E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আবিদ আনোয়ার-এর একগুচ্ছ কবিতা

২০১৫ জুলাই ২২ ০২:১১:৩৮
আবিদ আনোয়ার-এর একগুচ্ছ কবিতা








 

বাইশের লাল ঘোড়া

মানতের মতো রেখে যায় কারা যার যার প্রিয় ফুল,
পাপড়ির সাথে মাধুরী মেশানো নানা বর্ণের তোড়া:
শহীদ মিনার নিমেষেই দেখে ফাঁকা তার বেদীমূল
একুশের ফুল খেয়ে চলে যায় বাইশের লাল ঘোড়া!

হঠাৎ কখনো জাবরের পরে উৎকট ক্ষেপে ওঠে:
খুঁজে ফেরে তার মৌসুমী মেনু রক্ত-মাখানো জল,
নগর দাপিয়ে পাগলের প্রায় উড়–ক্কু পায়ে ছোটে
পিছে ফেলে আসে গণভবনের নিকানো আস্তাবল।

হায়েনার মতো হিংস্র দু’চোখ, কেশর ফুলানো ঘাড়,
গগনচুম্বী দালানের চেয়ে উঁচুতে নাড়ায় কান;
খুরের দাপটে রাজপথে ওঠে মিছিলের হাহাকার,
নড়ে ওঠে কাঁচা টিনশেড থেকে ইটের দরদালান।

যবনিকাহীন ধারাবাহিকের চরিত্রগুলো আজও
অসি ঝলকিয়ে অভিষেক করে ক্ষুধিত সরফরাজ
মারে কত রাজা, উজির-নাজির, মরে যায় মহারাজও;
বেঁচে থাকে শুধু রাজকুমারের সাধের পক্ষীরাজ!

ডুবে যেতে যেতে

জলমগ্ন বাঙলাদেশ: নাকি এক ল্যাগব্যাগে তরল ড্রাগন
হিমালয় থেকে নেমে গিলেছে শস্যের মাঠ, বন-উপবন;
নিঝুম দ্বীপের মতো ভাসমান শুধু কিছু ক্লিন্ন লোকালয়
তাকেও জুজুর মতো লেলিহান জিহ্বা নেড়ে সে দেখায় ভয়,
তবুও জীবনছন্দে মুখরিত ব্যস্ত জনপদ
উজিয়ে সকল বাধা, পায়ে-পায়ে সমূহ বিপদ
যে-যার কর্তব্যে যায়; অজানা আতঙ্কে কাঁপে দুরুদুরু জননীর প্রাণ
কোমরে ঘুঙুর বেঁধে ছেড়ে দিয়ে হাঁটি-হাঁটি কোলের সস্তান:
শব্দ শুনে বুঝে নেয় নানা কাজে ব্যস্ত প্রিয়জন
কতদূর হেঁটে গেলো দুষ্টুমতি তাদের খোকন।
* * *
নুনুর কাছে ঘণ্টি নড়ে,
সাধ্যি কী যে খোকনসোনা খন্দে পড়ে!
ভুবন জুড়ে বাজছে যেন একটিই সুর, একটি শুধু গান,
ধ্যানীর মতো সারা বাড়ি শুনছে পেতে কান।
* * *
তাহলে কি উৎকন্ঠিত আমারও জননী কিংবা বুবু ও দাদীমা
এভাবেই এঁকে দিতো এ আমার গন্তব্যের সীমা?
* * *
হয়তো সে শব্দময় অস্তিত্বের সীমানা পেরিয়ে নিঃশব্দেই জানি না কখন প’ড়ে গেছি বিকট পাতালে; চারপাশে খানাখন্দ: উপদংশ-কবলিত স্বৈরিণীর সুবর্ণ ব-দ্বীপে কাদা, আমাকে লোভায় তার সুগভীর ব্যক্তিগত খাড়ি; বিষম হা-করে থাকে পানপাত্র; বন্ধুর বাড়িয়ে-দেয়া অমসৃণ বাঁকা করতল, দ্রাবিড়ীয় কিশোরীর গালে-পড়া টোল আর চটুল হাসিতে খুব ফেটে-পড়া প্রেমিকার মুখের ব্যাদানকেও আজকাল বড় কোনো গর্ত মনে হয়--ক্রুর জল পাক খায় লাভার দাপটে; উন্মাতাল ঘূর্ণিজলে সুবোধ কুটোর মতো ভাসি-ডুবি বিবিধ মুদ্রায়...চুমুকে চুমুকে ডুবি...চুমুতে চুমুতে; নগরীর নানাস্থানে বিপদ-সরণি, মেয়রের পেতে-রাখা অ্যাশফল্টের চোরাবালি আমাকে ডোবায়।

‘আপদে ভরসা প্রাপ্তি’ এমন অভয়বাণী লেখেনি ঠিকুজি
অতল পাতালে তবু ডুবে যেতে যেতে প্রায়শ কী যেন খুঁজি;
পরাস্বপ্নে কেঁদে ওঠে আজও কিছু প্রত্যাশার ক্ষীয়মাণ রেশ.
ঘুঙুর বাজাবো বলে হাতড়ে ফিরি কোমরের বিভিন্ন প্রদেশ।

