E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চেয়ে দেখো ওই তো মুক্তির পথ, গোধুলি বিদায়

২০২১ জুলাই ৩১ ১৬:৪৯:৫৫
চেয়ে দেখো ওই তো মুক্তির পথ, গোধুলি বিদায়

পিযুষ সিকদার


নাজনীন সাথী বারোটা গল্প নিয়ে সাজিয়েছেন তার ‘আমাজান লিলি’ গল্পগ্রন্থটি। তার নিজের জীবনের যে অভিজ্ঞতা তা বড় পর্দার সিনেমাকেও যেনবা হার মানায়। বারোটি গল্প-এ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের পদধ্বনি শুনি। তাদের পদভারে লেখকের সমাজ মনস্কতা অথবা প্রকৃতির সুন্দর রূপে অথবা কারুকাজে নকশি কাঁথা হয়ে ওঠা সুইয়ের মতো এঁকে বেঁকে লাল নীল সবুজ সুতোর এক বর্ণিল জীবন গাথা খুঁজে পাওয়া যায় সবকটি গল্পে। গল্পের ভেতরে ডুব দিয়ে দেখি প্রকৃতি ও মানুষ-এর এক অভিন্ন রূপ। নাজনীন সাথীর প্রথম গল্প ‘ফিরে দেখা ১৯ এপ্রিল’ একটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের গল্প। যা তার নিজের জীবনেই ঘটেছে। কিন্তু লিখবার অসাধারণ কাব্যবর্ণনায় এ যে প্রত্যেক পাঠকের নিজের গল্প।

গল্পকার লিখছেন ‘মানুষের স্বপ্নগুলো মানুষের মনেই বিরাজ করে আর দুঃস্বপ্নলোই প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। স্বপ্নর মনে হয় অ্যান্টার্কটিকা বাদে ছয়টি মহাদেশের কোথাও না কোথাও ১৯ এপ্রিলের পূনরাবৃত্তি ঘটছে। ১৯৭১ সালে তাদের জীবনে যেমনটি ঘটেছিল।’ এ যে গল্পকার তথা স্বপ্নর ঘটে যাওয়া অতীতকেই জানান দিয়ে যায়। গল্পকার নিপূণ দক্ষতায় প্রকৃতি ও চরিত্রের ছবি এঁকছেন। ‘সাজু রাজুর মা ও ঢ্যাঙ্গা নারকেল গাছ’ গল্পে প্রকতির বর্ণনা দিচ্ছেন চারপাশের বাতাস যেন কারো শোকে এক মিনিট নিরবতা পালন করছে।’ আবার বলছেন ‘মানিপ্লান্টের ঝাড় অদম্য জীবনবোধ নিয়ে কঠোর স্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে হাসছে।’ আবার বলছেন ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে মমতাজের জীবনের আঁধারও বুঝিবা।’ অন্য পৃষ্ঠায় লিখছেন‘বাতাস শান্ত হয়ে এলে সবার খ- খ- ধারা বর্ণনা একত্রিত করি।’

এই যে বর্ণনা পাঠককের কাছে অতীত থেকে বর্তমান অথবা বর্তমান থেকে অতীত হয়ে ধরা দেয়। উপমার পর উপমা দিয়ে এক গভীর জীবনবোধ এঁকে যান প্রতিটি গল্পের পরতে পরতে। শুধু যে জীবনবোধ আঁকেন তা নয়। এর সাথে যুক্ত হয় রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি তো আছেই। প্রতœতাত্ত্বিক উপায়ে হৃদয়ের গভীর থেকে টেনে আনেন চরিত্র সকল। তার রচিত চরিত্রগুলো হাসে কাঁদে কথা বলে, কখনো প্রতিবাদী কখনোবা নিরব। ‘অদলবদল’ গল্পে উঠে আসে নানান চিত্রপট। আসমা জামান কী রেহানকেই খুঁজে পান তার অস্তিত্বে? তাইতো আসমা জামান বলেন, ‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানো? শরনার্থী শিবিরে আামার ছেলেটা কারো সঙ্গে বদল হয়েছে। আমি ওর মা নই, পালন করেছি মাত্র।’ এ কথাটা রেহানের কানে বাজে নানা সুরে। ভাবে আর মিলাতে চেষ্টা করে। সব সত্য কী ধরা যায় এক জীবনে।

