E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফাল্গুনের গাঁদা ফুল

২০১৫ মার্চ ৩১ ১৫:১৬:০৯
ফাল্গুনের গাঁদা ফুল

আনিসুর রহমান আলিফ : আমি কানাডা প্রবাসী একজন বাঙালি। কানাডার ভেগান শহরের প্রান্তে একটি ফ্যাক্টরিতে ফোরম্যান হিসাবে কাজ করি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেশটা দেখি। পরিপাটি করে সাজানো সুন্দর একটি দেশ। এখানে বাঙালি খুব কম।

আমার ফ্যাক্টরিতে একজন বাঙালিও নেই। পাশের ফ্যাক্টরিতে দুই জন আছে কিন্তু তাদের সাথে খুব বেশি একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। এখানে যে যার কাজে ব্যস্ত। এদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ আছে। তবে অফিসগুলোতে ইংরেজি আর ফরাসি ভাষা চলে। আমি ফরাসি ভাষা একেবারেই বুঝি না, তাই কানাডিয়ান ইংরেজি দিয়েই কাজ চালায়। অর্থের তাগিদে এ দেশে এসেছি প্রায় বছর তেরো হলো। এর মধ্যে মাত্র দুইবার দেশে গিয়েছি। শেষবার গিয়েছি তা প্রায় বছর চার আগে। প্রথম-প্রথম দেশে তেমন একটা যেতে ইচ্ছে করতো না। কিন্তু ইদানিং কী যেন হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণেই দেশের কথা মনে পড়ে। ক’দিন থেকে এই মনে পড়াটা আরও বেড়ে গেছে। এদেশে সব আছে, আবার নেই অনেক কিছুই। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার অভাব অনুভব করি তা হলো প্রাণখুলে বাংলায় কথা বলা। এখানকার মানুষ খুব ব্যস্ত। প্রাণখুলে কথা বলার মতো সময় কারো নেই। প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারা যে কতো কষ্টের তা বাংলাদেশে বসবাসরত মানুষ বুঝতে পারবে না। এ যেন মরুভূমিতে পানি না পাওয়ার মতো অবস্থা।

কানাডা শীত প্রধান দেশ। এখন জানুয়ারি মাস। প্রচণ্ড শীতের সাথে চারদিকে বরফ পড়তে শুরু করেছে। ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট সব একেবারে বরফের পুরু আস্তরণে ঢাকা। এরকম অবস্থায় সরকারি আদেশে অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়। গত তিন দিন ধরে তাই চলছে। পারত পক্ষে ঘর থেকে কেউ বের হয় না। হাড়কাঁপানো শীতে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে বসে আছি। এক কথায় বলা যায় শীতের ভয়ে গৃহবন্দি। নাহ্, আর ভালো লাগছে না। দেশের কথা খুব মনে পড়ছে। দেশে এখন মাঘ মাস। দেশের মাঘ এই সাদা বরফের থেকে অনেক ভালো। দেশে শীত যতই পড়ুক এভাবে অন্তত গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয় না। নাহ্, আর না, দেশে যাবো। কানাডা উন্নত দেশ তাই সবকিছু হয় খুব সহজে। অফিসে দুই মাসের ছুটি চেয়ে ই-মেইল করে দিলাম। ঘণ্টা খানেক পরেই অফিস ম্যানেজারের ফিরতি মেইল এসে গেলো। ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে। ছুটির নোটিশ পেয়ে তখনই ইন্টারনেটে প্লেনের টিকেট কিনে ফেললাম। রাত দশটায় ফ্লাইট। কয়েকটি ট্রানজিট নিয়ে দেশের মাটিতে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় দুই দিন। চটপট ব্যাগ-পেটরা গুছিয়ে ফেললাম। দেশে মা-বাবা না থাকলেও চাচা-চাচি আর কিছু আত্মীয়-পরিজন আছে। তাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাওয়া দরকার। প্রবাসীদের কাছ থেকে আত্মীয়-পরিজন উপহার আশা করে। আশা করাটাই স্বাভাবিক।
