E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কলারোয়ায় প্রার্থীদের মনোনয়ন জমাদানে বাধা

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ২২ ২১:০২:০৩
কলারোয়ায় প্রার্থীদের মনোনয়ন জমাদানে বাধা

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : শুধু বিএনপি বা ওয়ার্কার্স পার্টি নয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় সরকার দলীয় প্রার্থীরাও নির্বিঘ্নে তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। কয়েজনের মনোনয়নপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাধা দেওয়ায় মারপিট করা হয়েছে তাদের।

উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কাজী শাহাজাদার আজ্ঞাবহ একটি সিন্ডিকেট এই মনোনয়ন জমায় বাধার সৃষ্টি করেছে। অনেকেরই কাগজপত্র তল্লাশির নামে পুলিশও তাদের হয়রানি করেছে। রিটানিং অফিসারের কার্যালয়ের সামনে পুলিশ বসে থেকে ছিনতাইকারিদের সহযোগিতা করেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন এ ধরনের বাধা দানের বিষয়টিকে মিথ্যা বলে দাবি করলেও দলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন।

এ উপজেলায় বিএনপি সহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরাও নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা শহিদুল ইসলামের বাড়িতে হামলা করে ভাংচুর করেছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মনিরুল ইসলামের সমর্থকরা। এদিকে সাতক্ষীরা সদরে বৈকারি ইউনিয়নে মহিলা মেম্বর প্রার্থী রত্না খাতুন তার মনোনয়ন জমাদানে বাধা পেয়েছেন। এরপর তাকে ও তার সমর্থক সাংবাদিক রবিউল ইসলাম সহ কয়েকজনকে তারা মারধর করেছে। এ ঘটনায় ইয়াছিন আলী নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করা হয়েছে।

কলারোয়া উপজেলা বিএনপি সভাপতি অধ্যাপক বজলুর রহমান জানান যুগিখালি ইউনিয়নে বিএনপি দলীয় প্রার্থী রবিউল ইসলাম, কয়লা ইউনিয়নের আব্দুর রকিব,দেয়াড়া ইউনিয়নের ইব্রাহীম হোসেন ও জালালাবাদের রবিউল ইসলাম তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন- ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কাজী শাহজাদা সিন্ডিকেটের তান্ডবের মুখে।তবে ইব্রাহীম হোসেনের কেড়ে নেওয়া মনোনয়নপত্র উদ্ধার করে তা যথাযথভাবে জমাদানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশনা এসেছে বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়।

তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইব্রাহীম হোসেন নতুন করে মনোনয়ন জমা দিতে না পারলেও তার স্ত্রী নাজমা পারভিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। কলারোয়ার নির্বাচন অফিসার মাসুদুর রহমান জানান, ১২ টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে প্রায় ৬৫০টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে ৫৮টি,সংরক্ষিত আসনে ১০৭টি ও সদস্য পদে ৪২৫টি মনোনয়ন জম পড়েছে। সোনাবাড়িয়া কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনিরুল ইসলাম একক প্রার্থী হিসেবে জয়লাভের ঘোষণার অপেক্ষায়।

সরেজমিনে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সামনে যেয়ে দেখা গেছে পুলিশ প্রতিটি নারী ও পুরুষের ব্যাগ তল্লাশি করছে। বাগ না থাকলেও হাতে থাকা কাগজপত্র যাঁচাই করা হচ্ছে। ১২টি ইউনিয়নের জন্য ৬ জন পৃথক রিটার্নিং অফিসারের কক্ষে অনেকেই ঢুকতে পারেননি। কাগজপত্র তল্লাশির নামে তাদেরকে গেট থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে পুলিশ।

সকাল ১১টার দিকে কলারোয়া শিল্পকলা একাডেমীর সামনে যেয়ে দেখা গেছে দোতলায় ওঠার সিড়ির আশে পাশে পুলিশের ভিড়। এরই মধ্যে সাংবাদিকরা উপরে উঠতে চাইলে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা আনোয়ার ময়না ও তার এক মহিলা সমর্থক তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন। এনটিভি’র সাতক্ষীরা প্রতিনিধি সুভাষ চৌধুরীর হাতে থাকা একটি কাগজের বাণ্ডিল দেখে সেলিনা আনোয়ার ময়না সেটি কোন এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভেবে জোর করে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি সরে গেলেও তার এক শাকরেদ পিছনে পিছনে উপরে উঠে সাংবাদিকরা কোথায় যাচ্ছেন তা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় উপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যুগিখালি ইউনিয়ন থেকে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী রবিউল হাসান। একই স্থানে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে যেয়ে দেখা গেছে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছেন দেয়াড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোননীত প্রার্থী মাহাবুবর রহমান মফে। দোতলায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ছিলেন যুগিখালি ইউনিয়নের সরকার দলীয় প্রার্থী রবিউল হাসান। তারাও সাংবাদিকেদের উপরে উঠতে বাধা দেন। কেড়ে নেন কয়েকজনের মনোনয়নপত্র ও টাকা জমা দেওয়ার রশিদ। সেখান থেকে ৩০ হাত দুরে আমগাছ তলায় চেয়ারে বসে এ দৃশ্য উপলব্ধি করছিলেন কলারোয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সালেহ মোঃ মাসুদ করিম ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) শফিকুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সাংবাদিকরা সেখানে দীর্ঘক্ষণ থাকায় অস্বস্তিতে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা তাদেরকে সরে যেতে বলেন। তবে পুলিশের উপস্থিতিতে দেয়াড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী ইব্রাহীম হোসেনের মনোনয়নপত্র জনৈক আব্দুর রহিমের কাছ থেকে কেড়ে নেন সেলিনা আনোয়ারা ময়না ও মাহবুবর রহমান মফে। পরে রহিমকে উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ স্বপনের অফিসে নিয়ে যেয়ে তাকে বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য শাসানো হয়। এ সময় জয়নগর ইউনিয়নের সরকাটি থেকে সরকার দলীয় লোক রেজাউল ইসলাম বলেন, তার বিরুদ্ধে কোন প্রার্থী রাখা হবে না।

