E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কুখ্যাত জামায়াত ক্যাডার নূর ইসলামের  খুঁটির জোর কোথায়?

২০১৬ জুন ১৫ ১১:৪৯:৫৭
কুখ্যাত জামায়াত ক্যাডার নূর ইসলামের  খুঁটির জোর কোথায়?

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জালিয়াতি সংক্রান্ত নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের নোটিশ পেয়ে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙা ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামের কুখ্যাত জামায়াত ক্যাডার নুর ইসলাম, তার ছেলে হুমায়ুন কবীর মিণ্টু।

তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়। একের পর এক জাল দলিল তৈরি করে তাদের জমি জবরদখল, নারী ধর্ষণ, ডাকাতি, মিথ্যা মামলায় হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে নূর ইসলামের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সামছুদ্দিনসহ এলাকার সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে ওই চক্রটি। ওই চক্রটি ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় পরবর্তী সাতক্ষীরায় সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগ থাকলেও প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা সামছুদ্দিন।

এদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ থানাধীন দেওপুল গ্রামে বসবাসকারি কার্তিক দাস জানান, তিনি নকল কার্তিক দাস সাজিয়ে জাল দলিল সৃষ্টি করে নূর ইসলাম তার ভাইদের জমি থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টার বিষয়টি ঢাকায় অবস্থিত ভাÍতীয় হাইকমিশনকে একটি চিঠি লিখেছেন। এ মর্মে বারাসাত জুডিশিয়াল কোর্টের একটি এফিডেফিড দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে পাসপোর্টে বাংলাদেশে এসে সাতক্ষীরা কোর্টে জমি নূর ইসলাম বা কোন ব্যক্তিকে হস্তান্তর করেননি বলে এফিডেফিট করে দিয়েছেন। যার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, রাজনগর গ্রামের বলদেপাড়ার ওহাব ডাকাত পরিবারের সদস্য মৃত হেরাজতুল্লার ছেলে ইসমাইল সরদার, ইসরাইল সরদার ও নূর ইসলাম সরদার। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময়ে নূর ইসলাম ছিলেন ওই দলের সক্রিয় ক্যাডার ও গ্রাম সরকার প্রধান। ২০০১ সালে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর নূর ইসলাম জামায়াতের ছত্রছায়ায় এসে দলকে শক্তিশালী করতে অর্থযোগান ও পৃষ্টপোষকতা শুরু করেন।

ছাতিয়ানতলা গ্রামের জ্ঞানেন্দ্র নাথ দাসের কাছ থেকে দু’ একর নয় শতক জমি কিনে এক যুগ আগে থেকে সেখানে বসবাস শুরু করে নূর ইসলাম। জমি রেজিষ্টির পর বাকি থাকা ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে শালিস করে নয়জন ইউপি সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যান এমএ মজিদ শালিসনামায় সাক্ষর করে আজো ওই টাকা ফেরত পাননি জ্ঞানেন্দ্র। এরপর ১৯৮৬ সালে জ্ঞানেন্দ্র হাজরার স্ত্রী সন্ধ্যা রানী হাজরার আড়াই বিঘা জমি শার্শা সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের জাল দলিলের মাধ্যমে সম্প্রতি জবর দখলে নিয়েছেন নূর ইসলাম।