দেশে ফিরেছি তাও প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলো। বাংলাদেশে এখন মাঘ বিদায় নিয়ে ফাল্গুন এসেছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র এই ঠান্ডা এই গরম অবস্থা। ক্ষণে-ক্ষণেই আবহাওয়ার খামখেয়ালি, তবুও চারিদিকে কেমন একটা নতুন-নতুন আমেজ। পুরোনো জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে পত্র-পল্লবে নতুনের হাতছানি। ফাল্গুন মাসের আবহাওয়াটাই এমন, শরীরে কেমন যেন একটা আলস্য ভাব আসে। দুপুরের খাওয়া শেষ করার পরে চোখ বেয়ে ঘুম নামে। কানাডায় কিন্তু এমন হয় না। যা হোক, ঘুম থেকে উঠতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেলো। ভাবলাম মোড়ের দোকান থেকে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। বেরিয়ে পড়লাম। এলাকার মাঝ-খানে তিন রাস্তার মোড়ে নতুন কতগুলো দোকান গজিয়েছে। দোকানগুলোর শেষ প্রান্তে একটি চায়ের দোকানও তৈরি হয়েছে। গত বার যখন এসেছিলাম তখন দোকানগুলো ছিলো না। ভালই হয়েছে, যে ক’টা দিন আছি ওখানে যেয়ে গরম গরম চা খাওয়া যাবে। মজার ব্যাপার হলেও সত্যি বাংলাদেশের চায়ের দোকানগুলোতে সকাল-সন্ধ্যা একটানা আড্ডা চলে। মনে-মনে ভাবি চা বিক্রেতা রহিম ভাই এত সহ্য করে কীভাবে? দিনভর এত লোকের প্যাঁচালে লোকটার তো পাগল হয়ে যাবার কথা। কিন্তু রহিম ভাইয়ের কিছুই হয় না। মাঝে মাঝেই গল্পের মধ্যে দু’একটি কথা বলে গল্পগুলোকে আরো উস্কে দিতে দেখে বোঝা যায় চা বানানোর গরম পানি ছানার মতো আড্ডার কথাগুলোকেও ব্যবসার অংশ হিসাবে প্রতিনিয়তই তিনি ছানতে থাকেন।
-কী, পানি গরম আছে তো?
-আরে আছে আছে। বসেন। রং চা দিবো নাকি দুধ চা?
-বিকাল বেলা রং চা ভালো লাগে না। দুধ চা-ই দাও।
রহিম ভাই ব্যবসা বোঝে। চা বানায় খাঁটি গরুর-দুধ দিয়ে। দুধের সর চায়ের উপরে মালাই হয়ে ভেসে থাকে। বেশ লাগে। কানাডার ভেগানে মালাই-চা পাওয়া যাবে না। রহিম ভাইয়ের মালাই চা খাওয়ার লোভে আশেপাশের এলাকা থেকেও লোকজন আসে। রহিম ভাইয়ের ব্যবসা এক কথায় রমরমা। দুধ-মালাই চা নিয়ে দোকানের একেবারে কোনার দিকের বেঞ্চে বসলাম। দেখলাম তিন-চার জনের ছোট্ট একটা আড্ডা চলছে। কথাবার্তার ভাব শুনে বুঝলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কথা হচ্ছে।
-আজকাল যে কতো দিবস বের হয়েছে তা আর গুনে শেষ করার জো নেই। একদিন দেখা যাবে একই দিনে চারটি-পাঁচটি করে দিবস পালন শুরু হয়ে গেছে। বললো ফিরোজ চাচা।
-তুমি কি একুশে ফেব্রুয়ারিকে অন্য দিবসগুলোর সাথে তুলনা করো চাচা? বললো নাবেদ।
-অত-শত বুঝি না। দিবসের নামে এসব আমার ভালো লাগে না।
-কী বলো তুমি? ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিলো তাদের জন্য তোমার মায়া-মমতা বা শ্রদ্ধাবোধ কোনোটাই নেই! ফিরোজ চাচা একটু থেমে বললেন,
-তা থাকবে না কেন। কিন্তু আজকাল এসব দিবস-ফিবস নিয়ে যা হচ্ছে তা খুব বেশি ভালো ব্যাপার না।
-কী হচ্ছে?
