E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জীবিত মালিকদের মৃত দেখিয়ে সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

২০১৬ নভেম্বর ১২ ১৭:৩২:২০
জীবিত মালিকদের মৃত দেখিয়ে সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

বাগেরহাট প্রতিনিধি : মংলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের দিগরাজ বাজার সংলগ্ন শেলাবুনিয়া গ্রামের ফুল কুমারী ওরফে ফুলমাল (৮০) নিঃসন্তান বৃদ্ধা অসুস্থ্য হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। স্বামী হরষিত মোড়ল মারা গেছেন প্রায় ৩০ বৎসর আগে। সহায়-স্পম্পত্তি বলতে যা কিছু ছিল তাও কেড়ে নিয়েছে স্থানীয় প্রতারক চক্র।

এ চক্রটি জীবিত ফুলমালকে মৃত দেখিয়ে ওয়ারিশ দাবি করে বিক্রি করে দিয়েছে তার শেষ সম্বল জমিটুকু। মংরা শিল্প এলাকায় শুধু ফুলমালা নয়, স্বামী রতন মোড়লের মৃত্যুর পর একই চক্রের খপ্পরে পড়েছেন বৃদ্ধা সাবিত্রি (৭০)। তাকেও মৃত দেখিয়ে মাথা গোজার ঠাই শেষ সম্বল ভিটামাটি বিক্রি করা হয়েছে ভুমি আগ্রাসি একটি কোম্পানির কাছে। সব কিছু হারিয়ে ভাই ব্রাজোন মন্ডলের বাড়িতে আশ্রিত এখন বৃদ্ধা সাবিত্রি। একই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান স্কুল শিক্ষক অভিনাষ চন্দ্র রায় (৯০) তার পৈত্তিক সম্পতি নিয়ে এখন চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছেন।

প্রতারক দালাল চক্র কেড়ে নিতে চাইছেন তার ভিটামাটিও। বিভিন্ন কোম্পানির কাছে জমি বিক্রির জন্য তাকে অব্যাহত হুমকি ধামকি ও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। তার মতো আরও অনেকেই এমন চাপের মুখে রয়েছেন। আবার বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্বও হয়েছেন আবার কেউ কেউ। মংলা বন্দর শিল্প এলাকা ঘিরে এখানে গড়ে উঠছে নিত্য নতুন উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর সেই সাথে বাড়ছে জমির দালাল ও প্রতারক চক্রের তৎপরতা। উপজেলার দিগরাজ ও বুড়িরডাঙ্গা কেন্দ্রিক কয়েকটি দালাল চক্র জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এ চক্রগুলোর অপতৎপরতায় একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি মুখে পড়ছেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা, অপর দিকে জমির প্রকৃত মালিকরা তাদের সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসছেন।

সরেজমিনে দিগরাজের শেলাবুনিয়া ও বিদ্যারবাওন এলাকায় গেলে অনুসন্ধানে উঠে আসে ভুমি খেকো দাদাল চক্রের অপকর্মের অজানা নানা তথ্য। নদী পথে ট্রলারে গিয়ে শেলবুনিয়া গ্রামে উঠতেই চোখে পড়ে পরিত্যাক্ত একটি বাড়ির উঠানে সাটানো বায়না সূত্রের মালিকানার সাইনবোর্ড। একই বাড়িতে গাছের সাথে একটি কোম্পানির সাইনবোর্ড সাটানো দেখা গেছে।

এ গ্রামের বাসিন্দা সুরঞ্জন মোড়ল জানালেন, মৃত গোবিন্দ মহলদারের পুত্র মানষ মহলদার সাইনবোর্ড সাটানো জমির প্রকৃত মালিক। কিন্তু জমি বিক্রির দালাল খ্যাত নীলকমল গাইন জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ কাঠা জমির বায়নাচুক্তি করেছেন সহযোগী দালাল সজল দাসের সঙ্গে। আর এ বায়নাচুক্তির কারণে তিনি কোস্পানির সাইনবোর্ড টানিয়েছেন বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা হয় মানষ মহলদারের সাথে তিনি জানান, লেখা পড়ার কারণে মা নমিতা মহলদারকে নিয়ে বর্তমানে খুলনায় বসবাস করছেন। তার অভিযোগ, ভুয়া কাগজ পত্রে তার পৈত্তিক সম্পতি আত্মসাৎ করেছেন নীলকমল গাইন নামের ভূমি দালাল চক্র। এ চক্রটি বেশ প্রভাবশালী হওয়ায় মুখ খোলার সাহস নেই তার পরিবারের কেউরও।

গ্রামের নদীর পাড়ের ভাঙ্গর কবলিত রাস্তায় হাটতেই একাধিক কোস্পনীর সাটানো সাইনবোর্ড দেখা যায়। কোথায়ও কোথায় সাইনবোর্ড দেখা মেলে ফসলি জমিতে, বসত বাড়িতে, বৈদ্যুতিক খুটি এবং নদীর চরে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি শুনে ছুটে আসেন গ্রামের অসংখ্য নারী পুরুষ। তারা সাংবাদিকদের জানালেন সংঘবদ্ধ দালাল ও প্রতারক চক্রের উত্থানের নৈপথ্যের কথা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বন্দর সংলগ্ন শিল্প এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠছে জমি বেচা কেনার একাধিক দালাল চক্র। এর মধ্যে শেলাবুনিয়া গ্রামে নীলকমল গাইন, শ্রীনিবাস বায়, সজল দাস, সুজয় বালা, বিষনু বৈরাগী ও দূর্গা বালা, র্নিমল রায় দালাল চক্র গং বেশ প্রভাবশালী। গ্রামের সনজিৎ রায়, সুজন রায়, কিশোরী শীল জানান, এ চক্রের সদস্যরা এলাকায় বেশ দাপট নিয়ে চলে।