ঝাউডাঙা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯নং ওয়ার্ডের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাজী সামছুদ্দিন ও সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, ছাতিয়ানতলা গ্রামের শরৎ দাসের প্রথম স্ত্রী কার্তিক দাসকে নাবালক অবস্থায় রেখে মারা যান। শরৎ দাসের দ্বিতীয় স্ত্রীর পাঁচ ছেলে। কার্তিক দাস ১৯৬৪ সালে নাবালক অবস্থায় ভারতে চলে যায়। ভারতে বসবাসকারি কার্তিক দাসের পক্ষে নকল লোক সাজিয়ে ১৯৮১ সালে দাতা দেখিয়ে শার্শা থানায় পৃথক দু’টি জাল দলিল তৈরি করেন ইসমাইল সরদার ও ইসরাইল সরদার। দু’ ভাইকে জেল খাটানোর ভয় দেখিয়ে ১৯৮৮ সালে ওই জমি কাদের দালালের নামে এক বিঘা ও বাকী অংশ নিজের নামে লিখে নেয় নূর ইসলাম। এ ঘটনা জানতে পেরে হরিপদ দাস ও তার চার ভাই সাতক্ষীরা সদর সহকারি জজ আদালতে ৩১২/৮৮ নং দেওয়ানী মামলা করেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যস্ততায় দু’ বিঘা জমি ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে আপোষনামা লিখে নিয়ে আদালত থেকে এক তরফা রায় করে নেন নূর ইসলাম । পরে ওই জমি ফিরে পায়নি হরিপদ ও তার ভাইয়েরা। হরিপদ দাসদের জমি থেকে বঞ্চিত করতে একই জমির কয়েকটি কাল্পনিক দলিল তৈরি করে ১৯৯০ সালে নতুন মামলা করে নূর ইসলাম। অভাবের তাড়নায় হরিপদ আদালতে ঠিকমত হাজিরা দিতে না পারায় ১৯৯৬ সালে ও আপিল মামলায় ২০০৪ সালে নূর ইসলাম কার পক্ষে করে নেয়। ২০০৫ সালে জানুয়ারিতে নূর ইসলাম ডিক্রী পেলেও ২০১০ সালে জরিপদ ও তার ভাইদের পৈতৃক জমি থেকে উচ্ছেদ করে আদালতে মামলা ( দেঃ ৯৪/১০) করেন। ২০১০ সালে যোগরাজপুর মৌজার সরকারি হিসাব অনুযায়ি জমির শতক সাত হাজার ৬৬৩ টাকা হলেও ১৫ শতক জমির দাম পাঁচ হাজার টাকা উল্লেখ করে আদালতকে প্রতারণা করা হয়। বর্তমানে হরিপদ নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ আব্দুল হাফিজের আদালতে রিভিশন (১৫২৫/১৬) দাখিল করেছেন। বিচারক গত ১৫ মে শুনানী শেষে কেন রিভিশন মঞ্জুর করা হবে না তা জানতে চেয়ে নূর ইসলামের বিরুদ্ধে চার সপ্তাহের রুল জারি করেছেন।

একপর্যায়ে হরিপদ পৈতৃক বাস্তু ভিটার এক বিঘা ব্যতীত বাকি অংশ জবর দখল হয়ে যাওয়ায় পাগলপ্রায় হয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। এরপর থেকে শুরু হয় হরিপদ দাসের পরিবার ও তার ভাইদের উচ্ছেদের অভিযান। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জখম বর্তমানে জেল হাজতে থাকা মথুরাপুর গ্রামের মধু ও দেবনগরের মুকুল সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে মধু ও মুকুল অধিকাংশ সময় অবস্থান করতো জামায়াতের কুখ্যাত ক্যাডার নূর ইসলাম ও মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে তার জালিয়াতির হোতা রবিউল ইসলামের বাড়িতে। রবিউলের চাচাত ভাই সমছেল দীর্ঘ দিন ধীরেন হাজরার জমি জাল ডিক্রী করে মামলায় হেরে যান। এরপরও নূর ইসলামের পরামর্শে স্বামীর পৈতৃক ভিটা থেকে স্বর্ণলতা হাজরা ও তার সন্তানদের উচ্ছেদের যাবতীয় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন সমছেল ও রবিউল ইসলাম। এরপর নূর ইসলামের পরামর্শে বেআইনি জবরদখলের চেষ্টা অব্যহত রেখে ইয়াকুব আলীর ছেলে রবিউল, রফিকুল, শফিকুল ধীরেন হাজরার এক একর ৩৫ শতকসহ আরো ৪৫ শতক জমি ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাল দলিল সৃষ্টির মাধ্যমে দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হরিপদ দাসের বাড়িতে গেলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সামছুদ্দিন, পরিতোষ দাস, কার্তিক দাস, সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন জানান, অসহায় তিনটি পরিবারকে আইনসঙ্গত ভাবে উচ্ছেদ করতে না পেরে একের পর এক হামলা মামলা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গত বছরের ২৮ নভেম্বর স্থানীয়ভাবে বসাবসি হলে নুর ইসলামের বেহাই ঝিকরগাছা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাদশা চৌধুরী ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঔক্য পরিষদের সাতক্ষীরা শাখার সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য গোষ্ট বিহারী মণ্ডল, ঝিকরগাছা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দুলাল অধিকারীসহ বিশিষ্ট জনদের উপস্থিতিতে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীদ হয়। বাদশা চৌধুরী নিজে হরিপদ দাসদের দখলীয় বসত ভিটা সংলগ্ন জমি প্রায় এক বিঘাা চিহ্নিত করে দেন। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করার জন্য নূর ইসলাম ও তার ছেলে হুমায়ুন কবীর মিণ্টুকে নির্দেশ দেন তিনি। এরপর ও গত মে মাসের ১৪ তারিখে হরিপদ তার জমিতে কলা গাছ লাগানোর সময় হামলা চালায় নূর ইসলাম ও তার ছেলে মণ্টু। এরপর গতকাল জোর করে গাছের কাঁঠাল কেটে নেওয়ার সময় বাধা দিলে তাদেরকে চুরির দায়ে জেলে পাঠানের হুমকি দেয় নূর ইসলাম। হরিপদ দাস ও তার ভাইদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় তাকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করার কথা বলেন সামছুৃদ্দিন। নূর ইসলাম ও তার বাহিনীর হাতে একের পর এক নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেন হরিপদ দাসের স্ত্রী অর্পণা দাস, ছেলে কলেজ ছাত্র পলাশ দাসসহ স্থানীয়রা। হাইকোর্টে আপিল মামলার কারণ দর্শাণোর নোটিশ ও উচ্ছেদের মামলায় এক তরফা রায় করতে না পেরে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে নূর ইসলাম ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা।

