E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দাম্পত্য জীবন

২০১৫ জুন ২৫ ১৮:৪৩:০৮
দাম্পত্য জীবন

সৈয়দ মুজতবা আলী : যাঁদের ঝড়তি-পড়তি মালা কুড়িয়ে নিয়ে ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছি- অর্থাৎ 'পঞ্চতন্ত্র' তৈরি করছি তাঁদের সঙ্গে দেশের পাঠক-পাঠিকার যোগসূত্র স্থাপন করার বাসনা এই অধমের প্রায়ই হয়। তাঁদেরই একজন আমার এক চীনা বন্ধু। সত্যিকার জহুরী লোক- লাওৎসে, কন-ফুৎসিয়ে টৈ-টম্বুর হয়ে আছেন। তত্ত্বালোচনা আরম্ভ হলেই শাস্ত্রবচন ওষ্ঠাগ্রে। আমি যে পদে পদে হার মানি সে-কথা আর রঙ ফুলিয়ে, তুলি বুলিয়ে বলতে হবে না।

ক্লাবের সুদূরতম প্রত্যন্ত প্রদেশে একটি নিম গাছের তলায় বসে তন আপিস ফাঁকি দিয়ে চা পান করেন। তাঁর কাছ থেকেই আমি এন্তার এলেম হাঁসিল করেছি- তারই একটা আপিস ফাঁকি দেওয়া। কাছেই পৌঁছতেই একগাল হেসে নিলেন- অর্থ সুস্পষ্ট- ছোকরা কাবেল হয়ে উঠেছে। আর ক'দিন বাদেই আপিস যাওয়া বিলকুল বন্ধ করে পুরো তনখা টানবে।

ইতিমধ্যে একজন ইংরেজও এসে উপস্থিত।

রসালাপ আরম্ভ হল। কোথায় কোথায় বিবাহিত জীবন নিয়ে আলোচনা। সাহেব বললে, লন্ডনে একবার স্বামীদের এক আড়াই মেইল লম্বা প্রসেশন হয়েছিল, স্ত্রীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য। প্রসেশনের মাথায় ছিল এক পাঁচ ফুট লম্বা টিউটিঙে হাড্ডিসার ছোকড়া। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই ছ'ফুট লম্বা ইয়া লাশ এক ঔরৎ দুমদুম করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললে, 'তুমি এখানে কেন, তুমি তো আমাকে ডরাও না। চলো বাড়ি।' সুড়সুড় করে সেই ছোকড়া চলে গেল সেই খান্ডার বউয়ের পিছনে পিছনে।'

আমার চীনা বন্ধুটি আদত-মাফিক মিষ্টি মৌরী হাসি হাসলেন। সায়েব খুশী হয়ে চলে গেল।

গুটিকয়েক শুকনো নিমপাতা টেবিলের উপর ঝরে পড়ল। বন্ধু তাই দিয়ে টেবিলক্লথের উপর আল্পনা সাজাতে সাজাতে বললেন, 'কী গল্প! শুনে হাসির চেয়ে কান্না পায় বেশী।' তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন, 'চীনা গুণী আচার্য সূ তাঁর প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থে লিখেছেন, একদা চীন দেশের পেপিং শহরে অত্যাচার-জর্জরিত-স্বামীরা এক মহতী সভার আহ্ববান করেন। সভার উদ্দেশ্য, কি প্রকারে নিপীড়িত স্বামীকুলকে তাঁদের খান্ডার গৃহিণীদের হাত থেকে উদ্ধার করা যায়।'

'সভাপতির সম্মানিত আসনে বসানো হল সবচেয়ে জাঁদরেল দাড়িওয়ালা অধ্যাপক মাওলীকে। ঝাড়া ষাটটি বছর তিনি তাঁর দজ্জাল গিন্নীর হাতে অশেষ অত্যাচার ভুগেছেন সে কথা সকলেরই জানা ছিল।'

'ওজস্বিনী ভাষায় গম্ভীর কন্ঠে বজ্রনির্ঘোষে বক্তার পর বক্তা ঘন্টার পর ঘন্টা আপন আপন অভিজ্ঞতা বলে যেতে লাগলেন। স্ত্রীলোকের অত্যাচারে দেশ গেল, ঐতিহ্য গেল, ধর্ম গেল, সব গেল, চীন দেশ হটেনটটের মুল্লুকে পরিনত হতে চলল, এর একটা প্রতিকার করতেই হবে! ধন-প্রাণ, সর্বস্ব দিয়ে এ অত্যাচার ঠেকাতে হবে। এস ভাই, এক জোট হয়ে ......'

'এমন সময় বাড়ির দারোয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, "হুজুররা এবার আসুন। আপনাদের গিন্নীরা কি করে এ সভার খবর পেয়ে ঝাঁটা, ছেঁড়া জুতো, ভাঙ্গা ছাতা ইত্যাদি যাবতীয় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এদিকে ধাওয়া করে আসছেন।"

'যেই না শোনা, আর যাবে কোথায়? জানালা দিয়ে, পেছনের দরজা দিয়ে, এমন কি ছাত ফুটো করে, দেয়াল কানা করে দে ছুট! দে ছুট! তিন সেকেন্ডে মিটিঙ সাফ- বিলকুল ঠান্ডা।

