E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘সাংবাদিকরাই মনে করিয়ে দেয় ২৩ এপ্রিলের কথা, আর কেউ খোঁজ রাখে না’

২০১৭ এপ্রিল ২৩ ১৩:৩৭:৫০
‘সাংবাদিকরাই মনে করিয়ে দেয় ২৩ এপ্রিলের কথা, আর কেউ খোঁজ রাখে না’

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : সারা বছর চলে যায় কেউ খোঁজ খবর রাখে না, কিন্তু এপ্রিল মাস এলেই আর কেউ না আসলেও সাংবাদিকরাই আমাদের খোঁজ নিতে আসে। সরকার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করছে, কত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে অনেকে। ৭১’ সালে পাক হানাদারের হাতে আমার স্বামী প্রাণ হারালো। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হয়েও এখনো মানুষের জমিতে দিন মজুরের কাজ করতে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জোটেনি বিধবা ভাতাসহ সরকারি সুবিধা। এভাবে কষ্টের কথা গুলো বলছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা শুখানপুকুরী এলাকায় গণহত্যার শিকার স্বামী গাঠু রামসহ স্বজন হারা শুসিলা বেওয়া।

আজ ২৩ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা দিবস। এই দিনে আশপাশের ৫শ’ স্বাধীনতাকামী যুবককে ধরে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করিয়ে পাথরাজ নদীর পাড়ে রাজাকারদের সহায়তায় হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী তাদের হত্যা করার পর বিধবা স্ত্রীদের ওপর চলে সীমাহীন বর্বর নির্যাতন। জাটিভাঙ্গায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার এ দেশীয় দোসররা একই সঙ্গে ৩ হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

এখানেই ঘাতকের গুলিতে জগন্নাথপুর, শুকানপুকুরীসহ আশে পাশের প্রাণ হারায় প্রায় ৩শ’ বিধবার স্বামী ও স্বজনরা। ওই সকল শহীদদের বিধবারা আজও ৪৬ বছর ধরে কাঁদছে। কিন্তু তারা পায়নি তাদের স্বামী হত্যার বিচার ও স্বীকৃতি। এই কান্না বুকের মধ্যে চেপে রেখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের দুঃসহ বোঝাকে। একদিকে স্বামী হারানোর বেদনা আর অন্যদিকে জীবন যাপনের যন্ত্রণা-এ নিয়ে করুন কষ্টে তারা পার করছে দীর্ঘ ৪৬টি বছর।
এদের মধ্যে অনেক বিধবা চিকিৎসার অভাবে পরলোক গমন করেছেন। আর বাকী শহীদের স্ত্রী বর্তমানে দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন অর্ধাহারে অনাহারে। কর্মক্ষমতা হারিয়ে সেই সব বিধবাদের অনেকেই অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। যারা বেচে আছেন তারা কেউ ভিক্ষা করে, কেউ বা দিন মজুরের কাজ করে নিজের জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

মৃত্যু পথযাত্রী কান্দরি বেওয়া বলেন, “স্বামী হারিয়ে সন্তান নিয়ে সহ্য করেছি অনেক কষ্ট। দু’চোখে জল ঝরতে ঝরতে আজ অন্ধ হয়ে গেছি। খেয়ে না খেয়ে কোনো মতে দিন পার করছি। তবু সেই রাজাকারদের বিচার চাই। দু’চোখে দেখতে না পারলেও রাজাকারদের বিচার হলে শান্তি পাব।”

জাঠিভাঙ্গা বুড়াশিব গ্রামের ভুটরী বেওয়া অভিযোগ করে বলেন, “একটি বিধবা ভাতার কার্ডে ৩ মাস পরপর মাত্র ৯শ টাকা পাই। এ দিয়ে কি সংসার চলে? আর শীতের মৌসুম এলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাই একটি কম্বল। সারা বছর আর কেউ কোনো খবর রাখে না।” আমরা শেষ বয়সে একটু সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে মরেও শাস্তি পাবো।

ঠাকুরগাঁও ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদিউদ্দৌজা বদর জানান, গণহত্যায় সকল শহীদদের বিধবাদের স্বীকৃতির জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সরকার বিষয়টি নজরে নেননি। আমরা সকলে চাই ওই সকল বিধবাদের স্বীকৃতি ও তাদের স্বামী হত্যার বিচার।এই পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হোক সরকারের কাছে এমন অনুরোধ করেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান তৈমুর রহমান।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার শহীদের পরিবার গুলোর স্বীকৃতি ও সরকারি সুযোগ সুবিধা বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবো।

জগন্নাথপুর গড়েয়া শুকানপুখরীসহ ৪টি ইউনিয়নের অসহায় এই বিধবাদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি পাক-হানাদার বাহিনী সে দিনের দোসর স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হোক এ দাবি ঠাকুরগাঁওবাসীর।

উল্লেখ্য, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুখানপুখুরি ইউনিয়নের জাটিভাঙ্গা গ্রাম। একাত্তরের ২৩ এপ্রিল ভারতে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে স্ত্রী সন্তান সহায়-সম্বল নিয়ে রওয়ানা হয়। ভোরের দিকে স্থানীয় রাজাকার তাদের পথরোধ করে টাকা পয়সা সোনা গয়না লুট করে নেয়। এরপর তাদের সবাইকে ঐ গ্রামে আটক করে রাখে। পরে রাজাকারেরা পাকসেনাদের খবর দেয়। পাকবাহিনী এসে বেলা ১০টার দিকে ৫ শতাধিক লোককে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাস ফায়ার করে পাখির মতো হত্যা করে। আশপাশের লোকজন দিয়ে লাশ নদীর পাড়ে স্তূপ করে মাটি চাপা দেয়। পরে তাদের যুবতী স্ত্রীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। যারা সহজে রাজি হয়নি তাদের অনেককে গুলি করে।
(এফআইআর/এসপি/এপ্রিল ২৩, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test