তারা আরো জানান, ১৯৮১ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এমএ মজিদের নির্দেশে গ্রাম পুলিশ নুর ইসলামের বাড়ি থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি ক্রেস উদ্ধার করেন ( মেমো নং- ৬৪)। এ সময় নূর ইসলাম পাইপগানসহ অন্য অস্ত্র সরিয়ে ফেলেন। নূর ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারি রাস্তা দখল করা ছাড়াও বিরাজ গোসাইয়ের জমি জাল দলিল সৃষ্টিকারি সহোদর ইসমাইল ও ইসরাইলের কাছ থেকে নিয়ে মেয়েকে স্ত্রী সাজিয়ে হামজের আলীর সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় ডাকাতির অভিযোগে গ্রাম সরকার থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি গণপিটুনির শিকার হন নূর ইসলাম।(দৈনিক ইত্তেফাক)। ১৯৮২ সালের ১১ জানুয়ারি ডাকাতির অভিযোগে গণপিটুনি খান নূর ইসলাম। (দেশ হিতৈষী)। কয়েকদিন পর আনছারের স্ত্রী আলেয়াকে মারপিটের অভিযোগে গ্রাম সরকারের পদ হারান তিনি। এ ছাড়া নূর ইসলামের বিরুদ্ধে ঠিকাদার কার্তিক দাসের বাড়িতে ডাকাতি ও তার ছেলে সুমনকে অপহরণের পরিকল্পনা করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনার অভিযোগ করেন গ্রামবাসি। দত্তবাগের দেছারত আলী ও আনসার মুন্সি পরিবারের উপর অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে তার কাছে কমদামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করান নূর ইসলাম। সম্প্রতি নূর ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবেশি এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করে বিষয়টি কাউকে জানাজানি করলে তার মেয়ে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে বলে ওই মহিলাকে বিষয়টি গোপন রাখার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন ওই ভুক্তভোগী নারী। একইভাবে প্রতিবেশি দু’ নারীকে নিজের আম বাগানে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে নূর ইসলামের বিরুদ্ধে। তার চলে হুমায়ুন কবীর মিণ্টুর বিরুদ্ধে রাজনগরের এক এনজিও কর্মী নারীকে ব্লাক মেইল করে মেহেরপুরের এক যুবকের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পৈৃতক সূত্রে এক শতক জমি না পেলে আলঅদিনের চেরাগের মত তিনি কিভাবে কয়েক বছরের মধ্যে ৩৫ বিঘা জমির মালিক হলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী।

নূর ইসলামের বিরুদ্ধে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি বলে জানান তারা। জামায়াতের সক্রিয় কর্মী নূর ইসলাম ও তার সহযোগি রবিউল ইসলাম সহিংসতা সৃষ্টি করলেও বহাল তবিয়তে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে রয়েছেন বলে দাবি করেন এলাকার আওয়ামী লীগ ও পুলিশিং কমিটির কয়েকজন নেতৃবৃন্দ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নূর ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন।

(আরএনকে/এস/জুন ১৫,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test