E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কায়সারের ইশারায় বেলুচ সৈন্য বড় বাপকে হত্যা করে

২০১৪ জুন ১১ ১৯:১২:৪৫
কায়সারের ইশারায় বেলুচ সৈন্য বড় বাপকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার : কায়সার এবং পাকিস্তানি সেনাদের দেখে আমি ও খালেক ভয়ে ধানের ডোলার নিচে লুকিয়ে পড়ি। ডোলার নিচ থেকে দেখতে পাই, তাদেরকে দেখে বড় বাপ কায়সার সাহেবকে সালাম দেন। তখন কায়সার সাহেব ইশারা দিলে তার পেছনে থাকা পাকিস্তানি বেলুচ সৈন্য বড় বাপকে গুলি করে হত্যা করে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন মো. ওমর আলী। তিনি কায়সারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ২১তম সাক্ষী।

বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন মো. ওমর আলী। তার সাক্ষ্যগ্রহণে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। এ সময় প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ এবং রেজিয়া সুলতানা চমন উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষ্য শেষে এ সাক্ষীকে জেরা করেন কায়সারের আইনজীবী এসএম শাহজাহান। জেরা শেষে বৃহস্পতিবার কায়সারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ২১তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার লোহাইদ গ্রামের অধিবাসী সাক্ষী মো. ওমর আলী কৃষিকাজ করেন। বর্তমানে তার বয়স ৬০-৬২ বছর। লেখাপড়া করতে পারেননি, তবে দস্তখত পারেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৭/১৮ বছর।

সাক্ষ্যে মো. ওমর আলী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ অথবা ১৫ মে সকাল ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে আমার খালুর ছোট ভাই (যাকে আমি বড় বাপ বলে ডাকতাম) হাজী নূর আলীর সঙ্গে তার বাড়িতে বসে গোস্ত-রুটি খাচ্ছিলাম। এ সময় বড় বাপ আমাকে বলছিলেন, পাকিস্তানি সেনারা মাধবপুর চলে এসেছে, তোমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমি বৃদ্ধ মানুষ, বাড়িতে থাকি। তোমরা নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যাও।

এ সময় আমার সঙ্গে থাকা আব্দুল খালেক দৌঁড়ে এসে বড় বাপকে জানালেন, পাকিস্তানি সেনারা পশ্চিম দিক দিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা এবং সৈয়দ কায়সার আমাদের বাড়ির ভেতর চলে এসেছে। আমাদের আর বড় বাপের একই বাড়ি।

সাক্ষী মো. ওমর আলী বলেন, কায়সার এবং পাকিস্তানি সেনাদের দেখে আমি ও খালেক ভয়ে ধানের ডোলার নিচে লুকিয়ে পড়ি। ডোলার নিচ থেকে দেখতে পাই, তাদেরকে দেখে বড় বাপ কায়সার সাহেবকে সালাম দেন। তখন কায়সার সাহেব ইশারা দিলে তার পেছনে থাকা পাকিস্তানি বেলুচ সৈন্য বড় বাপকে গুলি করে হত্যা করে।

সাক্ষী আরো উল্লেখ করেন, প্যারালাইসিসে আক্রান্ত খালু আকরাম আলী চৌধুরী তখন খালার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তখন তাকেও গুলি করে। তিনি হাতে গুলিবিদ্ধ হন।

এরপর দুপুর একটার দিকে কায়সার ও পাকিস্তানি সেনারা এলাকা ছেড়ে চলে গেলে বের হয়ে এসে তার বড় বাপরে লাশ দেখতে পান সাক্ষী। পাকিস্তানি সেনারা আবার আসতে পারে এ আশঙ্কায় আব্দুল খালেক, লোকমান হোসেনকে নিয়ে তিনি গ্রামের পূর্ব দিকের সীমানা বর্ডারের দিকে যাওয়ার সময় পথে মুক্তিযোদ্ধা ফুল মিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। তার সঙ্গে আরো ৫/৬ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