-কী হচ্ছে না তাই বলো। আমার ছোট মেয়ে শিমু, উঠানের এক কোনে ছোট্ট একটা বাগান করেছে। সকাল-বিকাল বাগানটির যত্ন করে মেয়েটি। কিছুদিন হলো বাগানে গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া ফুটেছে। অথচ গত পরশু রাতে কারা যেন সব ফুল ছিড়ে নিয়ে গেছে! মেয়ে বললো, তার কষ্টে ফোটানো ফুল কারা নাকি চুরি করে শহীদ-মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। হ্যাঁ চুরি করা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা! শুধু তাই না। শুনলাম রহিমের কাছ থেকেও নাকি চাঁদা তোলা হয়েছে। চাঁদা কতো জানো? একশো টাকা। একজন চায়ের দোকানদারের কাছে শহীদ-মিনার বানানোর জন্য একশো টাকা চাঁদা নেওয়া হয়েছে। ভাবতে পারো? শুধু রহিম একাই না। এরকম অনেক আছে। ছোট থেকে বড় এলাকার প্রায় সব লোকজনের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের চাঁদা তোলা হয়েছে। যে পরিমান টাকা তারা তুলেছে তাতে একটি পাঁকা শহীদ-মিনার বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু শেষে দেখা গেলো তিন রাস্তার মোড়ে কলাগাছ পুঁতে কালো কাগজ জড়িয়ে উদ্ভট এক শহীদ মিনার। বড় বড় সাউন্ড বক্স এনে প্রথমে দু-একটি দেশের গান বাজিয়ে তারপর সারাদিন হিন্দি গান। এই হলো ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।
-ছেলে মানুষ, ছাড়োতো চাচা। বললো শিপন।
-ছেলে মানুষ। হুঁ, চাঁদার টাকা দিয়ে পিকনিকের নামে রাতভর লাফালাফি-ঝাঁপাঝাপি, এ গাছের ডাব চুরি, ও ঘরের মুরগি চুরি এগুলো তো আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর কাজ না। নাবেদ কোনো কথা বলছে না। কী বলবে? এই কথার জবাব দেওয়া যায় না। এবার আমি কিছু না বলে পারলাম না।
-চাচা দোষটা শুধু ওদের একার উপর চাপানো ঠিক হচ্ছে না। এতে আমার আপনার সকলেরই দোষ আছে।
-আরে রাখো তোমার দোষ। বলে ফোঁস করে উঠে চাচা আরো বললো,
-আমার মেয়ের শখের বাগান লুট করেছে সহ্য করেছি কিন্তু আমার কাছ থেকে যে দুইশো টাকা চাঁদা নিলো তা দিয়ে কী করলো? জানো, মজিদের পনেরো বছরের ছেলের কী হাল হয়েছে?
-কী হয়েছে?
