E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অবশেষে মুক্তি পেলেন সাতক্ষীরার জবেদ আলী

২০১৬ মার্চ ০২ ১৫:২৪:৫২
অবশেষে মুক্তি পেলেন সাতক্ষীরার জবেদ আলী

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : হাইকোর্ট থেকে বেকসুর খালাসের আদেশ পাওয়ার ১৩ বছর পর বুধবার  তা কার্যকর করা হয়েছে। ফলে বিনা অপরাধে কারামধ্যে থেকে অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা গ্রামের জবেদ আলী।

কয়লা গ্রামের মৃত আজমেল আলী বিশ্বাসের বৃদ্ধা স্ত্রী ছখিনা বেগম জানান, তার ছেলে জবেদ আলীর প্রথম স্ত্রী লিলি(৮) ও রেক্সোনাকে রেখে মারা যায়। তিন মাস পর জবেদ আলী আবারো বিয়ে করে।

১৯৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মেয়ে লিলিকে মামার বাড়ি তালা উপজেলার মানিকহার গ্রাম থেকে সেনেরগাতি বাজারে নিয়ে এসে বিস্কুটের সঙ্গে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগে মৃতের মামা আবুল কাশেম সরদার পরদিন তালা থানায় একটি হত্যা মামলা ( থানা মামলা নং-৫, জিআর- ১৬৩/৯৪) দায়ের করেন। মামলায় জবেদ আলী বিশ্বাসকে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামী গ্রেফতার হয়ে এখনো পর্যন্ত জেলখানায় রয়েছেন। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা তালা থানার উপরিদর্শক লিয়াকাত আলী ১৯৯৬ সালের ৯জুন এজাহারভুক্ত আসামীর নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

পাঁচজন সাক্ষীর জবানবন্দি ও নথি পর্যালোচনা করে অতিরিক্তি জেলা ও দায়রা জজ -২ আদালতের বিচারক মোঃ সিরাজুল ইসলাম ২০০১ সালের পহেলা মার্চ হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে আসামী জবেদ আলীকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ দেন। এ আদেশ পাওয়ার কয়েকদিন পর জবেদ আলীকে সাতক্ষীরা থেকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সে জেলখানার মাধ্যমে হাইকোর্টে আপিল ( ক্রিমিনিাল জেল আপীল নং-১২৭৩/২০০১)করেন। আপীল মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট থেকে হাজতী/ কয়েদী কনভিকশন নং ৩০০৮ /এ সাতক্ষীরা জেল উক্ত আসামী নির্দোষ প্রমাণে ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ খালাস পান।

২০০৩ সালের ২৬ মার্চ ২৫৮৪২ নং স্মারকে এ আদেশ পাঠানো হয় সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে। রেফারেন্স মতে হাইকোর্টের ১০৭২৫নং স্মারকে আদেশ অনুযায়ি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মামলার মুল নথি (এলসিআর নং-৬০৬৭) জেলা ও দায়রা জজ সাতক্ষীরার -২ আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি তৎকালিন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশের কপি শামিল করে সংশি¬ষ্ট রেজিষ্টার নোট করে বিধি মোতাবেক নথিটি রেকর্ডরুমে পাঠানো হোক মর্মে ২০০৩ সালের ৩ এপ্রিল এর এক আদেশে উল্লেখ করেন। এক্ষেত্রে হাইকোর্টের আদেশ সংশ্লিষ্ট আমলী আদালতে এলে তার সত্যতা যাঁচাই করে ওই আসামী অন্য কোন মামলা না থাকলে তাকে জেলখানা থেকে মুক্তি দিতে আপত্তি নেই মর্মে জেল সুপারকে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলঅ হয়নি। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার মতিয়ার রহমানের (বর্তমানে মাগুরা জুডিশিয়াল কোর্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা) ভূমিকা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ফলে হাইকোর্টের আদেশ নকলখানায় বন্দি হয়ে যাওয়ায় ১৩ বছর ধরে জেলখানায় থাকতে হয় আসামীকে।

