E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

'নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়'- দার্শনিক ভাবনার ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ

২০১৫ সেপ্টেম্বর ০১ ২৩:৪৩:০৭
'নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়'- দার্শনিক ভাবনার ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ






 

ইয়াসির আজিজ

নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়'- কবি সমর চক্রবর্তী'র একটি কাব্যগ্রন্থের নাম এটি। বইয়ের প্রথম কবিতাটির শিরোনামও এটি। এই একটি উচ্চারণ 'নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়' সমরের কবিতা সম্পর্কে অনেকখানি ধারণা দিয়ে দেয়। এটি একটি চিত্রকল্প হতে পারে, আবার মনে হতে পারে কবির এক ধরনের আবিস্কারও। মৃত নক্ষত্র কখনো গ্রহ হতে পারে কি পারে না, বিজ্ঞান হয়তো এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে , কিন্তু আমরা যখন বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে কবির মনোজগতের উপলব্ধিকে স্পর্শ করব, তখন দেখব যে এই এক চিরসত্য। আমাদের এই পৃথিবীর বাইরে অসংখ্য গ্রহ আছে সেগুলোতে প্রাণের অস্তিত্ব নেই, অথচ তারা নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করে রাতের আকাশে, কাজেই এদের নক্ষত্রের মৃত ছাড়া আর কিইবা বলা চলে।

কিন্তু আমরা জানি যে, কবিতা তার সরাসরি অর্থের বাইরে বিশেষ অর্থ বহন করে, রূপক বা প্রতীক হয়ে ব্যবহৃত হয় কবিতার অনেক উপাদান বা বস্তু। সে কারণে আমরা ধরে নিই যে মানুষের এক প্রকার মৃত নক্ষত্রের মতো অস্তিত্বের কথা কবি বলতে চাচ্ছেন তাঁর এই কবিতার বইয়ের নামকরণের মধ্য দিয়ে।
সমর চক্রবর্তীর কবিতার যে প্রধান প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি সেটা হচ্ছে দার্শনিকতা। কবি তাঁর জীবনবোধের রূপায়নে অনেকটাই আবেগ তাড়িত, কিন্তু এই আবেগের লাগাম তিনি টেনে ধরতে পারেন, এবং তখন তাঁর গন্তব্য বা স্টেশন উপস্থিত হয়, এই স্টেশনটি হচ্ছে দর্শনের। অজস্র জিজ্ঞাসাই রেখে যেতে চানপাঠকদের সামনে, যার উত্তর দিতে হলে অবশ্যই আশ্রয় নিতে হয় দর্শন শাস্ত্রের। যদিও তাঁর দর্শন পাঠ্যসূচির নয়, বরং জীবন দিয়ে অনুভব এ আবিস্কারের।

