E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতিথি

২০২২ অক্টোবর ২৭ ১৪:৩৯:১৯
অতিথি

নাফিউন নাহার পুষ্প


 "এই তোমার গাড়ি এসে গেছে তাড়াতাড়ি যাও। "
হুম,যাচ্ছি।
"আরে টিফিন টা তো নাও।আজ তোমার পছন্দের তেহারি করেছি। "
তাই নাকি! আচ্ছা, আজ না হয় অফিস না যাই।

" যাও তো তাড়াতাড়ি। দেরি হলে তোমার বস আবার ঝাড়ি দিবে। "

নীলা খুব পরিপাটি। ওর সব কাজই গোছানো। আমাকে সকালে ঘুম থেকে উঠানো থেকে শুরু করে অফিসে পাঠানো পর্যন্ত যেন নিজের দিকে একটু খেয়াল করার সময় পায়না। আজ প্রায় আট বছর আমাদের সংসার। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। সুখে ছিলাম, সুখে আছি বলা চলে।শুধু মাঝে মাঝে একটা বিষয় খুব কষ্ট দেয়।

ডাক্তার বলেছে অপেক্ষা করতে। টেস্ট করতে বলেছে অনেকগুলো কিন্তু সাহস হয়নি। কি জানি যদি আমার বা নীলার কোন সমস্যা ধরা পড়ে। আমরা চাই না কেউ কারও দুর্বলতা জানি। যেমন আছি বেশ তো চলে যাচ্ছে।

অফিসে পৌঁছে গেলাম। বেশ ভালো মাইনের একটা চাকরি করি। জীবনযাপন সচ্ছল বলা চলে। কিন্তু এত কিছুর পরেও মাঝে মাঝে একা লাগে। কি যেন একটা অপূর্ণতা তাড়া করে ফেরে। সারাদিন কাজ শেষে বাড়িতে গেলে বাড়িটা বডড খালি খালি মনে হয়। সবকিছু পরিপাটি শোকেেস সাজানো। কিন্তু আমি চাই কেউ একজন এলোমেলো করুক, নীলাকে সারাদিন ভীষন ব্যস্ত রাখুক। আমি অফিস থেকে ফিরে এলে নীলা গাল ফুলিয়ে আমার কাছে এসে বলবে "একে নিয়ে আর পারছিনা সবকিছু কেমন এলোমেলো লন্ডভন্ড করে রেখেছে! "হায়! এ সব শুধু আমার কল্পনা।

লাঞ্চের টাইম হয়ে গেল। আজ সারাদিন এতই ব্যস্ত ছিলাম চেয়ার থেকে ওঠার সময় পাইনি। একটু ফ্রেশ হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম। আমার অফিস আট তলায়।অফিসের বিপরীতে ফুটপাতে প্রতিদিন এক মা তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা ভিক্ষা করেন। ঢাকা শহরের জ্যামে আমরা যতটা বিরক্ত হই ওরা মনে হয় ঠিক ততটাই খুশি হয়।ভিক্ষা একটু বেশি পাওয়া যায়। জানিনা কেন যেন প্রতিদিন ওই পরিবারের প্রতি আমার দৃষ্টি চলে যায়। সম্ভবত ওদের বাবা নেই নতুবা অন্য কোথাও বিয়ে করেছে। বেশিরভাগ পথের পরিবারের একই চিত্র।

আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি। ঠিক যে সময়টায় আমি প্রতিদিন দুপুরে খাবার খেতে বসি ওরাও একই সময় খেতে বসে। একটা বাটিতে তিনজন একসাথে খায়। আমার খাবার থাকে প্লেটে সাজানো নানা রকমের পছন্দের পদ, সালাত।দুপুরে খাবার পর আমার আবার কফি খাওয়ার অভ্যাস। ধোঁয়া ওঠা কফি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দেই আর ওদের দেখি। মসজিদের পানির নলে তৃপ্তি করে পানি খেয়ে ওরাও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি কি অদ্ভুত জীবন মানুষের। প্রায় প্রতিদিনই আমার খাবার বেঁচে যায়, আর মাটিতে একটা ভাত পড়লেও ওরা তা খুঁটিয়ে খায়।

অফিসের কাজ শেষে বাসায় পৌঁছে দেখি নীলা চোখ ফুলিয়ে বসে আছে। মনে হয় কেঁদেছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো না। প্রায় প্রতিদিনই ওর মন খারাপ থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলে না। কি যেন ভাবে সব সময়। ওকে শান্তনা দেই ভরসা দেই কিন্তু টেস্ট করানোর সাহস পাই না। যদি আমার কোন সমস্যা থাকে,যদি এটা শুনে নীলা আমাকে ছেড়ে চলে যায়।