অন্যদিকে কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেন জানান, রোববার দুপুরে তিনি মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় মার খেয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কাজী শাহাজাদার ক্যাডার মুন্না, তুহিন,বাবলু,নজরুল,ছিনতাই লাল্টু,মহিদুল, মারুফ,শহিদ আলি ও হল বাবলুদের হাতে ।

। কয়লা ইউনিয়নের ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ জানান, গত ২০ ফ্রেব্র“য়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগেই ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন তাকে মনোনয়ন জাম দিতে নিষেধ করেন। একপর্যায়ে আলিঙ্গন করার নামে তার কাছ থেকে এক সেট কাজ কেড়ে নেন। যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তিনি মূল কাগজপত্র জমা দিতে সক্ষম হন। জমা দিলেও যাঁচাই বাছাই পর্বে যে কোন মূল্যে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী রাখা হবে বলে হুশিয়ারি দেন উপজেলা চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের একাংশের সন্ত্রাস প্রতিহতত করতে তিনি নির্বাচনে নেমেছেন বলে জানান তিনি। এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিদুল ইসলামও অন্যান্য প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দিতে । তবে আক্ষেপের সঙ্গে আব্দুর রউফ বলেন, তার দলীয় সাংসদ ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আগে থেকেই অবহিত করলেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে কোন দায়িত্ব পালন করেননি।
উপজেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক ইমরান হোসেন জানান, রোববার তিনি তার ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিতে গেলে তার কাগজপত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ঘণ্টাব্যাপি অবরুদ্ধ করে রাখার পর পুলিশ যেয়ে তাকে উদ্ধার করেন।

কয়েকজন প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপনের আজ্ঞাবহ হিসাবে একটি সিন্ডিকেট সেখানে অবস্থান নিয়েছে। এই সিন্ডিকেটের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা যুবলীগ সভাপতি কাজী শাহজাদা। তিনি তার লোকজন নিয়ে শনিবার থেকে পরিষদের গেটে অবস্থান করেন। তাদের অপছন্দের প্রার্থীদের কাছ থেকে কাগজপত্র ছিনিয়ে নেন। সোমবার সকাল ১০টার দিকে জয়নগর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে ফজলুর রহমান দফাদার নামের একজন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যের কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার সমর্থক আব্দুর রহমান। তবে যে কোন মূল্যে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য কলারোয়ার দু’ সাংবাদিককে মাথা পিছু পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে সহায়তা নিয়েছিলেন বলে জানান দু’ ইউপি সদস্য প্রার্থী।

এছাড়া একই দল থেকে মনোনয়ন প্রার্থী হলেই তাদের কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ করে প্রার্থীরা বলেন, ‘কয়লা ইউনিয়ন, যুগিখালী ইউনিয়ন, সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন, জালালাবাদ ইউনিয়ন ও দেয়াড়া ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে দলের সভাপতি এই মিশনে নেমেছেন’।

এদিকে সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কাজী শাহজাদা বলেন, ‘আমি ও আমার লোকজন আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি জামায়াত অথবা স্বতন্ত্র কাউকে বাধা দিচ্ছি না। তবে একই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুইজন প্রার্থী যাতে না হন সেই ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা বলি মাত্র’। এমন একটি ঘটনা নিয়ে কুশোডাঙার জাকির হোসেনের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যানের হাতাহাতির ঘটনা স্বীকার করেন তিনি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু জানান, ‘ফিরোজ আহমেদ স্বপন কুশোডাঙা ইউনিয়নের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেনকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে মারপিট করেছেন’। তিনি বলেন, ‘৫টি ইউনিয়নে একক নির্বাচন ছাড়াও অন্য ৭টি ইউনিয়নে উপজেলা চেয়ারম্যান নৌকা প্রতীকধারীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র অথবা বিএনপি বা জামায়াতের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন’। তিনি সিন্ডিকেট তৈরী করে তার দলের অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন নেতা বাধা দিচ্ছেন বলে স্বীকার করেন। তিনি আরও বলেন উপজেলা চেয়ারম্যান দ্বিমুখী নীতি গ্রহন করেছেন।স্বপন শাহজাদা নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের অপর যেসব সদস্য প্রকাশ্যে মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মুন্না, তুহিন,বাবলু,নজরুল,ছিনতাই লাল্টু,মহিদুল, মারুফ,শহিদ আলি ও হল বাবলু । মনোনয়ন নিতে দলীয় প্রার্থী ছাড়াও বিএনপি বা অন্যদলীয় প্রার্থীদের কাছ থেকে ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার উত্তম কুমার রায় বলেন ‘আমার কাছে এমন কোন অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ আসলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন বলেন, ‘কলারোয়ায় অত্যন্ত শান্তিপূর্নভাবে মনোনয়ন জমাদানের কাজ চলছে। কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা আনোয়ার ময়নার সাংবাদিকের কাছ থেকে কাগজ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে তিনি বলেন, চেনে না বলেই তো-------।




(আরএনকে/এস/ফেব্রুয়ারি২২,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test