এই গল্পগ্রন্থ আমাদের যাপিত জীবনের এক মহাগ্রন্থও বটে। প্রত্যেকটা চরিত্র লেখকের স্পর্শে না পাওয়া ও পাবার যৌথ সম্মীলন যেনবা! ‘আমি কান্তার জন্য কাঁদি। ভীষণ কষ্ট লাগে আমার কিন্তু যখন দেখি জামানকে ছু মেরে উড়িয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে। তার চিরচেনা আল পথ ধরে। বহু পিছনে পড়ে থাকে জামান।’ ইবসেনের নোরা জানতো না সে কোথায় যাবে কিন্তু নাজনীন সাথীর কান্তা জানে সে কোথায় যাবে। নাজনীন সাথীর লেখায় উঠে এসেছে ভাঙা মানুষ ও ভাঙা মনের এক যুথবদ্ধ মহাকাব্য। সেখানে বীরেরাও আছে, আছে প্রকৃতিও। সব মিলে মিশে একাকার। এ গল্প বিশেষ এই জন্য যে, নিয়তি না মেনে নিয়ে এগিয়ে গেছে জীবন যাপনে। আমরা কান্তার জন্য কষ্ট হয়। তা স্বপ্ন চিনে মাটির থালের মতো খান খান হয়ে ভেঙে যায়। জামানকে দোষ আমি দেই না। জামানরা ওরকমই। এ সমাজ সংসারে আধিপত্য করে জামানের মত অর্ধ শিক্ষিতরা। তারপর যা হবার তাই হয়। ‘রাত বাড়ে কিংবা কমতে থাকে রাতের আয়ু।’

এই যে শব্দকে নিয়ে খেলবার ক’জনইবা পারে। সম্পর্কের টানাপোড়েন কখনও প্রকৃতিও থমকে দাঁড়ায়। প্রকৃতিও এ গল্পে একটা ভাইটাল চরিত্র। মানুষের সাহস প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে চলে। কান্না হাসির ভ্রমনে এ যেন সাহস রথ। নিয়তি নামক বড় একটি চরিত্রই লেখক তার স্বভাবগত বা সহজাত নিরীক্ষায় বাদ দিয়েছেন। বলতে গেলে, প্রেম সেই সাথে প্রেমহীনতার গল্প ‘আমাজান লিলি’ একের পর এক দৃশ্যপট। মাথার ভিতের ফিল্মের ফিতা হয়ে দৌড়ায়। দৃশ্যপটের বিপরীতে কথার যে যাদুকরী প্রকাশ সে এক বাস্তবতা থেকে অন্য বাস্তবতায় নিয়ে গিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় পাঠককে। ‘আমাজান লিলি’ গল্পগ্রন্থে বঞ্চিত মানুষ, নিম্নবিত্ত মধ্যবর্তী ও মধ্যবর্তী মানুষের পদ সঞ্চালনে মুখরিত। কেউ পড়ে আছে মুখোশ, কেউবা সাদা মনের মানুষ হয়ে ঠকে।

