E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্যামনগরের বাঘ বিধবার সুখ-দুঃখ, কুসংস্কারে দ্বিতীয় বিয়ে হয়না তাদের

২০১৬ অক্টোবর ০৬ ১৬:২৩:১৮
শ্যামনগরের বাঘ বিধবার সুখ-দুঃখ, কুসংস্কারে দ্বিতীয় বিয়ে হয়না তাদের


সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ‘আমারে বলিল জামা কাপড় পরিষ্কার কইরি রাখতি, বিকালে জঙ্গলে যাবে। আমি জামা-কাপড় পরিষ্কার করে রাখলি দুপুরে গরম ভাত খেয়ে ও আর ওর বাপ বাদায় যায়। বিকালেই জাইলেরা এসে খবর দেয়, ওর বাপ বনে (বাঘে হত্যা করেছে) পইড়িছে।

ছেলে ওর বাপকে নিয়ে রাতে বাড়ি আসে। বাপের শেষকৃত্য কইরি পরের দিনই দু’মুঠো ভাতের জন্যি ছেইলি আবার বাদায় চলি যায়।’ তাকেও বাঘে খায়। এসব কথা বলতে বলতেই চোখ ছল ছল করে ওঠে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালি গ্রামের জেলে পল্লীর বাঘ বিধবা সীতা রানী মণ্ডলের(৫৫)। সেই থেকেই নদীতে কাঁকড়া ও বাগদার রেণু ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।

শুধুই কি বিধবা ! ১৯৮৫ সালে স্বামী দুর্গাপদ মণ্ডলকে (বাঘের হামলায় নিহত) হারানোর সাথে সাথে কপালে জুটেছে নানা অপবাদও।

স্বামীকে বাঘে ধরলেই নানা রকম সামাজিক কুসংস্কার ঘিরে ধরে তাদের। শুনতে হয়, অপায়া, অলক্ষ্মীসহ নানা অপবাদ। অনেককে ছাড়তে হয় স্বামীর ভিটা। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন।

সীতা জানান, ছেলের বউ আছে। বনে গিয়ে যা পায়, তাতে তাদেরই চলে না। তাই নিজেকেও সবসময় ভাতের জন্য যুদ্ধ করতে হয়।

দু’মুঠো ভাতের জন্য পানখালী জেলে পল্লীর সীতা রানী মণ্ডল, হারু বালা, কমলা, ফুলবাসীদের মতো শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, রমজাননগর, মুন্সিগঞ্জসহ সুন্দরবন উপকূলের শত শত বাঘ বিধবার জীবন হয়ে উঠেছে ওষ্ঠাগত।

গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা বকুল বেওয়া (৬০) জানান, ঠিক কত বছর আগে স্বামীকে বাঘে নিয়ে গেছে তা মনে নেই তার। তবে, বছর ত্রিশেক আগে যে তিনি বিধবা হয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়। সেই সময়ই স্বামীর ভিটা ছাড়তে হয় তাকে। তারপর চকবারায় এসে বসবাস শুরু করেন সরকারি জায়গায়। নদীতে বাগদার রেণু ও কাঁকড়া ধরতেন। কিন্তু এখন আর শরীরে ‘জো’ নেই তার। ভিক্ষা করে জীবন চলে তার।
আর পাচুর স্ত্রী তিন সন্তানের জননী কমলা জানান, দুই ছেলে ও এক মেয়ের মুখে দু’মুটো ভাত তুলে দিতে সারাদিনই নদীতে থাকতে হয় তাকে। এতে দু’মুটো ভাত জুটলেও আর কোন কিছুই জোটে না তাদের কপালে। প্রত্যেক বাঘ বিধবার জীবন কাহিনী প্রায় একই রকম।

এই ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল প্রত্যেকেই। কিন্তু ভয়কে জয় করেই জীবিকার তাগিদে বাদায় (বনে) যেতে হয় তাদের। ঘটে একই ঘটনা। তারপরও কাজ না থাকায় সেই একই পথে পাড়ি জমান বনজীবীরা। আর বনদস্যুদের উৎপাততো রয়েছেই।

মুন্সিগঞ্জের বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের মতে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, রমজাননগর ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে ৫৩৭ জন বাঘ বিধবা রয়েছেন। এদের কারও কারও স্বামী সুন্দরবনে মধু, গোলপাতা বা মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কুমিরের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে।

স্থানীয় সুন্দরবন গবেষক পিণ্টু বাউলিয়া বলেন, শ্যামনগরের একটি অংশের মানুষ জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয় তারা। কখনও বাঘ কিংবা কুমির, আবার কখনওবা বনদস্যুদের দ্বারা। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ওইসব পরিবারের সতস্যরা। বিশেষ করে অল্প বয়সে বিধবা হলে তার আর কূল থাকে না। তাদের আর বিয়েও করে না কেউ। নানা সামাজিক কুসংস্কারে অত্যন্ত কষ্ঠে জীবনযাপন করে তারা।

এ সময় বাঘ বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার আহবান জানান তিনি।

শ্যামনগরের সুন্দরবন লাগোয়া বিড়ালক্ষী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সালেহ বাবু জানান, গত ৪/৫ বছরের মধ্যে নতুন করে এলাকার কেউ বাঘের আক্রমনে পড়েনি। তবে বাঘের থাবায় নিহতদের পরিবারগুলো দিন চলে অতি কষ্টে। তবে তাদের সামাজিক নিরপত্তা বেষ্টনির মধ্যে রেখে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকার সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

শ্যামনগর উপজেলার রাজবাড়ি ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক ইলিয়াছ আল মেহেদী বলেন, বাঘ বিধবারা আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছে। শিক্ষার অভাব থাকায় এখনো বিধবা পল্লীতে কুসংস্কার রয়ে গেছে। স্থানীয় ভাবে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।

বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল জানান, সুন্দরবন উপকুলবর্তী শ্যামনগরের চারিট ইউনিয়নের বাঘ বিধবা ও বাঘে আক্রান্তদের নিয়ে তিনি ২০০৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। ২৪০ জন বাঘ বিধবাকে কাপড়ের ব্যবসা, একোয়া কালচার, কাঁকড়া চাষসহ বিভ্ন্নি কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে অপফেরৎযোগ্য মুলধন দিয়ে ব্যাংক হিসেবের মাধ্যমে টাকা জমিয়ে তাদেরকে আত্ম স্বনির্ভরের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে শ্যামনগর উপজেলা সহকারি ভূমি কমিশনারের কাছে ৪০ জন বাঘ বিধবার জন্য সরকারি কাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত চার বছরেও তাদের এ উদ্যোগে সাড়া দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া এ পর্যন্ত ১৫ জন বাঘে ধরা বনজীবিকে তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎিসা দেওয়া হয়েছে।

শ্যামনগর উপজেলার সমাজ সেবা কর্মকর্তা শেখ শহিদুর রহমান বলেন, অসহায় বিধবাদের জীবনযাত্রার মানউন্নয়নে সরকারি ভাবে ব্যাপক প্রচেষ্টা চলানো হচ্ছে। উপজেলার অন্যান্য স্থানের মতো বাঘ বিধবাদের বিধবা ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। কুসংস্কার দুরীকরণেও বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন করা হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বলেন, পূর্বে বাঘ বিধবাদের পুনর্বাসনে কোন কর্মসূচি ছিল না। তবে, অতি সম্প্রতি তাদের তালিকা নিয়ে বয়সের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

(আরকে/এএস/অক্টোবর ০৬, ২০১৬ )

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test