-তাকে নাকি ধরে জোর করে বোতল খাইয়ে দিয়েছে। সে ছেলে তো গত রাতে বমি-টমি করে অস্থির। শুধু তাই না, রাত পার হতেই কলাগাছের উদ্ভট শহীদ মিনারটা কে কার আগে ভাঙতে পারে শুরু হয় তার প্রতিযোগিতা।
-আরে পূজা পূজা। এ পূজা ছাড়া আর কিচ্ছু না। বললো, রহিম ভাই। আমি আর ক্রোধ সম্বরণ করতে পারলাম না। ধমক দিয়েই বলে উঠলাম,
-থামেন। যা বোঝেন না তা নিয়ে কথা বলেন কেন্ ? সব কিছুতেই ধর্ম টেনে আনা আর নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপানো আপনাদের একটা বদ্-স্বভাব। যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে তাদের মতো আর কয়জন মানুষ আছে? মুখের কথা বুঝলেন, মুখের কথা। এই কথা বলার অধিকার চাইতে আর কারা রক্ত দিয়েছে? টাকার জন্য নয়, সম্পদের জন্য নয়, ভাষার জন্য বুঝলেন, শুধু ভাষার জন্য। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া এত সহজ না। আপনাদের মতো মানুষ বাংলাদেশে বসে ভাষার মর্ম কী বুঝবে? বিদেশে পাড়ি দিয়ে বুঝেছি ভাষা কী জিনিস। এই বাচ্চা-ছেলেরা আজ যা করছে এর দায়ভার আমার-আপনার-সবার।
-হ, আমার। আমার বাগান গেলো, টাকা গেলো আর দায় ভারও সব আমার।
-হ্যাঁ আপনার। ভাষা শহীদদের সম্পর্কে আপনার সন্তানকে কী শিক্ষা দিয়েছেন বলেন? কোনো দিন তাদেরকে কাছে বসিয়ে ঐ ভাষা শহীদদের বীরত্বের গাঁথা শুনিয়েছেন? আমি আপনি মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি কাদের রক্তের বিনিময়ে? এটা তাদের জানিয়েছেন? ভাষা শহীদদের জন্য কতখানি ভালোবাসা, কতখানি শদ্ধা বুকের মধ্যে লালন করা দরকার শিখিয়েছেন? শেখান নি। আপনার যা করবার কথা ছিলো আপনি তা করেননি আর দোষ দিচ্ছেন ওদের উপর।
-আমরা কী করতে পারি?
-পারি অনেক কিছু। কিন্তু করি না। করলেও করি উল্টোটা। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আমি আপনি যারা একটু বুঝি তারাই বা কী করি? বড়জোর এক তোড়া ফুল কিনে শহীদ-মিনারে যাই। ক্ষাণিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। হয়ে গেলো ভাষা শহীদদের প্রতি শদ্ধা? মনে রাখবেন ভাষা শহীদদের প্রতি অন্তর থেকে যারা শ্রদ্ধা জানাতে পারে না, তারা নিজেরাও শ্রদ্ধা পায় না। একদিন দেখবেন আপনার সন্তান আপনাকেই শ্রদ্ধা করবে না।
-এর প্রতিকার কী?
-প্রতিকার আছে। কেন আপনি আপনার বাগানের ফুলগুলোকে শুধু ভাষা শহীদদের প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ফুটিয়ে তোলেন না? কেন আপনার এলাকার কোমল মতি ছেলে-মেয়েরা কলাগাছ দিয়ে শহীদ-মিনার বানাবে? কেন আমরা প্রতিটি এলাকায়-মহল্লায় একটি করে শহীদ-মিনার নির্মাণ করি না? কেন আমাদের সন্তানদেরকে কাছে বসিয়ে সেই বীর ভাষা শহীদদের বীরত্বের কাহিনি বলি না? বীরত্বের কাহিনি না শুনালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বীর হবে কী করে?