'কেবল মাত্র সভাপতি বসে আছেন সেই শান্ত গম্ভীর মুখ নিয়ে- তিনি বিন্দু মাত্র বিচলিত হননি। দারোয়ান তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে বারবার প্রণাম করে বলল, "হুজুর যে সাহস দেখাচ্ছেন তাঁর সামনে চেঙ্গিস খানও তসলীম ঠুকতেন। কিন্তু এ তো সাহস নয়, এ তো আত্মহত্যার শামিল। গৃহিণীদের প্রসেশনের সক্কলের পয়লা রয়েছেন আপনারই স্ত্রী। এখনো সময় আছে। আমি আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।" সভাপতি তবুও চুপ। তখন দারোয়ান তাঁকে তুলে ধরতে গিয়ে দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ ঠান্ডা। হার্ট ফেল করে মারা গিয়েছেন।'

আচার্য উ থামলেন। আমি উচ্ছ্বাসিত হয়ে, 'সাধু, সাধু', 'শাবাস, শাবাস', বললুম। করতালি দিতে দিতে নিবেদন করলুম, 'এ একটা গল্পের মত গল্প বটে।'

আচার্য উ বললেন, 'এ বিষয়ে ভারতীয় আপ্তবাক্য কি?'

চোখ বন্ধ করে আল্লা রসূলকে স্মরণ করলুম, পীর দরবেশ গুরু ধর্ম কেউই বাদ পড়লেন না। শেষ্টায় মৌলা আলীর দোয়া হল!

হাত জোড় করে বরজলালের মত ক্ষীণ কন্ঠে ইমন কল্যান ধরলুম।

শ্রীমৎ মহারাজ রাজাধিরাজ দেবেন্দ্রবিজয় মুখ কালি করে একদিন বসে আছেন ঘরের অন্ধকার কোণে। খবর পেয়ে প্রধান মন্ত্রী এসে শুধালেন, 'মহারাজের কুশল তো?' মহারাজ রা কাড়েন না। মন্ত্রী বিস্তর পীড়াপীড়ি করাতে হঠাৎ খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলেন, 'ঐ রাণীটা- ওঃ কি দজ্জাল, কি খান্ডার! বাপরে বাপ! দেখলেই আমার বুকের রক্ত হীম হয়ে আসে।'

মন্ত্রীর যেন বুক থেকে হিমালয় নেমে গেল। বললেন, 'ওঃ! আমি ভাবি আর কিছু। তাতে অতো বিচলিত হচ্ছেন কেন মহারাজ! বউকে তো সব্বাই ডরায়- আম্মো ডরাই। তাই বলে তো আর কেউ এরকমধারা গুম হয়ে বসে থাকে না।'

রাজা বললেন, 'ঐ তুমি ফের আরেকখানা গুল ছাড়লে।' মন্ত্রী বললেন, 'আমি প্রমাণ করতে পারি।'

রাজা বললেন, 'ধরো বাজি।' 'কত মহারাজ? দশ লাখ?' 'দশ লাখ।'

পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরে ঢোল পেটানোর সঙ্গে সঙ্গে হুকুম জারি হল, বিষ্যুদবার বেলা পাঁচটায় শহরের তাবৎ বিবাহিত পুরুষ যেন শহরের দেয়ালের বাইরে জমায়েত হয়; মহারাজ তাদের কাছ থেকে একটি বিষয় জানতে চান।

লোকে লোকারণ্য। মধ্যিখানে মাচাঙ- তার উপরে মহারাজ আর মন্ত্রী।

মন্ত্রী চেঁচিয়ে বললেন, 'মহারাজ জানতে চান তোমরা তোমাদের বউকে ডরাও কি না। তাই তাঁর হয়ে আমি হুকুম দিচ্ছি যারা বউকে ডরাও তারা পাহাড়ের দিকে সরে যাও আর যারা ডরাও না তারা যাও নদীর দিকে।'

যেই না বলা অমনি হুড়মুড় করে করে, বাঘের সামনে পড়লে গোরু পালের মত, কালবৈশাখীর সামনে শুকনো পলাশ পাতার মত, সবাই ধাওয়া করলে পাহাড়ের দিকে, একে অন্যকে পিষে, দলে, থেঁৎলে- তিন সেকেন্ডের মধ্যে পাহাড়ের গা ভর্তি।

বউকে না ডরানোর দিকে বিলকুল ফর্সা। না, ভুল বললুম। মাত্র একটি রোগা টিঙটিঙে লোক সেই বিরাট মাঠের মধ্যিখানে লিকলিক করছে।

রাজা তো অবাক। ব্যাপারটা যে এরকম দাঁড়াবে তিনি তাঁর কল্পনাও করতে পারেন নি। মন্ত্রীকে বললেন, 'তুমিই বাজি জিতলে। এই নাও দশ লখা হার।' মন্ত্রী বললেন, 'দাঁড়ান মহারাজ। ঐ যে একটা লোক রয়ে গেছে।' মন্ত্রী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে এলে বললেন, 'তুমি যে বড় ওদিকে দাঁড়িয়ে? বউকে ডরাও না বুঝি?'

লোকটা কাঁপতে কাঁপতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, 'অতশত বুঝিনে, হুজুর। এখানে আসবার সময় বউ আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, "যেদিকে ভিড় সেখানে যেও না।" তাই আমি ওদিকে যাই নি।'

আচার্য উ আমাকে আলিঙ্গন করে বললেন, 'ভারতবর্ষেরই জিৎ। তোমার গল্প যেন বাঘিনী বউ। আমার গল্প ভয়ে পালালো।'

তবু আমার মনে সন্দ রয়ে গিয়েছে। রসিক পাঠক, তুমি বলতে পারো কোন গল্পটাকে শিরোপা দি?

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test