E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি ছালাম মাতবর!

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ২৯ ১৪:৪২:২৯
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি ছালাম মাতবর!

গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : পটুয়াখালীর গলাচিপা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা মৃত মু.কুটি মিয়া মাতবরের বড় সন্তান নিরকক্ষর রিক্সা চালক আ. ছালাম মাতবর। বর্তমানে তার বয়স ৭০ বছর। পরিবারে স্ত্রী ও ৬ ছেলে নিয়ে বিগত দিনগুলো কোন রকমে পার করেছেন এই অসহায় মুক্তিযোদ্ধা ও রিক্সা চালক ছালাম মাতবর। তার ৫ ছেলে বিবাহ করে সংসার থেকে ভিন্ন হয়ে গেছেন অনেক আগেই। এখন সংসারে স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে নিজে রিক্সা চালিয়ে অতি কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন বৃদ্ধ ছালাম মাতবর।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ছালাম মাতবর পেশায় একজন নৌকার মাঝি ছিলেন। তখন তার কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বাংলাদেশ থেকে ট্রেনিং-এর উদ্দেশ্যে নদী পথে নৌকা যোগে ভারতে নিয়ে যাওয়া ও পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ট্রেনিং শেষে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা। এমনকি এই ছালাম মাতবর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচরের কাজ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রান্না করেও খাওয়াতেন। তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি এ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছিলেন একজন দুঃসাহসিক দেশ প্রেমিকের ন্যায়। দেশের জন্য তার এ ছোট ছোট অবদানগুলো এ প্রতিবেদকের হৃদয়কে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছে। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৪ বছর পার হওয়ার পরেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি অসহায় বৃদ্ধ রিক্সা চালক ছালাম মাতবরের! সংশ্লিষ্টদের কাছে বহুবার ধরণা ধরেও কোন ফল পায়নি ছালাম মাতবর। বরং যতবার তাদের কাছে গিয়েছেন ততবারই নিরাশ হয়ে অভিমান ও এক বুক ভরা কষ্ট নিয়ে শূণ্য হাতে আপন কুটিরে ফিরে এসেছেন ছালাম মাতবর। যুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেশের অনেকেই বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছিলেন। তবে ছালাম মাতবরের মত সেদিন যারা পাকিস্তানি সন্যদের রাইফেলের বুলেটের আঘাতে নিশ্চিৎ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে দুঃসাহসিক নাবিকের ন্যায় রাতের অন্ধকারে প্রবল বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে উত্তাল সমুদ্র পথে দূরদেশে নিজের জীবনকে বাজী রেখে অনেক কষ্ট সহ্য করে নৌকা বেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এপাড় থেকে ওপাড়ে পারাপার করেছিলেন তাদেরকেও আমাদের মূল্যায়ন করা উচিত, সম্মান করা উচিত। এই অসহায় ছালাম মাতবরের পাশে আজ দাঁড়াবার মত কি কেউ নেই?

এ বিষয় নিয়ে আ. ছালাম মাতবরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যুদ্ধের সময়ে ঝালকাঠী জেলার কাঠালিয়া উপজেলার আমুয়া ইউনিয়ন থেইকা রয়জদ্দি কোম্পানীর মাঝির সহযোগিতায় নদী দিয়া নৌকায় কইরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতে পার কইরা দেই, আবার হেই নদী দিয়াই নৌকায় কইরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বাংলাদেশে লইয়া আই। হেই সময়ে রয়জদ্দি কোম্পানীর মাঝিরা নদী দিয়া চোরাচালানির মালামাল ভারত থেইকা বাংলাদেশে লইয়া আইত। হেই জন্য ভারতে যাওয়ার ঐ নদীটা হেরা চিনত। এক রাইতে ১০৪ জন মুক্তিযোদ্ধা লইয়া নৌকা বাইয়া নদী দিয়া ভারতে যাওয়ার সময়ে আমরা ভীষণ বইন্যার মধ্যে পড়ি। তহন ৮ নম্বর সিগন্যাল আছিল। পানি উইঠা নৌকাটি তহন আধা ডোবা অবস্থায় আছিল। ঐ সময়ে মনে অইছিল আমরা আর বাঁচুমনা। তহন আমরা খুব কষ্ট কইরা একটা গাছবনে যাইয়া উঠি। ভারতে যাইয়া আমাদের গলাচিপার এম.সি বারেক মিয়ার লগে আমার দেহা হয়। এম.সি বারেক মিয়া ৫ টা চিডি হের বাড়িতে পুঁছাইয়া দেওয়ার জন্য আমার ধারে দেন। আমি হেই চিডিগুলা হাজী শাহজাহান মিয়ার ধারে পুঁছাইয়া দেই। এ্যাহন আমি খুব অভাব অনটনের মধ্যে আছি। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম নাই- এইডাই আমার মনে বড় কষ্ট। টাহা চাইনা, পয়সা চাইনা, মিত্যুর আগে যদি দেইখা যাইতে পারতাম-মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম উঠছে তাইলে মরার আগে আমার আত্মায় একটু শান্তি পাইতাম! কথাগুলো বলতে বলতে ছালাম মাতবর আবেগ আপ্লুত হয়ে নিজের কান্নাকে ধরে রাখতে পারলেন না। চোখ থেকে বেদনার অশ্রুগুলো ঝরে পড়ল মাটিতে নীরবে নিঃশব্দে। মনঃকষ্টে আজ ছালাম মাতবর দিনাতিপাত করছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেন এই আহাজারি ছালাম মাতবরের?- এটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের বিবেকবান মানুষের কাছে!

এ ব্যাপারে তৎকালীন গলাচিপার সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও গলাচিপা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি হাজী মু. শাহজাহান মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি তৎকালীন গলাচিপার এম.সি ও গলাচিপা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত আ. বারেক মিয়ার ভারত থেকে পাঠানো চিঠিগুলো ছালাম মাতবরের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ছালাম মাতবর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নৌকা যোগে পারাপার করে সাহায্য করেছেন বলেও তার সত্যতা স্বীকার করেন। এ ব্যাপারে সাবেক গলাচিপা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মু. নুরুল ইসলাম ধলা বলেন, আমি ছালাম মাতবরকে ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের সামনে নদীতে নৌকায় পাথরের পাটার উপরে হলুদ মরিচ পিষতে দেখি। তখন আমার সাথে ছালাম মাতবরের কথা হয়েছিল। এ বিষয়গুলো নিয়ে গলাচিপা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মু. রুহুল আমিন ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি লোকমুখে শুনেছি যে, ছালাম মাতবর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নৌ-পথে নৌকা যোগে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ও ভারত থেকে বাংলাদেশে পারাপার করেছিলেন। যুদ্ধের সময়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাহায্য করেছিলেন, তাই বলে তাদের সকলকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। কেউ যদি সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে তবে সে-ই হবে মুক্তিযোদ্ধা। আর সেক্ষেত্রে ৩ জন সহযোদ্ধাকে তার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। এ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকী বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ছালাম মাতবর সম্পর্কে লিখিত প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করব এবং তিনি ছালাম মাতবরকে সরকারি ভাবে আর্থিক অনুদান দেয়ার জন্য সার্বিক ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন বলে সাংবাদিকদের কাছে আশা ব্যক্ত করেন।

(রিবি/পি/ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test