E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রতিবন্ধকতায়ও এগিয়ে চলা

২০১৬ এপ্রিল ০২ ১৭:৩১:০৩
প্রতিবন্ধকতায়ও এগিয়ে চলা

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে মিলন কর্মকার রাজু : আর্থিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ না হলে আজ সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো হোসাইন। অন্য শিশুদের মতো সেও সহপাঠীদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করতো। ব্যস্ত হয়ে পড়তো লেখাপড়ার আনন্দ্যে। কিন্তু এ সবই তার কাছে এখন কল্পনা। চতুর্থ শ্রেণি পাস করে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ন হলেও আর্থিক দৈন্যতায় দুই বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে লেখাপড়া। তার কাছে মাছ শিকারই এখন লেখাপড়া।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                             

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পশ্চিম কুয়াকাটা গ্রামের হোসাইন খলিফার বয়স মাত্র ১৩ হলেও এই বয়সে খুব কাছ থেকে দেখেছেন মৃত্যুকে। মাত্র তিন মাস বয়সে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে তার বাম হাতটি হারানোর পর দুই মাসের বেশি সময় তাকে হাসপাতাল বেডে কাটাতে হয়েছে।

বাম হাত পুড়ে শরীরের সাথে লেগে আছে। তারপরও এক হাতেই আগলে রেখেছে সংসার। একটি হাত না থাকার কষ্ট বুকে চেপে রেখে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাতে এক কাঁধেই তুলে নিয়েছে পরিবারের ছয় সদস্যের ভার। কখনও সাগরে রেনু পোনা শিকার, কখনওবা কুয়াকাটা সৈকতে টিউবের ব্যবসার পাহারাদার। এই বয়সেই হোসাইন যেন পরিবারের কর্তা বনে গেছে। অথচ তার স্বপ্ন ছিলো প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় চাকুরী করবেন।

কুয়াকাটা সৈকতে বসে কথা হয় হোসাইনের সাথে। তখন বিভিন্ন স্কুলের শিশুরা বই নিয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে সৈকতে ছোটাছুটি করছে। হোসাইন আমার সাথে কথা বললেও তার দৃষ্টি ওই ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে। তার চোখ তখন ছলছল করছে,মুখের ভাষা ভেতরের চাপা কষ্টে আটকে আসছে। “একটু পরেই জানালো যেতে হবে। অনেক দেরি হইছে। পোনা না ধরলে চাউল কিনতে পারমু না। মায় কইছে ঘরে চাউল নাই। দ্যাখ কিছু পাও (রেনু পোনা) কিনা”।

হোসাইনের ভাষায়“ মোর তো একটা হাত। তাই কোমড়ের লগে দড়ি প্যাচাইয়া জাল টানি। এ্যাহন তো সাগরে তুফান শুরু হইছে। ঝড় আওয়ার আগেই মাছ ধইর‌্যা বাসায় যাওন লাগবে। কুয়াকাটার শরীফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে পাস করলেও আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। অথচ ফাইভে তার রোল ছিলো ৩১। হোসাইন বলেন, স্কুলে যাইতে মন চায়। পড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু পোনা না ধরলে বাপ-মায় না খাইয়া থাকবে হেইয়ার লইগ্যা পোনা ধরি। কেউ স্কুলে ভর্তি করলে আমি আবার পড়মু,বড় বড় বই পড়তে ইচ্ছা করে। আর আমি যে পড়মু হেই টাহা, বই, স্কুলের পোষাক পামু কই?

হোসাইনের মা হাসিনা বেগম বলেন, তহন আমরা কক্সবাজার আছিলাম। হোসাইনের বয়স তহন তিন মাস। একদিন রাইতে অরে ঘুম পাড়াইয়া পাশের বাড়ি দাওয়াত খাইতে যাই আমরা। হঠাৎ ঘরে জলন্ত বাতির (কুপি) উপর মশারি পইড়্যা ঘরে আগুন লাইগ্যা যায়। এলাকার মানুষ অনেক কষ্টে হোসাইনরে উদ্ধার করলেও ও বেগুন পোড়া হইয়া যায়। আগুনে পুইড়্যা হাসানের বাম হাত বুকের লগে লাইগ্যা যায়। ডাক্তার কইছিলো অপারেশন করাইলে জোড়া লাগা হাত ঠিক করা যাইবে। কিন্তু অতো টাহা আমরা কই পামু। দুই মাসেরও বেসি সময় হাসপাতালে রাইখ্যা জানডা কোনরহম বাঁচাইতে পারছি। কিন্তু হাতটা ঠিক করতে পারি নাই। তিনি বলেন, এখনও চিকিৎসা করাইলে হাত ঠিক করা সম্ভব বলে ডাক্তাররা তাদের জানালেও টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করাতে না পেরে তাদের চোখের সামনেই বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে হাতটি।

হোসাইনের পিতা মাসুদ খলিফা বলেন, সিডরে ঘর বাড়ি সব ভাসাইয়া লইয়া গ্যাছে। চাইরডা পোলামাইয়া। হ্যাগো খাওয়ামু না ইসকুলে পাডামু। ছোড পোলা জাহিদ এইবার ফাইবে, মাইয়া মাসুমা সেভেনে ওটছে। বড় পোলা হাসান ও এই হোসাইনরে আর পড়াইতে পারি নাই। তিনি বলেন, কুয়াকাটায় ভাসা (টিউব) ভাড়া দিয়া রোজ ৫০-৭০ টাহা পাই। হেইয়া দিয়া অগো পড়ামু না খাওয়ামু। সাগরে জাল টানলে কয়ডা টাহা হয় ইসকুলে যাইয়া কি করবে।

শরীফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হানিফ শরীফ জানালেন, হোসাইনের প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ও খুব ভালো ছাত্র ছিলো। কিন্তু পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারনে সে আর স্কুলে আসে নি। একটু সহায়তা পেলে ও লেখাপড়ায় খুব ভালো করতো। কিন্তু পরিবারের যে অবস্থা তাতে কে ভার নেবে হোসাইনের স্বপ্ন পূরনের।

(এমকেআর/এএস/এপ্রিল ০২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test