-আর রহিম ভাই। আপনাকে বলছি, ধর্ম সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? কারো প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে কি লাঠি-সরকি নিয়ে যেতে হয়? ফুল ভালোবাসার প্রতীক। ফুল শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা। ফুল পবিত্র। তাই পবিত্র জিনিস দিয়েই পবিত্র আত্মাদেরকে সম্মান জানাতে হবে। যারা ভাষা-শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে পারেনা তারা কী করে ধর্মের প্রতি সম্মান জানাবে? জানি ঐ কোমলমতি বাচ্চা ছেলেদের মতো দেশের বয়সও বেশিদিন নয় কিন্তু আজ যদি আমি আপনি ওদেরকে কোনটা ঠিক কোনটা ঠিক নয় তা না শেখাই তাহলে ওদের মতো দেশও একদিন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। বখে-যাওয়া যুব সমাজের মতো দেশ পঙ্গু হয়ে পড়বে। ভবিষ্যৎ বলে তখন আমাদের এই বাংলা ভাষাভাষীদের গর্ব করার মতো, ধরে রাখার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
-নিন, চায়ের দাম রাখুন। দোকান থেকে বের হয়ে এলাম।

পরের দিন ভেগান থেকে ই-মেইল এলো আমাকে অতি সত্বর কাজে যোগদান করতে হবে। তাই আর দেরি না করে রওনা হয়ে গেলাম। কানাডায় ফিরে কাজকর্ম বেশ চলছিলো। কালের আবর্তে সপ্তাহ-পক্ষ-মাস ঘুরে ঘুরে আবার শীত নামলো। ইদানিং কী হয়েছে কে জানে। দেশের কথা খুব বেশি বেশি মনে পড়ে। এমন তো আগে হতো না। বয়স হয়ে যাচ্ছে বলেই কি এমন হচ্ছে? হতে পারে। বয়স হলে নাকি কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ম্যানেজার সাহেব বললেন,
-মিস্টার প্রতীক, ক’দিন থেকে দেখছি, চুপচাপ বসে থাকেন। ব্যাপার কী?
-না, তেমন কিছু না।
-দেশের কথা মনে পড়ে?
-তা পড়ে বৈকি।
-ঘুরে আসুন না। এবার একটু দেরি করেই বরফটা পড়তে শুরু করেছে। আবহাওয়া দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী আগামী দু’এক দিনের মধ্যেই ভারি বরফ পড়তে শুরু করবে। অফিস তো বন্ধই থাকবে। যান যান, ঘুরে আসুন ভালো লাগবে। আমাকে আমতা আমতা করতে দেখে ম্যানেজার সাহেব বললেন,
-আমি কালই আপনার ছুটি মঞ্জুর করে দিচ্ছি। যান কিছু দিন বেড়িয়ে আসুন।
পরের দিন আমার ডেস্কে দেখলাম ছুটি মঞ্জুরের নোটিশ পড়ে আছে। কিছু কেনাকাটা করে আবার রওনা হলাম দেশের উদ্দেশে।

এবার দেশের মাটিতে পা রাখতেই সমস্ত শরীরে কেমন একটা শিহরণ ভাব জাগলো। এমনটি আগে হয়নি কখনও। দেশের প্রতি মমতা বেড়ে গেল নাকি? বাড়তেও পারে। গত বার এসেছিলাম জানুয়ারিতে আর এবার ফেব্রুয়ারি। ঢাকা শহর নতুন করে সাজতে শুরু করেছে। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতি গ্রহণে সারা দেশ ব্যস্ত সময় পার করছে। আমার নিজ জেলাতেও দেখলাম প্রস্তুতির কমতি নেই। বাড়ি যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমেছে। লম্বা জার্নি করে এসেছি, তাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে রহিম ভাইয়ের চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ালাম। সেই পুরাতন দৃশ্য। আড্ডা চলছে। আমাকে দেখে রাহিম ভাই সালাম দিয়ে বললো,
-ভাইজান ভালো আছেন?
-ভালো।
আপনি ভালো আছেন?
-আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। বসেন, চা দেই। আমি বসলাম। ক্ষাণিক বাদেই দেখলাম ফিরোজ চাচার সাথে নাবেদ আর শিপন এ দিকেই আসছে। মনে মনে ভাবলাম, ব্যাপার কী? গতবার যেখানে শেষ করেছিলাম এইবার সেখান থেকেই শুরু হবে নাকি? আমাকে দেখেই ফিরোজ চাচা বললেন,
-আপনার আসার খবর পেয়েছি। আমরা সবাই আপনাকে মনে মনে খুব আশা করছিলাম। কী আশ্চর্য দেখেন, পেয়েও গেলাম। চলুন, আগে চা খাই, তারপরে আপনাকে কিছু দেখাবো। চা খেতে খেতে আমি বললাম,
-কী দেখাবেন?
