E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পতাকা

২০১৪ সেপ্টেম্বর ২৯ ১১:০১:৪৮
পতাকা

| রাজীব চৌধুরী |

ডুকরে ডুকরে কান্না পাচ্ছে নুরির।
কান্নাগুলো এতোক্ষন জমা হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে যাবে। খানিকটা বুকে চেপে হামাগুড়ি দিলো নুরি। উদ্দেশ্য সামনে উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখা লাঠিটার কাছে যাওয়া। কিন্তু সে পারছেনা। অনেকদুর এগিয়ে এসে ও সে এখন অসহায়ের মতোন পড়ে আছে।
কান্নার দমক ঠোঁট চেপে বন্ধ করে রাখতে চাইছে।
দিপু বলেছিল যদি একবার- যদি একবার কাজ টা করা যায় তাহলে শেষবার প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে।
দিপু নিথর দেহে পড়ে আছে। ওর শরীরে খানিক আগেও প্রাণ ছিল। বারো বছরের ছেলেটা দুনিয়াটা ভাল করে দেখার আগেই অন্ধকার মৃত্যুর স্বাদ চেখে নিয়েছে নিমেষে। একটা বুলেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে ওর বুক। হৃদপিন্ড। নুরি চেয়ে চেয়ে দেখেছে। হাতে ছিল তখন একটা দুই ব্যাটারির ট্রানজিস্টার। সেটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। সেলাইয়ের মেশিনটা ফেলে রেখে ফ্যালফ্যাল চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ওখানে পড়ে আছে দিপু। হাত একটা কাপড়। সে কাপড়টা সবুজ থেকে সবুজাভ হয়ে লেপ্টে আছে ঘাসের উপর।আর দিপুর বুকের রক্তে লাল টকটকে হয়ে গেছে হলুদ ফুলটা। কাপড়ের উপর আঁকা হলুদ ফুল। চারপাশে রক্ত। রক্ত নাকি কাপড়টাই এমন?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল নুরি। চোখে ভ্রম। কি এটা? দেখতে এমন? কি ?
পতাকা?
শুনেছিল এ কাপড়ের টুকরোটা নিয়ে জীবন দিচ্ছে শত শত প্রাণ। তাহলে কি এটাই সেই কাপড়? এত ক্ষমতা এর? মোহগ্রস্থ মানুষ গুলো টপাটপ মৃত্যুবরণ করছে এর জন্য?
নুরি এগিয়ে যায়।
হামাগুড়ি দিয়ে।
ক্রাচ দুটো বগলে চেপে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে ভয়ে লুকোতে হয়েছে। ঘরের একপাশে হায়েনাদের ক্যাম্প। স্কুল ঘরে ক্যাম্প ফেলেছে ওরা। নুরির বাবা নেতৃত্ব দিয়েছে হত্যাকারীদের। আর নুরি চেয়ে চেয়ে দেখেছে। বোবা মেয়েটার দুটো পা নেই। মুখে রব ও নেই। বোবা সে। কিন্তু কান্নার সময় মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয়। এখন সেই শব্দ বেরোতে চাইছে। কান্না? নাকি চিৎকার?
ওতে কি ঘেন্না মেশানো? নাকি ভয়?
ভাবতে পারেনা নুরি। দুইহাতে হামাগুড়ি দিয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে যায়। স্কুলঘরের পতাকা লাগানোর দন্ডটা কয়েকমাইলের ও বেশি দূরে বলে মনে হয় ওর কাছে। হাতে কাপড়টা আরো বেশি ভারি বলে ঠেকে। ধীরে ধীরে সুর্য ডুবতে শুরু করেছে। বাইরে বোমার শব্দ। এদিক ওদিকে চিৎকার। স্কুলঘরের ভেতর আরো বেশি জোড়ে চিৎকার হতে থাকে। কতগুলো মেয়েকে নুরির বাবা ধরে এনেছে। ওদের সাথে হায়েনাগুলো সহবৎ করছে। কাউকে খুন করছে। কাউকে ধরে পেটাচ্ছে। কাউকে ঝোলাচ্ছে দড়িতে। ওদের কান্না আর চিতকারের মাঝে তফাৎ খুঁজে পায়না নুরি। কিন্তু নুরিকে এগিয়ে যেতে হবে। সন্তর্পনে।