আবার কেউবা স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে চলে ভিন্ন ভাবনা ডানায়। বইয়ের পাতায় পাতায় প্রকৃতি যেন বর্ণনা করে সকল চরিত্র। ছোট ছোট গল্পে অথবা অনুগল্পে মহাকাব্যিকতার অনুরণন তোলে। ফিরে দেখা ১৯ এপ্রিল লেখক এক নিমিষেই বলে যান, ‘মানুষের স্বপ্নগুলো মানুষের মনেই বিরাজ করে আর দুঃস্বপ্নগুলোই প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। হঠাৎ চমকে দিয়ে বলে উঠেÑ ফটিক জল। পাখিটি কী বিথীর কান্না বোঝে। নাকি কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত চরিত্ররা হয়ে ওঠে নীল। নীলের বিপরীত পিঠে বেদনাশ্রিত সুখেরা পাখা ঝাপটায়’ অদলবদল গল্পে। ‘আমাজান লিলির খোঁজে’ গল্পে শুরুটাই বলে দেয় লেখকের চমৎকার শব্দনৈপূণ্যে, ‘কদিন একটানা বৃষ্টির পর আজ যেন স্বচ্ছ আকাশ, মেঘ নেই বললেই চলে।

বাড়ির পাশের কদমগাছের মাথায় ফুলগুলো আড়মোড়া ভেঙ্গে মাথা তুলেছে। বৃষ্টি কাদায় একাকার ক’দিনে কান্তার সুতি শাড়ি পড়বার উপায় ছিলে না।’ কান্তা কী নিজেকে খুঁজে ফিরে নাকি খোঁজে জামানকে! এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে জামানকে ভালোবেসেছিল। ভালবাসায় টান লাগে। ছিঁড়ে যায় পুরোনো মন চিঠিগুলো! কিন্তু কান্তা কষ্ট পেলেও সমস্ত ভুল মাড়িয়ে সামনের দিকে এগোয়। জামান বলে, ‘তুমি আমার উপর অভিমান করেছো? দু’হাতে জড়িয়ে ধরে জামান। টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ে অভিমান কৈশোরের ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের চুড়ির মতো।’ আবার গল্পকার লেখেন, ‘তীব্র অনুভূতির উষ্ণতায় গলতে থাকে দু’জন।’ এ এক অসাধারণ কাব্য কথন। এই যে অভিমানগুলো কিশোরকালের কাঁচের চুড়ির মত ঝন ঝন করে ভেঙ্গে যায় মানব-মানবীর সম্পর্কগুলোও তো এমনই হয়। ‘চে’র ছবি সম্বলিত সেফটিফিন’ গল্পে চেতনে হোক অবচেতনে হোক লেখক নিজেরই গল্প এঁকেছেন। মুন্সিয়ানা এখানেই নিজের অপূর্ব ভাষা সুষমায় প্রকাশ করেছেন।

‘আমাজান লিলি’ গল্পগ্রন্থে লেখক দারুণ ভাষাশৈলিতে একের পর এক গল্প বুনে চলেছেন। সেখানে আছে প্রেম, আছে ভালবাসা, কষ্ট, বেদনা, হাসি-কান্না কখনোবা উঠে এসেছে রাজনীতি। প্রকৃতিকে কী সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন। চরিত্রের মানস গঠন করেছেন। সেখানে প্রকৃতি ধরা দেয় কখনো মেঘ হয়ে, কখনো বৃষ্টি হয়ে , কখনো রোদ হয়ে। এই বইটি নিত্য দিনের পাওয়া-না পাওয়ার গল্প। আবার দেখিবা ‘চে’র ছবি সম্বলিত সেফটিপিন’ গল্পে মানুষের মুক্তি সংগ্রামের গল্পও উঠে এসেছে। ‘সাশা পা বাড়ায় মানুষের মুক্তির জন্য চেনা সংগ্রামের অচেনা গন্তব্যে...।’

অচেনা গন্তব্য থেকে ফিরে আসে সাশারা। সাশার কী চায়! অথবা চাওয়াই নেই কোনো। মানুষের জন্য দেশের জন্য সাশারা যায়। শেষ পর্যন্ত সাশারা কী পারে যাদের জন্য এই সংগ্রাম তাদের পেটে দুবেলা খাবার দেবার? তবু সাশারা যায় মুক্তি সংগ্রামে। যাক। অন্যরূপে পারে না। মোহযুক্ত হয়ে বিযুক্ত করে নিজেকে সমাজ থেকে। তারপর স্বপ্ন এই যে, সাশারা পারবে। পারতেই যে হবে।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test