গ্রামের অবস্থা তাকে জানালে মুক্তিযোদ্ধা ফুল মিয়া তাদের গ্রামে নিয়ে আসেন। তখন মানুষ ছোটাছুটি করছিলেন এবং বলাবলি করছিলেন তাদের স্বজনদের হত্যা করা হয়েছে। এ সময় সাক্ষী ওমর আলী তার বড় বাপের মরদেহ ছাড়াও আব্দুল আজিজ, আব্দুল গফুর, জমির উদ্দিন, এতিমুন নেসা, আবদুল আলী ও তার মায়ের মরদেহ দেখতে পান।

ফুল মিয়ার নির্দেশে মরদেহগুলোকে সীমান্তের কাছে শাহনূর সাহেবের মাজারের কাছে নিয়ে দুইটি কবরে একটিতে পাঁচজন পুরুষ এবং অন্যটিতে এতিমুন নেসার মরদেহ সমাহিত করা হয় বলে উল্লেখ করেন সাক্ষী।

সাক্ষী মো. ওমর আলী বলেন, সৈয়দ কায়সারকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। ১৯৭০ সালে সৈয়দ কাযসার হাতি মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। তখন সাক্ষীর এলাকায় তিনি প্রচারণার কাজে আসতেন।

সাক্ষী বলেন, আমার বড় বাপের কোনো অপরাধ ছিল না। বাড়িতে মিটিং করার অনুমতি না দেওয়ায় কায়সার পাকিস্তানি সেনাদের দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। আমি কায়সারের বিচার চাই।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে হলে আসামির কাঠগড়ায় অভিযুক্ত কায়সারকে শনাক্ত করেন সাক্ষী মো. ওমর আলী।

গত ৯ মার্চ শুরুর পর এ পর্যন্ত কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও ২০ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা কাজী কবির উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী টিপু, কায়সার বাহিনীর সদস্য হাজী মো. তাজুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী পাঠান, কায়সারের অপরাধের শিকার একজন বৃদ্ধা নারী (ক্যামেরা ট্রায়াল), মো. ইয়াকুব আলী, শাহ হাসান আলী ফুলু মিয়া, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শাহ হোসেন আলী সাবু, শহীদপুত্র মো. মোস্তফা আলী, কায়সারের অপরাধের শিকার একজন সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), শহীদপুত্র মো. নওশাদ আলী, মুক্তিযোদ্ধা গৌর প্রসাদ রায়, মোঃ গোলাম নুর, মুক্তিযোদ্ধা মো. নায়েব আলী, আলহাজ নিশামন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন জামাল, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ফুলু মিয়া, বাসু সাওতাল, নায়েব আলী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স আব্দুল মোতালেব। তাদেরকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষ।

গত ৪ মার্চ কায়সারের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।

গত ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। কায়সারকে গণহত্যার একটি, হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ১৩টি এবং ধর্ষণের দু’টিসহ মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে এবং ২৬ ডিসেম্বর ও গত ১৩ জানুয়ারি অভিযোগ গঠন না করার পক্ষে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আব্দুস সোবহান তরফদার।

গত বছরের ১৪ নভেম্বর কায়সারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১০ নভেম্বর রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে ২ হাজার ৪শ’ ৪৭ পৃষ্ঠার এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, জেয়াদ আল মালুম, তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা চমন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ১৮টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্য থেকে ১৬টি অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়।

কায়সারের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ তদন্ত শুরু করে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর শেষ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম। ২২ সেপ্টেম্বর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেন তদন্ত সংস্থা।

তদন্তের স্বার্থে তদন্ত সংস্থা ১ সেপ্টেম্বর সৈয়দ কায়সারের ঢাকার বাসায় গিয়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত তিন ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে জামিন পেয়ে বর্তমানে রাজধানীতে ছেলের বাসায় রয়েছেন কায়সার। কায়সার হচ্ছেন দ্বিতীয় কোনো আসামি যাকে জামিনে রেখে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে।

গত বছরের ২১ মে বিকাল পৌনে চারটায় সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে হাজির করা হলে ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। পরদিন ২২ মে কায়সারের জামিন আবেদন খারিজ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে ১৫ মে প্রসিকিউশনের আবেদনের ভিত্তিতে কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহাকুমা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০/৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি সহযোগী বাহিনী গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফরমও ছিল।

কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান।


(ওএস/এটিআর/জুন ১১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test