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাব কিন্তু অ-কারণে নীলা ঝগড়া শুরু করল। এত বুঝালাম বুঝলো না। রাতের ঘুমটাই শেষ করে দিল। আমি বুঝি সব বুঝি কিন্তু কি করব। রাত প্রায় তিনটা বাজে। ব্যালকনিতে বসে আছি। নীল ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা সিগারেট ধরালাম। আল্লাহ সবাইকে সব কিছু দেয় না, পরীক্ষা করেন।জীবনটাই একটা পরীক্ষা। আমার ব্যাংকে টাকা পড়ে আছে অথচ একটা সন্তানের জন্য কতটা হাহাকার করে মরছি। আর রাস্তার পাশের ওই মা বাচ্চা দুটোকে নিয়ে রাতদিন কতটা কষ্ট করছেন। ভাবছি কাল ওদের কিছু টাকা দিয়ে দিব।

এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো। যথারীতি অফিস গেলাম। কাজের ভীষণ চাপ। দুপুরে খাবার সময় মনে পড়লো ওই পরিবারকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম। পিয়নকে ডেকে বললাম রাস্তার সেই মহিলা ও শিশুদের অফিসে নিয়ে আসতে। কিছুক্ষণ পর পিয়ন ফিরে এসে বলল তারা ওই জায়গায় আর নেই। জানালার পাশে গিয়ে দেখলাম সত্যিই ওরা নেই। প্রায় তিন মাস হচ্ছে ওদের প্রতিদিনই আমি ওই জায়গায় দেখি। কিন্তু হঠাৎ কী হলো!

আজ প্রায় সাত দিন হল আমি অফিসে যাওয়া আসার সময় লক্ষ্য করি কিন্তু ওদের আর খুঁজে পাই না। কেন যেনো মনের মাঝে একটা অশান্তি কাজ করে। দুপুরের খাবার পর মসজিদে গেলাম যে মসজিদের নল থেকে ওরা প্রতিদিন দুপুরে পানি খেত।মোয়াজ্জেম সাহেবের দেখা পেয়ে পরিবারটি কথা জিজ্ঞেস করলাম। যা বললেন তাতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

ছুটে গেলাম নিকটবর্তী হাসপাতালে খুঁজে বের করলাম ওই পরিবারের সবাইকে। সবাই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। শিশু দুটি খেলতে খেলতে রাস্তার মাঝে চলে আসে, ওদের মা বাঁচাতে এসে তিনজনেই মারাত্মকভাবে বাসের ধাক্কায় আহত হন। ডাক্তার বলল মা এবং বড় মেয়েটির অবস্থা আশঙ্কাজনক।তিন বছরের মেয়েটিকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে পায়ে মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। আমি অফিসের কলিগদের ফোনে জানালাম বিষয়টা। সবাই অফিস শেষ করে হাসপাতালে চলে আসলো। আমাকে অবাক করে ওরাও পরিবারটি জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো।তিনদিন জীবনের সাথে লড়াই করে দুজন আজ হেরে গেল। নিকটাত্মীয় না থাকায় সরকারি কবরস্থানে ওদের দাফোন করলাম।কয়েকটা দিন প্রচণ্ড মানসিক চাপে কাটালাম। নীলাকে বিষয়টি জানিয়েছি ও আমাকে স্বাভাবিক করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে।
বেশ অনেকদিন হয়ে গেল। কাজের চাপে ভুলে গিয়েছিলাম পরিবারটির কথা বেঁচে থাকা ঐ ছোট্ট মেয়েটির কথা। হাসপাতাল থেকে ফোন আসলো। শিশুটি বর্তমানে মোটামুটি সুস্থ ওকে অনাথ আশ্রমের দেয়া হবে। কথাটা শুনে কেন যেন বুকের ভিতরে একটা অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করলাম ।

রাতে খাবার পর নীলাকে বিষয়টি জানালাম। নীলা শুনে বলল "কি আর করবে বল আমাদের হাতে তো কিছু করার নেই"। নীলা একটা কথা বলতে চাই। মেয়েটাকে যদি আমরা আমাদের পরিচয়ে বড় করি। নীলাঃ"মানে"।
মানে শিশুটিকে যদি আমরা দত্তক নেই।

কি বলছো এসব একটা পথের শিশুকে আমরা দত্তক নেব!"

নীলা আমরাও তো পথে জন্মাতে পারতাম। আমাদের জীবনটা তো কোন বস্তিতে বা রাস্তায় কাটতে পারত।
" কি বলছো এসব। লোকে কি বলবে।" দেখো লোকে কি বলবে আমি জানিনা ভাবতেও চাইও না।
এই শিশুটির জন্যই না হয় আমরা স্বামী-স্ত্রী থেকে বাবা-মা তে রূপান্তরিত হলাম।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test