E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে আহত ৩, ১৪ কেন্দ্রে ভোট স্থগিত

২০১৬ মার্চ ২২ ২০:৪৫:৪৪
সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে আহত ৩, ১৪ কেন্দ্রে ভোট স্থগিত

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা থেকে :  রাতে কেন্দ্রে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে জালভোট দেওয়া এবং দিনভর ভোট কাটাকাটি ও তাণ্ডব সৃষ্টিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরায় শেষ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন।

নির্বাচনে জালভোট দেওয়া ছাড়াও বোমাবাজি করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। এমনই এক ঘটনায় তালা উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের দুই নেতা- কর্মী পুলিশের গুলিতে আহত হন। এ ছাড়া কলারোয়া উপজেলার কেরালকাতা ইউনিয়নের বলিয়ানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কয়েকটি বোমা মেরে ত্রাস সৃষ্টি করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী স.ম মোর্শেদের পক্ষে ভোট কেটে নেওয়ার সময় বিদ্রোহী প্রার্থী ফারুক হোসেন অভির কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নামের এক যুবক জখম হয়।

অপরদিকে নির্বাচনে নানা ধরনের বিশৃংখলার বিষয় স্বীকার করে নিয়ে প্রশাসন ১৪টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহন স্থগিত করে দেয়। এছাড়া ভোট জালিয়াতি, তান্ডব সৃষ্টি, এজেন্টদের বের করে দেওয়া এবং মারপিট সহ নানা ঘটনার প্রতিবাদে কমপক্ষে চারজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন।

সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ্য করা গেলেও ভোটারদের মধ্যে এক ধরণের ভীতি কাজ করছিল। দিনভর কেন্দ্রগুলোতে পুরুষ ভোটারের উপস্থিতি খুব কমই লক্ষ্য করা গেছে। প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন বেলা ১১টার মধ্যে চেয়ারম্যান পদের ভোট গ্রহন জালিয়াতির মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়। এর পর থেকে কোন কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদের কোন ব্যালট ছিল না। প্রার্থীরা অভিযোগ করে বলেন তাদের সমর্থকরা কেন্দ্রে যেয়ে ফিরে এসেছেন। তাদেরকে বলা হয়েছে ‘চেয়ারম্যানের ভোট হয়ে গেছে, আপনারা মহিলা সদস্য ও সাধারণ সদস্য পদে ভোট দিয়ে যান’। তারা আরও বলেন তাদের হাতে সদস্য পদের দুটি করে ব্যালট তুলে দেওয়া হয়।

সোমবার মধ্যরাত থেকে আশাশুনির শ্রীউলার নাকতাড়া কালিবাড়ি কেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবু হেনা শাকিল ও তার সমর্থকরা। এ সময় জাল ভোট দেওয়ার মচ্ছব বসে।তালার খলিলনগর ইউনিয়নের হরিশচন্দ্রকাটী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সরকারদলীয় প্রার্থী প্রণব ঘোষ বাবলু তার বাহিনী নিয়ে ব্যালট হাতিয়ে নেন। এ দুটি কেন্দ্রে চেয়ারম্যানের ব্যালটে সিল মারেন তারা। তালার কুমিরা ইউনিয়নের দাদপুর, অভয়তলা ও ভাগবহা কেন্দ্র দখল করে সরকারদলীয় প্রার্থী আজিজুল ইসলাম জালভোটের উৎসবে মেতে ওঠেন। রাত দু’ টোর দিকে পুলিশের সঙ্গে এই বাহিনীর বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে ভাগবহা কেন্দ্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ভাগবাহ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস ও রুবেল শেখ।
তাদেরকে সাতক্ষীরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

কলারোয়া উপজেলার কেরালকাতা ইউনিয়নের বলিয়ানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক ও দলীয় বিদ্রোগী প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় বোমা হামলায় রিজাউল ইসলাম, ইউনুছ আলী, আব্দুর রশীদ, সেহের আলী, নিছার আলী, সহিদুল ইসলাম, মাসুদ রানা ও খলিদ হাসান জখম হন। এ সময় পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে নীর হোসেন নামের এক যুবক জখম হন। আহতদের কলারোয়া, সাতক্ষীরাা সদর ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

