দোলমঞ্চ তৈরি করে তাতে প্রতিষ্ঠিত করেন সোনার তৈরি রাধাকৃষ্ণ যুগল মুর্তি। শ্যামনগর ও আশাশুনিতে কোন উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় এখানে পড়াশুনা করতো ওইসব এলাকার শিক্ষার্থীরা। থাকতো বোর্ডিং হাউজে। এ বিদ্যালয়ের ফলাফল দেখে ঈর্ষান্বিত হতো অনেকেই।

তারা আরো জানান,সেকালে নানা পূজা অর্চনায় মাতোয়ারা হয়ে থাকতো বিষ্ণুপুর গ্রামের জমিদার পরিবার। এ গ্রামে বসবাসিকারি শতভাগ মানুষই ছিল হিন্দু। দোল যাত্রা, সরস্বতীপূজা ,দুর্গাপূজা , লক্ষ্মীপূজা,বাসন্তী পূজা , মনসা পূজা , বিশ্বকর্মাপূজা, চড়ক পুজা, কালিপূজাসহ বারো মাসে তেরো পার্বন হতো এখানে। এতে অংশ নিতেন বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষ। বিষ্ণুপুর পরিণত হতো সর্বদর্শের মিলন মেলায়। সময়ের বিবর্তনে জমিদারদের জমিদারিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ি, গোবরাখালির মদিনা দরগা ও দোলমঞ্চটি অস্তিত্ব সঙ্কটে। প্রাণনাথ সরদারের মুল ওয়ারেশদের অধিকাংশই পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। তাই পরিত্যক্ত বাড়ির বারান্দায় শোভা পাচ্ছে পালকি। গোবরাখালির ভগ্ন মদিনা দরগাটি একটি বটগাছের কোলে আশ্রয় নিয়েছে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযদ্ধে লক্ষীনাথপুরের কুখ্যাত রাজাকার আবুল কাশেম বিষ্ণুপুরের দোলমঞ্চ থেকে সোনার তৈরিে রাধাকৃষ্ণ মুর্তি ও সোনার দোলনা লুট করে নিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জে মুক্তিকামি জনতার হাতে নিহত হন। এরপর থেকে দোলযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। এলঅকাবাসি বঞ্চিত হয় কলকাতার শিল্পীদের মঞ্চস্ত যাত্রাপালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সার্কাস প্রদর্শলী থেকে। এখন প্রাণ নেই বিষ্ণুপুর বাজারের। পুজা হলেও জৌলুস হারিয়ে গেছে কালিমন্দিরের। গৌড়ীয় মঠ ও চড়ক পুজার স্থানটি কোর প্রকারে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে দুর্গা পুজাও অনুষ্ঠিত হয় পুরাতন ঐতিহ্য মেনে। প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়টি সংস্কার করা হলেও সেকানে রয়েছে কক্ষ সঙ্কট। সব মিলিয়ে স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এখানকার জমিদারদের প্রাচীন এতিহ্য।

স্থানীয়রা জানান, বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আজ থেকে ২২ বছর আগে থেকে বন্ধুমহল শুরু করে আড়ম্বরপূর্ণ সরস্বতীপুজার। ক্রমশঃ এ পুজা রুপ নেয় সাবজনীনরুপে। গ্রামে অনুষ্ঠিত সকল পারিবারিক পুজার সমন্বয়ে বিসর্জনের দিনে র‌্যালি হতো। আয়োজন করা হতো আলোক সজ্জার। এভাবে চলতে চলেত ১৩ বছর আগে থেকে বিষ্ণুপুর ফুলবল মাঠে প্রান্তিক সংঘও শুরু করে সরস্বতী পুজা। উভয় ক্লাবই প্রতিযোগিাতায় নেবে শুরু করে সুসজ্জিত মণ্ডপ তৈরির। তাদের উদোগ্যে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপি পঞ্চমী মেলা। মেলায় বসে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন স্টল। খরচবহুল সুজাজ্জিত প্যাণ্ডেলে সম্পৃক্ত করা হয় আধুনিক আলোকসজ্জার। এরই মধ্যে এবার প্যাণ্ডেল খরচ কমিয়ে প্রান্তিক সংঘ ১০১টি প্রতিমা তৈরি করে জেলাজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে। তেমনই আলোকসজ্জায় নতুনত্ব এনে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে বন্ধুমহল। মেলায় যাতে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি না ঘটে সেজন্য সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকগণ। দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশও। সবমিলিয়ে বিষ্ণুপুরের হারনো ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগের কমতি নেই।

এ ব্যাপারে বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার মণ্ডল জানান, বিষ্ণুপুর গ্রামটি জমিদার প্রাণকৃষ্ণ সরদারের জন্যই পরিচিতি লাভ করেছে। এক সময় এখানে দোলযাত্রা হতো। বসতো সার্কাস। এ ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। বন্ধু মহল ও প্রান্তিক সংঘ সরস্বতী পুজা উপলক্ষে সাত দিনব্যাপি পঞ্চমী মেলার আয়োজন করে বিষ্ণুপুরের হারানো সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে আবারো ফিরে আসতে পারে বিষ্ণুপুরের জমিদারদের হারানো গৌরব। তবে এ সংস্কৃতি ধরে রাখতে হলে সরকারিভাবে জমিদার বাড়ি, দোলমঞ্জ ও গোবরাখালির মদিনা দরগা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

(আরেএনকে/এস/ফব্রেুয়ারি১৩,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test