E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রানীনগরে বয়স্ক আর বিধবা ভাতার কার্ড বিতরণে বাণিজ্য!

২০১৬ নভেম্বর ১৫ ২৩:০৭:০০
রানীনগরে বয়স্ক আর বিধবা ভাতার কার্ড বিতরণে বাণিজ্য!

নওগাঁ প্রতিনিধি :অনিয়ম আর দূর্ণীতিতে ভরা রানীনগর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কার্যক্রম সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এখানে বয়স্ক আর বিধবা ভাতার কার্ড বিতরণে চলছে ঘুষ বাণিজ্য। ঘুষ দিলেই বয়স না হলেও পাওয়া যায় বয়স্ক ভাতার কার্ড এবং বিধবা না হলেও পাওয়া যায় বিধবা ভাতার কার্ড। এতে সরকার প্রদত্ত সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, প্রকৃত ভোক্তারা।

সরকারি বিধি মতে পুরুষের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬২ বছর বয়সের নিচে কেউ বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু এখানে তা মানা হয় না। এই সুবিধা পাবার কথা সমাজের অসহায়, গরীব ও অস্বচ্ছল মানুষদের। কিন্তু বেশির ভাগ স্বচ্ছল মানুষরাই ভোগ করছেন এই সুবিধাগুলো। বর্তমানে উপজেলার সমাজ সেবা অফিস দীর্ঘদিন যাবত কতিপয় কর্মচারীর হাতে জিম্মি হয়ে রয়েছে। অফিসের এক নারী কর্মচারীর নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে মেম্বার, চেয়ারম্যান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, একজন পুরুষ ও ১জন মহিলার দ্বারা তৈরি করা হয়েছে এক সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেট তাদের পছন্দ মতো ব্যক্তিদের অর্থের বিনিময়ে দেয়া হয় এইসব ভাতার কার্ড। যাদের মাধ্যমে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা উৎকোচ দিলেই বিধবা না হলেও বিধবা ভাতার কার্ড এবং বয়স না হলেও বয়স্ক ভাতার কার্ড প্রদান করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় ইউপি সদস্যরা জানান, তারা নিজেরাও বড় অসহায়। সমাজ সেবা অফিসে ঘুষ না দিলে কোন কাজ হয় না। আর ঘুষ না দিলেই দেখায় হাজারটা অজুহাত। তাই বাধ্য হয়েই গরীব মানুষদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাদের ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, একই পরিবারের সকল সদস্য দীর্ঘদিন যাবৎ কোন না কোন ভাতার সুবিধা ভোগ করছেন। বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য বড় ভাইকে বাদ দিয়ে ঘুষের বিনিময়ে ছোট ভাইকে দেয়া হয়েছে বয়স্কভাতার কার্ড। এমনও পরিবারে দেখা গেছে, স্বামী পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা একই সঙ্গে স্ত্রীও পাচ্ছেন বিধবা ভাতার টাকা। কেউ প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গু না হলেও পাচ্ছে প্রতিবন্ধী ভাতার সুবিধা।

উপজেলা সদরের পশ্চিম বালুভরা গ্রামের মোট ৭০ টি পরিবারের মধ্য ৩৫ থেকে ৪০টি পরিবারই বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতার সুবিধা ভোগ করে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। যে পরিবারের অধিকাংশ মানুষই আর্থিক ভাবে সচ্ছল আর বসবাস করছে ইটের তৈরি পাকা বাড়িতে। অথচ প্রকৃত সুবিধা ভুগিরা ঘুষ না দেয়ার কারণে এই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে, পশ্চিম বালুভরা গ্রামের মৃত-পবন আলীর ছেলে ময়েজ উদ্দিনের বয়স মাত্র ৩৫ বছর। সরকারি নীতি অনুসারে সে বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য না হলেও সে দীর্ঘদিন যাবৎ বয়স্ক ভাতার সুবিধা ভোগ করে আসছেন। একই গ্রামের মৃত-বাদেশের ছেলে আজিজার রহমান (৫০), মখলেছুর রহমানের স্ত্রী মর্জিনা (৪০) সহ অনেকেই স্থানীয় আয়েন শাহের ছেলে আনিছুর রহমানের মাধ্যমে সমাজ সেবা অফিসের কর্মচারী নাসরিন পারভীনকে ঘুষ দিয়ে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার কার্ড করে নিয়েছে।