যা তুই ফিরে যা পাখি

আমার ডাকনাম ধরে ডেকে ওঠে সুদূরের পাখি
অমর্ত্য যমজ ভগ্নি সে আমার কালো সহোদরা
জন্মলগ্নে এই হাতে বেঁধে দিয়ে রাখী
অচেনা সুদূর কোন্ মায়ালোকে উড়ে গেছে অনঙ্গ অধরা।

আমি একা বেড়ে উঠি রূপে-রসে মত্ত যুবরাজ
পেরিয়ে মায়ের ¯েœহ, লালচক্ষু পিতার শাসন
স্বরচিত সংবিধানে গড়ে নিয়ে রঙিন স্বরাজ
একে একে জয় করি যৌবনের গন্ধে-ভরা দারুচিনি বন।

খেয়েছি নারীর মধু, এর চেয়ে বেশি তার ছলনার বিষ;
মধ্যবিত্ত মনে গেঁথে স্বামীত্বের বিপুল ব্যর্থতা
সুখের বিবর্ণ মুখে সাধ্যমতো মেরেছি পালিশ,
দুঃখকে নিয়েছি মেনে অনিবার্য রূঢ় বাস্তবতা।

এর মানে বলতেই হয় সুখে-দুখে জীবন সুন্দর:
কুষ্ঠরোগী হেসে ওঠে মিষ্টি কোনো স্মৃতির জোছনায়,
নুলো ও ঠুঁটোর নারী সন্ততিতে ভরে তোলে পল্লবের ঘর;
কামরুলের কিষানীরা বিলি কাটে চুলের বন্যায়।

যা তুই ফিরে যা পাখি, কালো পাখি, এখন যাবো না--
আগে তো দু’হাত ভরে জীবনের লুটে নিই সোনা!

প্রতিশোধ

মনে আছে? আমাদের ফিটফাট পারিপাট্যে
হাগু করে দিয়েছিলো একটি উড়ন্ত পাখি!
এক অস্ত্রে জোড়াখুন--সেই দুঃখে বিষণœ নগরী
যেন মধ্যরাতে লিবিয়ার প্রশান্ত আকাশে
ভয়াল ডিমের খোসা খুলে দিয়ে
এইমাত্র উড়ে গেলো রিগানের ঈগল বাহিনী।
বিরক্তিতে বলে উঠি: ‘পাখি’ এই শব্দ দিয়ে
আর কোনো কবিতা লিখবো না।
শুনে তুমি হেসে বললে:
পাখির কী আসে যায় তাতে!

আসবে যাবে না মানে?
গোলাপের দিকে চেয়ে আমার অগ্রজ
উচ্চারণ করেছিলো ‘গোলাপ সুন্দর’
সেই থেকে সুন্দর হলো সে!
আর তারই চেতনার রঙে
পান্নাও হয়েছে আজ দারুণ সবুজ!

একদা মাহেন্দ্রক্ষণে কবে কোন্ দক্ষ কারিগর
শুধু শুধু গড়েছিলো জীবিত ও জড়ের প্রতিমা--
ছিন্ন করে সম্পর্কের সূক্ষ্ম তন্তুজাল
কবিরাই দেখে তার অন্তর্গত অপার গরিমা,
আর কিছু মহাকবি আয়াতের সুরে
সৃষ্টি করে চলে গেছে ঈশ্বরের বিমূর্ত আদল!

তাহলেই বোঝো তুমি
পাখির বিরুদ্ধে যদি ক্ষেপে যান কবি
তার কী যে সর্বনাশা কা- ঘটে যাবে!
পালক পড়বে খসে একে-একে বিবিধ নিয়মে,
তার সঙ্গে বাহারি লেজের এই মোহনীয় রূপ
কুষ্ঠরোগ-কবলিত মানুষের দেহ থেকে
যেরকম মাংস খসে যায়; ধীরে ধীরে সব পাখি
হেঁসেলের চামড়া-ছোলা মুরগি হয়ে যাবে!
আর তার কণ্ঠে কোনো মধুর সঙ্গীত?
হো হো...সে তো চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে;
আজেবাজে অর্থহীন কিচির মিচির শুনে
মানুষেরা ত্যক্ত হয়ে বলে বসবে: ছি!
এর চেয়ে ভালো গায় সাবিনা ইয়াসমিন।

কবিকে আঘাত দিয়ে নিজেই দেখো না
দগ্ধ এ-পাখির দশা তোমাদের হবে;
হারবাল-চর্চিত দেহ কুরে খাবে লানতের পোক,
মাখানো উপটানসহ উঠে যাবে লাবণ্যের ছাল,
আর?
মাংসের জ্যামিতি ফুঁড়ে বের হবে বিকট কঙ্কাল!

উত্তরাধুনিক বৃষ্টিপাত

পরাবাস্তব বৃষ্টিতে ভেজে বগলের বর্ষাতি--
শুকনো আষাঢ়, মিছে গর্জায় আকাশের কালো হাতি;
কখনো ধূসর নীলিমায় শু’য়ে গর্ভিনী কোনো মোষ
হতাশার মতো প্রসব করছে সাদা-সাদা খরগোশ!