জেলা রিটার্নিং অফিসার মোঃ কামরুল হাসান জানিয়েছেন, জালভোট প্রদান, ব্যালট ছিনতাই এবং বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগে তালার ভাগবহা, দাদপুর ও অভয়তলা কেন্দ্র, সাতক্ষীরা সদরের মাহমুদপুর হাইস্কুল, গাংনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়, ভাড়–খালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শ্যামনগরের জয়াখালি মহাজাবিন স্কুল, পূর্ব কৈখালি স্কুল এবং শৈলখালি মাদ্রাসা, কলারোয়ার কুশোডাঙ্গার কলাটুপি, শাকদাহ ও কেরালকাতার বলিয়ানপুর এবং দেবহাটার পারুলিয়া ইউনিয়নের খেজুরবাড়িয়া কেন্দ্রে ভোটগ্রহন স্থগিত করা হয়েছে।

শ্যামনগরের কৈখালির সরকারদলীয় প্রার্থী রেজাউল করিমের হাতে প্রহৃত হয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার মোঃ লিয়াকত আলী। এ উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা ছাড়া বাকি ৮টি কেন্দ্র পুরোপুরি দখল করে নেয় সরকারদলীয় প্রার্থী গোলাম আযম টিটো। সদর উপজেলার রামেরডাঙা কেন্দ্রে ৩ টি, কলারোয়ার দেয়াড়ায় ১০টি এবং আশাশুনির পূর্ব একসরায় সন্ত্রাসীরা ৫টি বোমা নিক্ষেপ করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।

প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন কালীগঞ্জের ধলবাড়িয়া, কুশুলিয়া এবং মৌতলা ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে বেলা ১১টার পর থেকে শুধুমাত্র সদস্যপদে দুটি করে ব্যালট ভোটারদের হাতে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানের ব্যালট আগেই শেষ হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। আশাশুনির বুধহাটার কলেজিয়েট স্কুল ও নওয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এবং প্রতাপনগরের ৭টি কেন্দ্র দখল করে নেয় সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা।

বুধহাটা ও নওয়াপাড়া কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হলেও দু’ ঘণ্টা পর আবার ভোট গ্রহণ শুরু হয়। কালীগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের আনারস প্রতীকধারী স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, নীলকণ্ঠপুর মাদ্রাসা, বন্দকাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুকুন্দ মধুসুধনপুর ও বেজুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র সরকারদলীয়রা জোর করে দখল করে নেয়। সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বিএনপি দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুর রউফ অভিযোগ করে বলেন, তার ইউনিয়নের বেশীরভাগ কেন্দ্রে জালভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন যেসব কেন্দ্রে আমার ভোট অনেক বেশি সেসব কেন্দ্রকে টার্গেট করে ময়ুর বাহিনী তান্ডব চালিয়েছে। এধরনের অন্ততঃ চারটি কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।

তিনি জানান, এসব কেন্দ্রের ৯০ শতাংশ ভোট ধানের শীষের । সাধারণ ভোটাররা চেয়ারম্যান পদে ভোট দিতে না পেরে ফিরে গেছেন বলে জানান তিনি। আলিপুর ও ভোমরার বেশিরভাগ কেন্দ্রে জালিয়াতির মাধ্যমে ভোট শেষ হয়ে যায় বেলা ১২ টার মধ্যে। সদর উপজেলার ধূলিহরের কয়েকটি কেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী মোদাচ্ছেরুল হক হুদা। কলারোয়ার যুগিখালী ইউনিয়নে বিএনপি দলীয় প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ওজিয়ার রহমান সরকারদলীয় প্রার্থী রবিউল হাসানের সহকর্মী জনযুদ্ধ ক্যাডার তুষার ও আয়নাল বাহিনীর তান্ডবের মুখে নিজেদের ইউনিয়ন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়েছেন।