একই গ্রামের মৃত-গোনা শাহের ছেলে আফতাব হোসেন (৫০) পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা ও তার স্ত্রী মাজেদা (৪০) পাচ্ছেন বিধবা ভাতার টাকা। এমন অভিযোগ বিস্তর। ওই গ্রামের গফুর শাহ (৭৭) আক্ষেপ করে বলেন, আমার আগে আমার মেয়ে কি করে বয়স্ক ভাতা পায়? আমি সমাজ সেবা অফিসের নাসরিনের কাছে ৭ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে সম্প্রতি বয়স্ক ভাতার কার্ড পেয়েছি। কিন্তু এখনো আমি বয়স্ক ভাতার টাকা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারিনি। নাসরিন আমার ভাতার টাকা থেকে তার ঘুষের টাকা কেটে নিয়েছে। আমি তাকে ঘুষের বাকি ২২শ’ টাকার মধ্যে ২শ’ টাকা কম দিলে সে আমার টাকা ছুড়ে ফেলে দেয়। একই গ্রামের লজে শাহ্( ৬৫) জানান, আমার ছোট ভাই বয়স্ক ভাতা পেয়েছে, কিন্তু আমি স্থানীয় মেম্বারকে ৫হাজার টাকা দিতে পারিনি বলে আমার ভাতা হয়নি। মোজাফ্ফর হোসেন ( ৬৫) জানান, শতবার আমি এই অফিসের নাসরিনের কাছে গিয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি। সে আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ চায় কিন্তু আমি গরীব দিনমজুর এত টাকা ঘুষ দিব কোথা থেকে। তাই আমার ভাতার কার্ড হয়নি। অথচ আমার ছোট ভাইয়েরা মেম্বারকে ঘুষ দিয়ে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে নিয়েছে।

উপজেলার কাশিমপুর ইউপির চকাদিন গ্রামের দিনমজুর শরিফুল ইসলামের শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে মোছা: মোহিনী আক্তার (৮) আট বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত কোন প্রতিবন্ধী ভাতা পায়নি। একই গ্রামের কমল কুমার দাস (২৮) ও সিমা দাস (২৪) দুই ভাই বোনই জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধি। সম্প্রতি কমল কুমার দাস প্রতিবন্ধি ভাতা পেলেও সিমা দাস এখনও পর্যন্ত কোন সুযোগ সুবিধা পায়নি।

এই বিষয়ে সমাজ সেবা অফিসের ইউনিয়ন সমাজ কর্মী মোছা: নাসরিন পারভীন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় এমপির ও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি দল আছে। সেই দল আমাদের কাছে যে তালিকা দেন সে অনুসারে আমরা কার্ড বিতরণ করি। তাদের দেয়া তালিকা যাচাই-বাচাই করার অধিকার আমাদের নেই। আর অফিসে যা কিছ(?) হয়ে থাকে তা এই অফিসের সবাই জানেন। এছাড়া প্রাপ্ত বরাদ্দ ফিরিয়ে না দিয়ে এলাকার মানুষকে দেয়া হয়েছে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান জানান, এই সব অনিয়ম-দুর্নীতি দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছে। তাদের এই সব কাজ আমি করতে না চাইলে তারা আমাকে বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধামকী ও ভয়ভীতি প্রদান করে। বিষয়গুলো উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় অনেকবার আলোচনা হয়েছে ।

(ওএস/এস/নভেম্বর ১৫, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test