এ-আষাঢ় যাবে সাদাকালো আর নীলের কোলাজ দেখে?
বর্ষাসংখ্যা সাময়িকী জুড়ে মেঘের পদ্য লে’খে?
ঈশানের দিকে চেয়ে দেখি যেই জমছে সম্ভাবনা
‘বৃষ্টি হবে না’ ঘোষণায় বলে ঢাকা বেতারের খনা।

অবচেতনের কোথায় তবুও কদমের ঘ্রাণ পাই:
অলীক জলের শিহরণে কাঁপে করিডোরে বনসাই--
স্মৃতির ভেতরে পাঠশালা ভেজে, থকথকে বইখাতা;
আমি আর সাজু--মাথার উপরে যৌথ কলার পাতা।

ভেজা কিশোরীর শরীরের ঘ্রাণে সম্বিতে ফিরে দেখি
চৈত্রের মতো গদ্যরমণী চোখ ঠারে তার মেকি।
বৃথা শৃঙ্গারে শরীর কাঁপিয়ে শুয়ে পড়ি নিজ খাটে,
কামনার জলে “বঁধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরান ফাটে...”

করাতকলের শব্দেরা বোনে বর্ষাধুমল রাত--
আগামী শাওন বৃথা যাবে না তো, হবে কি বৃষ্টিপাত?


ফল্গুধারা নীরবে বয়

স্রোতে তোমার জন্ম, তুমি স্রোতেই হবে লীন;
ফল্গুধারা নীরবে বয় সাড়াশব্দহীন।
হাট বসালে ক্রেতাও জোটে, খৈ ছিটালে পাখি;
নির্মাতাই জানে কেবল পণ্যে কত ফাঁকি!

কালের ডামাডোলের ফাঁকে চক্ষে দিয়ে ধুলো
ভাবছো তুমি গানের সাথে বিকাবে শোরগোলও?
প্রাত্যহিকে রঙ মাখিয়ে শাশ্বতকে জয়
করাও যাবে--জানতে হবে রঙের পরিচয়।

কোথায় তুমি জানলা খোলো আদপে নাই ঘর;
যুগ চেনো না কী করে তবে আনো যুগান্তর?

স্রোতে তোমার জন্ম, তুমি স্রোতেই হবে লীন;
ফল্গুধারা নীরবে বয় সাড়াশব্দহীন।

আমি কার খালু

ধীরে ধীরে হাট ভাঙছে,
অন্ধকার টেনে ধরছে দিগন্তের ফিকে লালসালু--
ডেকেছি বিস্তর তবু কেউ এসে বলে নাই আমি কার খালু!

উল্লোল বাজারি শব্দে ডুবে গেছে হার্দ্য এই ডাক,
বিপণি বিতান থেকে মাছের মহাল, মায় অন্ধগলি ঘুরেছি বেবাক;
কানফাটা শোরগোলেও কেউ কিছু ভোলে নাই কার কী ভূমিকা:
লাভ বুঝে দর হাঁকে বিক্রেতারা,
ক্রেতা কেনে দেখে দেখে ফর্দে কী কী লিখা।
দুরস্ত সাহেব-সুবো, মলিন ভিখিরি থেকে উলঙ্গ টোকাই
এ-হাটে সবাই ব্যস্ত--আমি শুধু দিগ্ভ্রান্ত কিছু মনে নাই
কী করতে এসেছি আর হারিয়েছে কাকে নাকি নিজেকেই খুঁজি!
ছিলো কি আমার কোনো ঠিকানা ও নিজস্ব ঠিকুজি?

জানিও না এই হাটে কে আছেন এমন দয়ালু
আমাকে যাবার আগে ঠিকঠাক বলে দেবে আমি কার খালু!
জৈবনিকতা

অনেক দেখেছি পাঁকাল-বিলাসী কাদাজলে রাজহাঁস,
মসৃণ পাখা রেশমখচিত ছোঁয় না পঙ্কিলতা!
অথবা আমার বালকবেলার মোহময়ী মেথরানী
রূপের ছটায় ভুলে গেছি তার গুয়ের রাজ্যে বাস।

পট্টি যখন বাঙলা মদের উৎসবে গোলজার
সে তখন ছিলো পট্টরানীর আসনে অধিষ্ঠিত―
ঘাগড়ায়-লাগা শুদ্র অথবা ভদ্রপাড়ার মল;
“লছমী নাকি রে!” কুশল শুধাতো তবু খোদ জমিদার।

কাদায় পদ্ম, চাঁদে কলঙ্ক এ-কথা এখন ক্লিশে,
ময়ূর নিজে কি পেখম গোটায় বিশ্রী পায়ের খেদে?
রূপের দোহাই শুচিবায় ছেড়ে জৈবনিকতা শেখো―
খ্যাতিমান বহু কবিও ভুগেছে উপদংশের বিষে।




(এএ/এসসি/জুলাই২১,২০১৫)


পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test