জনমনে এই দুই বাহিনী নিয়ে ব্যাপক আতংক রয়েছে। তাদেরকে অস্ত্র হাতে দিনে রাতে চলাফেরা করতে দেখেছেন এলকাবাসী । আগের রাতে তারা এলাকায় জনযুদ্ধ পরিচয় দিয়ে ভীতি সঞ্চার করেছে। এর ফলে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ফলে জালিয়াতিও হয়েছে জোরেশোরে। এ ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্র ঘুরে যথেষ্ট সংখ্যক ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। যুগিখালি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার প্রভাষক মিজান আক্তার বলেন, তার কেন্দ্রে ভোটাররা সকাল সকাল ভোট দিয়ে চলে গেছেন। বাটরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জালভোট দেওয়ার সময় আবু রায়হান ও আল আমিন নামের দুই যুবককে আটক করে পুলিশ। তবে প্রিসাইডিং অফিসার আবুল কাসিম মুচলেকা নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। এই কেন্দ্রে ভোট শেষ হয়ে যায় বেলা ১১টার মধ্যে। কালীগঞ্জের তারালি ইউনিয়নের বিএনপি দলীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শরীফ আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, সেখানকার কেন্দ্রগুলিতে জালভোট চলছিল। তিনি ও তার এজেন্টরা প্রতিবাদ করতে গেলে অন্ততঃ ১২ জন প্রহৃত হয়েছেন। এরা হলেন রাজু, সেলিম, এবাদুল, হাফিজুল, করিম, বাবু, শাহিন, আমির ও সাইফুল। তিনি বলেন, জালভোট দেওয়ায় দুপুর ১২টার মধ্যে চেয়ারম্যানের ব্যালট শেষ যাওয়ায় ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। তিনিও সংবাদ সম্মেলন করে এ নির্বাচন প্রত্যাখান করেছেন। এদিকে তালার হরিশচন্দ্রকাটী কেন্দ্রের ভোটডাকাতির সময় বাধা দিতে গিয়ে চারজন আনসার সদস্য মিরাজ, কামরুল, ফরিদা ও নার্গিস আহত হয়েছেন। তালার জাতীয় পার্টি প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তার ইউনিয়নের কলিয়া ও লক্ষনপুর কেন্দ্রে লাঙল প্রতীক সম্বলিত কোন ব্যালট না আসায় তিনি ভোট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ দুটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে পুনরায় ভোট নেওয়া হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তালার জাতপুর কেন্দ্রে জালভোট দেওয়ার সময় যুবলীগ কর্মী ফিরোজ বিশ্বাসকে গ্রেফতার করেও পুলিশ অজ্ঞাত কারনে ছেড়ে দিয়েছে। শ্যামনগর সদর ইউনিয়নে সাংসদ জগলুল হায়দারের ভাই অ্যাড. জহুরুল হায়দার বাবুর লোকজন রাতেই ভোট কেটে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অপর এক চেয়ারম্যান প্রার্থী।

আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের আওয়াশীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী ও তার ক্যাডাররা মঙ্গলবার দুপুর ১২টার মধ্যে সাতটি ভোট কেন্দ্র দখল করে নেয় বলে অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেদুর রহমান বাবু। একপর্যায়ে তিনি ভোট বর্জণের ঘোষণা দিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন বলে সাক্ষাদিকদের জানান তিনি। এ ছাড়া উপজেলার খাজরা ইউনিযনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শানানেওয়াজ ডালিমের ক্যাডাররা ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দিয়ে ভোট কেটেছেন বলে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস।

জেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, কেন্দ্রগুলিতে পুরুষ ভোটারের উপস্থিতি কম থাকলেও নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশী ছিল। এছাড়া ভোটার হবার বয়স হয়নি এমন বয়সের বিপুল সংখ্যক যুবককে ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ও তার আশপাশে দলবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। প্রার্থী ও সাধারণ ভোটাররা অভিযোগ করেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছে ছিল সিল। রাতে ও দিনে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে বেরিয়ে যায় তারা। কলারোয়ার দেয়াড়া ইউনিয়নের দেয়াড়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে তারা বেশ কয়েকটি বোমা ফাটিয়ে আতংক সৃষ্টি করে।

সাতক্ষীরা জেলা নির্বাচন অফিসার এইচএম কামরুল হাসান ১৪টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগহণ স্থগিতের কথা নিশ্চিত করে বলেন, কয়েকটি কেন্দ্রেব্বক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।

(আরএনকে/এস/মার্চ২২,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test