-আছে আছে। দেখলেই বুঝবেন।
চা শেষ করে আমরা চারজন উঠে পড়লাম। দোকান থেকে বের হবার সময় রহিম ভাই বললো,
-আপনাদের সাথে যাওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু দোকান রেখে যেতে পারবো না। যান দেখে আসেন।
বুঝতে পারছি না এরা আমাকে কী দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে? ক্ষাণিক হেঁটে আমরা এসে পড়লাম গ্রামের শেষে একেবারে মাঠের ধারে। সকালের সোনা রোদে মাঠের কোল জুড়ে এ কী দেখছি আমি! লাল-হলুদ-গোলাপী এ যেন রঙের মেলা। আরও একটু কাছে গিয়ে বুঝলাম। রং গুলো ফুলের। মাঠের কোল ঘেঁসে ফুলের চাষ করা হয়েছে। লম্বা লম্বা সব ফুলের বাগান। কোনোটিতে গোলাপ, কোনোটিতে গাঁদা, কোনোটিতে আবার ডালিয়া-সূর্যমুখী। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা বাগানগুলোতে পরিচর্যার কাজ করছে। ফিরোজ চাচা বললেন,
-আপনি যা বলেছিলেন তাই করেছি। এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য শীতের মৌসুমে মাঠের কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছি। ওরা স্বেচ্ছায় বাগান করেছে। এই যে ফুল দেখছেন এগুলো ঐ নিষ্পাপ ছেলে-মেয়েদের হাতেই ফুটেছে। মহান ভাষা-শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই পবিত্র ফুলের চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? ফিরোজ চাচার কথা শুনে আমার শরীরের রোমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। আবেগে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। ফিরোজ চাচা শিমু বলে ডাকতেই বাগানের ভেতর থেকে বারো তেরো বছরের একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। আমার দিকে ইশারা করে ফিরোজ চাচা বললেন,
-ইনিই হলেন প্রতীক। যার প্রেরণায় তোমরা এই বাগান করেছো। মেয়েটি কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। আমাদেরকে দেখে বাগানের মধ্যে থেকে অন্য ছেলে-মেয়েরাও বের হয়ে এলো। আমার একটি হাত ধরে ফিরোজ চাচার মেয়ে শিমু বললো,
-চলুন দেখবেন। আমি বললাম,
-কী?
-আসুন আমাদের সাথে।
উজ্জ্বল-উচ্ছল দামাল ছেলে-মেয়েদের পেছন-পেছন আমি হেঁটে চললাম। কিছুদূর গিয়ে একটি স্কুলের পাশে এসে দেখলাম বেশ বড় আর সুন্দর একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে। কয়েকটি ছেলে-মেয়ে খালি পায়ে শহীদ মিনারটিতে রং করছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনারটি দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। চাচাকে বললাম,
-খুব সুন্দর। খরচ কে দিলো? চাচা বললেন,
-এলাকার সকলে স্বেচ্ছায় খরচ দিয়েছে আর জায়গা দিয়েছে রহিম ভাই। আমি বললাম,
-চায়ের দোকানদার!
-হ্যাঁ।
-বলেন কী!
-হ্যাঁ। বসত বাড়ির কিছুটা যায়গা স্বেচ্ছায় সে শহীদ-মিনারের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। কথাটা শুনে আনন্দে আর গর্বে আমার চোখে জল এসে গেলো। বিড়-বিড় করে বললাম,
-আমরা বাঙালি, এভাবে একমাত্র আমরাই পারি। বার-বার প্রতিবার।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test