E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পরিবেশ ইকোসিস্টেম নষ্ট হচ্ছে, ধবংস হচ্ছে মৎস্য সম্পদ

নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে চলছে চিংড়ী পোনা আহরণের মহোৎসব

২০১৬ জুন ২৪ ১৩:২৫:৫৮
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে চলছে চিংড়ী পোনা আহরণের মহোৎসব

বাগেরহাট প্রতিনিধি : সুন্দরবনসহ উপকুলের নদ-নদীতে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা আহরণের মহোৎসব চলছে। নিষিদ্ধ নেট, কারেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে দেদারছে এ পোনা আহরণ করায় নির্বিচারে মারা পড়ছে অসংখ্য প্রজাতির মাছের পোনা।

ম্যানগ্রোভ বনের অভ্যন্তরে অসাধু জেলেদের ধ্বংসাত্মক এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে বন বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু সদস্য। আর লোকালয়ে অবাধে চিংড়ি পোনা বিকিকিনির ক্ষেত্রে পুলিশের বেশ ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন কমছে মাছের প্রজনন ও উৎপাদন, অপর দিকে জলজপ্রাণীর পরিবেশের ইকোসিস্টেম নষ্ট হচ্ছে। এতে ধবংস হচ্ছে মৎস্য সম্পদ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের আশংকা এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই পরিবেশের বিপর্যয়সহ চরম হুমকির মুখে পড়বে এ অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ।

বর্তমানেসুন্দরবনসহ উপকূলে মাছের প্রজনন মৌসুম চলছে। এ মৌসুমে গভীর সমুদ্রে থেকে মা’ মাছ পোনা ছাড়তে চলে আসে সুন্দরবন উপকুলের নদ-নদীতে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি যে সব পোনা ছাড়ে এ পোনাই খাদ্যের সন্ধানে সুন্দরবনের অভ্যন্তর হয়ে চলে আসে স্থানীয় নদ-নদীতে। সুন্দরবনের খাল নদী-নালা হচ্ছে মাছের নার্সারী গ্রাউন্ড। অদক্ষ এবং অসাধু পোনা আহরনকারীরা ইচ্ছেমত ওই সকল নার্সারী গ্রাউন্ডগুলো ধংস করছে। আবার উপকূলীয় এলাকায় অবৈধ নেট, কারেন্টসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা আহরনের ক্ষেত্রে জালে আটকা পড়া হরেক প্রজাতির পোনার মধ্য হতে শুধুমাত্র বাগদা ও গলদার পোনা বেছে নিয়ে বাকী পোনা মেরে ফেলা হয়। এভাবে ১ টি পোনা আহরন করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য মাছের পোনা নিধন করা হচ্ছে।

বর্তমানে পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা, পশুর ও বলেশ্বর নদী, পশ্চিম সুন্দরবনের শিবশা নদীর শাখা প্রশাখার খাল ও চরাঞ্চালে জেয়ারের পানি উঠলেই নেটজালে ছেয়ে যায়। আর ভাটার সময় টানা নেট জাল নিয়ে চরাঞ্চলে নেমে পড়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু। নদীতে নেট জালের প্রাচীর ভেদ করে মংলা বন্দরে আগত বাণিজ্যিকসহ নদ-নদীতে সাধারণ নৌযানও চলাচল করতে পারছে না। অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে পোনা আহরন ও মাছ শিকারের ফলে দেশীয় জাতের মৎস্য সম্পদ নিধন হচ্ছে। বাগদা ও গলদার পোনা ধরার সময় নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছের পোনা।

একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব মতে, মংলাসহ পার্শ্ববর্তী শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, রামপাল, দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও কয়রাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু চিংড়ি পোনা শিকারে জড়িত। এসব অঞ্চলের গরীব ও অভাবী মানুষদের ব্যবহার করে রাতারাতি লাখোপতি সুন্দরবনে যাচ্ছেন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, আড়ৎদার ও ফড়িয়া। জেলে ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনের নদী ও খালে পোনা মাছ ধরতে বিভিন্ন টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীদের নিয়মিত মাসেয়ারা দিতে হয়। চাঁদা দিতে হয় সুন্দরবনের বিভিন্ন দস্যু গ্রুপকেও। দস্যুরা লোকচক্ষুর আড়ালে রাতে চাঁদা তুললেও প্রকাশ্য দিন ও রাতে জোয়ার হলেই ট্রলার নৌকা নিয়ে বনরক্ষীরা জেলেদের নৌকায় নৌকায় গিয়ে জাল প্রতি ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা উৎকোচ নেয়। আর লোকালয় যারা নেট জাল টানে এবং ঘাটে ধরে তাদের কাছ থেকে পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা ২০ থেকে এক শ’ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে এক শ্রেণির দালাল চক্র।

বাগেরহাট জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো. এমদাদুল হক জানান, নেটজাল ব্যবহার করে একটি চিংড়ি পোনা শিকার করতে গিয়ে জেলেরা কয়েক শত প্রজাতির মাছের পোনা নষ্ট করছে। যা আদৌ করা উচিৎ নয়। কারণ যে সব মাছ বা মাছের পোনা কিংবা জলজ প্রাণী মারা পড়ে প্রজনন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অন্য জলজ প্রাণীর জীবন ধারণের সংকট হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বিচারে পোনা শিকারে নদ-নদীর পানির পরিবেশগত ভারসাম্য ও ইকো সিস্টেম নস্ট হচ্ছে ।

পরিবেশবাদি সংগঠন সেভ দা সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, পোনা নিধনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীর মৎস্য সম্পদ বিনষ্ট হবে এবং আগামী এক দশকের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে দেশীয় মাছে আকাল দেখা দেবে। মৎস্য সম্পদ নিয়ে এসব শংকার কথা জানিয়ে তিনি মৎস্য সম্পদ রক্ষায় জলাভূমিতে নেটজালের ব্যবহার বন্ধসহ গণসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম জানান, নেটজাল ব্যবহার ও চিংড়ি পোনা শিকার আইন বিরোধী কাজ। তিনি বলেন, সুন্দরবন উপকূলের জনবসতির অধিকাংশ মানুষই গরীব। তাই নানা বাঁধা উপেক্ষা তারা পোনা মাছ শিকারে নেমে পড়ে। তবে বনের অভ্যন্তরে যারা আসে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। এছাড়া রিজাভ ফরেস্ট এলাকাসহ নদ-নদীতে যে সব জেলেরা পোনা ধরে তাদের ঠেকাতে কোস্টগার্ড ও পুলিশের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। আইনগত প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলছে এবং এটা চলমান প্রক্রিয়া। পোনা শিকারের প্রবনতা বন্ধে সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে জানিয়ে বন বিভাগের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এ পেশায় জড়িতদের বিকল্প কর্মস্থান ও তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

মংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানান, নেটজাল ব্যবহার করে সুন্দরবন উপকূলের নদ-নদীতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে। যা খুবই ক্ষতিকর। তিনি বলেন, নেটজাল ব্যবহার ও চিংড়ি পোনা শিকার বন্ধে কোস্টগার্ডের বিভিন্ন স্টেশন থেকে নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে জব্দ করা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা মূল্যের নেট জাল।



(এসএকে/এস/জুন২৪,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test