সাধারণ মানুষের জমি-জমা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বেচা-কেনা করে থাকে তারা। বড় বড় কোস্পানি এ চক্রের মাধ্যমে ক্রয় করে জমি থাকে। আর এ জমির দালালী করেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন দালাল চক্রের সদস্যরা। তাদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়ে ভিটামাটি হারিয়েছেন গ্রামের অনেকে। আবার অনেক জমির মালিককে হুমকি ধামকিসহ নানা রকম চাপ প্রয়োগ করা হয়। অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অভিনাষ চন্দ্র রায় জানান, দালাল চক্রটি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রাতারাতি জমি-জমার কাগজপত্র বদলে দিতে পারে। তারা চাপ প্রয়োগ করে তাদের পছন্দ মত কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে থাকে। তাদের কথা মতো জমি বিক্রি না করলে জমির রেকর্ড, পর্চাসহ কাগজপত্র রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের কথায় যারা রাজি না হয় তাদের বসত ভিটার জমিও থাকে না।

তবে জমি বেচা কেনায় জাল জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন নীলকমল গাইন। তার দাবি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া জমি বেঁচা কেনা সম্ভব নয়। আর এ পর্যন্ত যত জমি বেচা কেনা করা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই বৈধতা রয়েছে। জাল-জালিয়াতি এ চক্রের সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রার, ভূমি অফিসের কর্মচারী ও ভূমি জরিপ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা জড়িজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা জানান, শেলাবুনিয়া গ্রামের মৃত দ্বারিকনাথ রায় মোড়লের দুই ছেলে রতন রায় মোড়ল ও ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল। রতন রায় মোড়ল মারা গেলে তার স্ত্রী সাবিত্রী রায় স্বামীর ওয়ারেশসূত্রে এক একর জমিওে স্বত্তবান (মালিক) হন।

এদিকে দ্বারিকনাথ রায় মোড়লের ভাই হরষিৎ রায় মোড়ল মারা গেলে তার স্ত্রী ফুল কুমারী ওরফে ফুলমালা ওয়ারেশ সূত্রে এক একর ২৬ শতাংশ জমির স্বত্ত্ববান হন। এই দুই নারী নি:সন্তা এবং তারা এ জমি ভোগ দখল করছিলেন। এ অবস্থায় মৃত রতন রায় মোড়লের ভাই ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল লোভের বশবর্তী হয়ে তার বিধবা বৌদির জমি প্রতারণার মাধ্যমে নিজ নামে নামজারি করিয়ে নেন এবং কাকিকে মৃত দেখিয়ে জাল কাগজপত্র তৈরী করেন। তিনি ওই দুই বিধবা নারীর দুই একর ২৬ শতাংশসহ মোট তিন দশমিক ২৮৩১ শতাংশ জমি গত পহেলা জুন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এক কোটি এক লাখ ১৮ হাজার টাকা মূল্যে (দলিলের বর্ণনা অনুযায়ী) কবলা দলিল করে বিক্রি করে দেন। জীবিত দু’বৃদ্ধাকে মৃত্যু দেখিয়ে জমি আত্মসাৎ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্র নাথ রায় ওরয়ে মোড়ল জানান, আমি আমার সম্পত্তি বিক্রি করেছি, অন্য কারো সম্পত্তি নয়।

তিনি আরও বলেন, আমি অশিক্ষিত লোক, দলিল যারা লিখেছে তারাই জানেন সবকিছু। তবে বেঁচে থাকা দু’বৃদ্ধার ভরণপোষন দিচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। জীবিতদের মৃত দেখিয়ে ওয়ারিশ সুত্রে জমি বিক্রির প্রসঙ্গে বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নিখিল চন্দ্র রায় জানান, জীবিতদের মৃত দেখিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন ওয়ারেশকাম সাটিফিকেট দেয়া হয়নি। তবে নিজের এলাকায় একাধিক দালাল ও প্রতারক চক্রের তৎপরতা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে আরও বলেন, বর্তমানে এলাকার প্রকৃত জমির মালিকরা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

জীবিত দু’বিধবা নারীকে মৃত দেখিয়ে যিনি দলিল লিখেছেন সেই দলিল লেখক শ্রী বিকাশ চন্দ্র মন্ডল জানান, কাগজপত্র সঠিক থাকায় তিনি দলিল লিখেছেন এবং রেজিস্ট্রার সম্পন্ন করেন। বিকাশ চন্দ্র মন্ডল আরো বলেন এ দলিল হয়েছে সাব রেজিস্টার অঞ্জু দাসের হাতে। এ প্রসঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রার অঞ্জু দাসকে খুঁজতে তার অফিসে যাওয়া হলে তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন বলে জানালেন অফিস সহকারীরা। জাল জালিয়াতির কাগজ পত্রে জমি ক্রয় করেছে যে কোম্পানি সেই কোস্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি রেজাউল করিম বলেন, কে মারা গেছে, আর কে বেঁচে আছেন তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কাগজপত্র সঠিক থাকায় বৈধ মালিকের কাছ থেকে জমি ক্রয় করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাছাই করেই সাব রেজিস্ট্রার দলিল কার্য সম্পন্ন করেছেন বলে তিনি দাবি করেন।

এদিকে জমির দালাল ও প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক এবং জেলা পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায়ের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।

(একে/এএস/নভেম্বর ১২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test