যশোরের শার্শা উপজেলার উলুসি গিলাতলার জয়নুদ্দিন মোড়লের ছেলে আব্দুর রশীদ মোড়ল জানান, শার্শা থানার একটি মাদক মামলায় তিনি দু’ মাস নয়দিন যাবৎ যশোর কারাগারে ছিলেন। এ সময় তিনি জবেদ আলী মোড়লের সঙ্গে একঘরে কাটাতেন। আজ থেকে এক মাস আগে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এ সময় জবেদ আলী তার ভাই জিয়ারুল ইসলাম ও ইয়ার আলীর কাছে একটি চিঠি তার (আব্দুর রশীদের) মাধ্যমে পাঠান। জিয়াদ আলী বিশ্বাস জানান, ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর তিনি বিষয়টি সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. জিল্লুর রহমানকে (২) অবহিত করেন। খোঁজ নিতে যেয়ে তিনি জানতে পারেন হাইকোর্ট থেকে তার ভাই জবেদ আলী ২০০৩ সালে বেকসুর খালাস হয়ে গেছে।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. জিল্লুর রহমান (২) ও অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু জানান, গত ২৪ ফেব্র“য়ারি হাইকোর্ট থেকে জবেদ আলীর মুক্তি সংক্রান্ত একটি হলফনামা দিয়ে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক আশরাফুল ইসলামের কাছে তারা আবেদন করেন। বিচারক নকলখানা থেকে নথি তলব করে সংশ্লিষ্ট আদালতে তলব করে গত রবিবার প্রথম শুনানী করেন।

সোমবার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দৈণিক প্রজন্মের ভাবনায় প্রকাশিত হয়। বিচারক বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্টারসহ সম্ভব্য সকল বিভাবে জবেদ আলীর খালাস আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপীল করেছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া কথা বলেন। এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে যশোর জেলা কারাগার থেকে জবেদ আলীকে সাতক্ষীরা জেলা কারাগারে নিয়ে আসা হয়। এ প্রতিবেদক সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্টার জাকির হোসেনের মাধ্যমে জানতে পারেন যে জবেদ আলীর জেল আপীলে খালাস আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপিল করেনি।

বুধবার তাকে গোপনে মাথায় হেলমেট দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সাতক্ষীরা আদালতে নিয়ে আসা হয়। শুনানীকালে বিচারক জবেদ আলী কিভাবে এতদিন জেল হাজতে রয়েছে তা শুনে বিস্মিত হন। একপর্যায়ে তাকে খালাসের নির্দেশ দেন। এছাড়া এ হাইকোর্টের এ আদেশ যথাযথভাবে পালনে ত্রুটির জন্য নিজেই হতাশ হন। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন. যাদের ত্রুটির জন্য জবেদ আলীকে বিনা অপরাধে ১৩ বছর জেলে জীবন কাটাতে হলো তাদের বিচার আল্লা করবে। এ সময় কাঠগড়ায় জবেদ আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। আদালতের বাইরে জবেদ আলীর ছবি তুলতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ট কয়েকজন আইনজীবী বলেন, এ ধরণের হাইকোর্টের আদেশ সংশি¬ষ্ট আমলী আদালতে এলে তার সত্যতা যাঁচাই করে ওই আসামী অন্য কোন মামলা না থাকলে তাকে জেলখানা থেকে মুক্তি দিতে আপত্তি নেই মর্মে জেল সুপারকে নির্দেশ দেওয়ার কথা জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক তাপস কুমার দে’ এর আদেশে থাকা উচিত ছিল। তাছাড়া সংশি¬ষ্ট অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পেশকার মতিয়ার রহমানের (বর্তমানে মাগুরা জুডিশিয়াল কোর্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা) ভূমিকা নিয়েও সংশয় রয়েছে। দীর্ঘ ১৩ বছর কোন কারণ ছাড়াই কারাভোগ নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন। যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের জেলর মোঃ আবু তালেব জানান, জবেদ আলী বিশ্বাসকে বুধবার বিকেলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মা ছকিনা বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলে জবেদ আলীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, যারা তোর জীবনের ১৩টি বছর অন্ধকারের মধ্যে রেখে দিল তাদের সাজা হওয়া উচিত। তা না হলে আল্লাই তাদের বিচার করবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জবেদ আলীর ছোট মেয়ে রেক্সোনা, ভাই ইয়ার আলীসহ আত্মীয় স্বজনরা।

(আরকে/এএস/০২ মার্চ, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test