বিকেল থেকে সবুজ কাপড়টার মাঝে লাল বৃত্ত এঁকেছিল। এখন বুঝতে পেরেছে ওতে একটা হলুদ ফুল আঁকা। বাংলাদেশের ফুল। জয়বাংলার ফুল। সেই ফুলের সীমানা ছাপ্পান্নোহাজার বর্গমাইল। দিপু বলেছিল। আরো বলেছিল এটা আছে। দিপু শুনেছে। কিন্তু কখনো দেখেনি। আজকে দেখতে পেয়ে কাপড়টা এনেছিল নুরির কাছে। কিন্তু পুরো পুরি পারেনি। ধরা পড়ে গেছে সে। এরপর মৃতের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে। এর মাঝে কত মরেছে? কয়েকশ? নাকি কয়েকহাজার? নুরি ভেবে পায়না। মেরে ফেলা এতো সহজ আগে জানতো না সে। এখন বুঝে। কিভাবে নিজেকে মেরে ফেলে ওরা। ওদের বলে মুক্তি। ওদের জন্যে ধীরে ধীরে কোনঠাসা হায়েনারা এখন আরো দিশেহারা। ভাবতে ভাবতে নুরি আরো খানিকটা এগিয়ে যায়।
সেলাই মেশিনে নিখুঁত শিল্প তৈরি করেছে নুরি। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত। এর মাঝে হলুদ ডোরা। কুমড়ো ফুলের মতোন। একটি দেশ। নুরি আজকেই প্রথম দেখে দেখে সেলাই করেছে। আজকেই প্রথম সে এই শিল্পকর্মটা সবাইকে দেখাতে চলেছে। এর আগে বহু নকশিকাথা সেলাই করেছে সে। কিন্তু আজকের শিল্পটা যেন ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে। এতে মিশে আছে দিপুর রক্ত। বুকের তাজা রক্ত। বারো বছরের সদ্য কিশোরের হৃদপিন্ডের তরতাজা রক্ত। নুরি লাল রঙটার মাঝে আরো রঞ্জন লাগায়। তারপর সেলাই শেষ করে এগোতে থাকে পতাকা দন্ডটার দিকে। পেছনে ফেলে আসে ক্র্যাচ। ফেলে আসে অমানুষ পিতার সংস্রব।হাহাকার। চিৎকার।
দুহাত পরেই দন্ডটার সাথে নিজেকে আটকে উঠে দাঁড়ায় নুরি। এবার খুব দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে ওকে। দূর থেকে গুলির শব্দ কানে আসে। সে কি পারবে? চাঁদ তাঁরা খচিত ঐ বিভীষিকাময় কাপড়ের টুকরোটা সরিয়ে এই লাল হলুদ সবুজের পতাকা টাঙাতে? পারবে?
নুরি হাত চালায়। চিৎকার ভেসে আসে কিছু মানুষের। মানুষ নাকি মুড়ি মুড়কি? মরছে। আর মরছে। মারছে ও । কিন্তু সব এই পতাকার জন্য। নুরি দ্রুত হাতা চালায়। একহাতে উড্ডিন পতাকাটা নামিয়ে ওতে গেথে দেয় সদ্য নতুন পতাকা।
লাল-হলুদ-সবুজ।
নুরি দড়ি ধরে তুলতে থাকে সেই পতাকা।
কান্না চেপে হাসি ফুটতে শুরু করে ওর মুখে। নাকের ফুটো দুটো বড় হয়ে যায় উত্তেজনায়। হাত দিয়ে হরবর করে পতাকা টানতে থাকে সে। দড়িটা কপিকলে আটকে যায় কোন এক ফাঁকে। সেটা ধরে ঝাঁকায়। আর ঠিক সেসময় কারা যেন পেছন থেকে গুলি চালায় ওর দিকে। নিজের বুকের কাছটায় বিশাল একটা ফুটো দেখে নিজেই বিশ্বাস করতে পারেনা। গলা শুকিয়ে যেতে শুরু করে। হরবর করে রক্ত ঝড়তে শুরু করে নুরির শরীর থেকে। সে রক্তে নুরির শাড়ি ভিজে ওঠে। দুহাত চালাতে থাকে নুরি। পতাকাটা ঠিক খাঁজে আটকে যাওয়ার পরেই ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায় নুরি। ঠিক প্রাণবায়ু বেরোবার আগে ঝলমল করে ওঠে সেই কাপড়ের টুকরোটা। সেই লাল সবুজ হলুদের পতাকা। সেটা দেখে আনন্দ চকমক করে ওঠে নুরির চোখে। রক্তমাখা মুখে নুরি এই প্রথমবার কোন শব্দ উচ্চারন করে... “জয় বাংলা”
ঠিক সে সময় মুক্তিবাহিনী আক্রমন করে ওখানটায়। আর ঠিক তিনঘন্টা পরে শত্রুমুক্ত হল নোয়াপাড়া। নুরি সেসব কিছু দেখতে পায়নি। তার নিথর চোখ তখনো দেখে চলছিল সেই পতাকা। লাল-হলুদ-সবুজের ঝলমলে বাংলার পতাকা।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test