'মহাসিন্ধুর বিমূর্ত অব্যয়ে/শূন্য সেঁচে সংখ্যা, ক্রমিক গণিত দিগন্ত প্রশ্ন হয়ে ফোটে....../। কে মানুষ-নিসর্গ ব্যজ্ঞিত আত্মা বিম্বিত কে আয়না? (আয়না)।' এই তিনটি পঙক্তির ভেতর চিন্তার অনেক উপাদান ঢেউ তোলে, বোঝা যায় কবি তাঁর উপলব্ধিকে কতটা গভীরভাবে ব্যক্ত করতে সক্ষম।
'কার ইশারা/ঝরে পড়ে বায়বীয় অস্থির উপর!/আমিও জন্ম দিতে থাকি/এসময় জলের আগুন ডানায়/......(নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়)।' কবি সমর চক্রবর্তী একেবারেই তৃণমূল ছুঁয়ে থাকা একজন মানুষ। তাঁর জীবনাচারণ এখনই যে তাঁর কবিতায় সহজাত হয়ে ওঠে এ ধরনের প্রগাঢ় জীবন দর্শন। এই সব বোধ তাঁর প্রতিদিনের ভাবনায় একাকার হয়ে যায়, ফলে তাঁর কাব্যভাষার একেবারেই তাঁর মতো করে গড়ে উঠতে পারে।
সমরের কাব্যভাষার আর একটি নক্ষত্রকে সনাক্ত করতে হয় এবং সেটা হলো এই যে দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার ক্ষমতা। তাঁর পঙক্তি গঠন রীতি এর জন্যই অনেকটা আলাদা মনে হয়। এমনিতে খুব জটিল নয়, কিন্তু দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার ফলে ভাবনার ব্যাপ্তি বেড়ে যায়, দীক্ষিত পাঠক ছাড়া এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না।
রূপকাশ্রয়ী বাক্য প্রায়শ ব্যবহার করেন সমর, প্রতীকের ব্যবহারও তাঁর কবিতায় প্রচুর। "দীর্ঘজীবন প্রকৃতির সংসারে একা বৃক্ষ/বিমূর্ত বীজের শূন্যতায় মূর্ত হয়ে আছি।"- এরকম পঙক্তিগুলো রূপক বা প্রতীকের প্রয়োজন মিটিয়ে উপরি হিসেবে হৃদয়কে দোলায়িত করে নিজগুণেই।
শূন্যতা সম্ভবত সমরের একটি প্রিয় বিষয়। অনেক কবিতাতেই তিনি এই শব্দটিকে স্থাপন করেছেন, এবং তা এসেছে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর ভাবনার অনুষঙ্গ হয়ে। তাঁর একটি কবিতা থেকে এই শূন্যকে দেখে নেওয়া যাক-
'শূন্যতার স্পন্দন থেকে
শব্দ কুড়োতে কুড়োতে এই আমি
কামনায় ঢালি বিষ,
রহস্যের জুগুপ্সা বারবার প্রেম শূন্য করে আমাকে

বা,
শূন্য, ক্রমশ মহাশূন্য হয়ে যায়' (শ্রেষ্ঠ আশ্রয়)
এই একই কবিতায় তিনি শূন্যতাকে অতিক্রম করে যান দু'টি পঙক্তির শক্তিতে
'প্রকৃত নিঃসঙ্গ হলে- যথার্থ প্রেমিক হয়,
মানুষ নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।'
ভাবালুতাকে লালন করলেও কবি সমর চক্রবর্তী বাস্তবতাকে বিস্মৃত হননি। অনেক কবিতাতেই তার স্বাক্ষর মেলে। এবং কবি সহজেই তুলে ধরতে পেরেছেন বাস্তবতার কঠোর ও নীল দংশনের মূল উপাদান যে মুদ্রা ব্যবস্থা, তার স্বরূপ। এখানেও কবির নিজস্ব ভাবভঙ্গি লক্ষণীয়ঃ
'শিল্প সুষমায় বিষ ঢেলে
সম্ভোগ শয্যায়ও তুমি দাঁত কেলিয়ে হাসো
ও মুদ্রা, কাগজের মুদ্রারে......'

'ও...... ইউরো, ডলাররে......
আলিঙ্গনে আমি হিম হয়ে যাই নিভে যায় শিশ্নের উত্তাপ।

এই বাস্তবতারই অপর পিঠ খুঁজতে বা সান্ত্বনার সবুজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার কথাও আছে তাঁর কবিতায়। এবং এর কমই একটি কবিতায় বঙ্গীয় আত্মার শ্যামল গ্রাম কবির গভীর টান ধরা পড়ে শব্দের সুষমামন্ডিত ব্যবহারে। খানিকটা উদ্ধৃত করা যাক-

'জীবন ভালোবাসি গ্রামমাখা জীবনের লোভে।
সেইযে মায়াময় বন-বিথীকা, মোহময় তরুলতা বৃক্ষ
অবারিত শস্যগন্ধা মাঠ-প্রাণের ভেতর হু হু উদার বাতাস
তরঙ্গায়িত সুঠাময় নদী, নদীর উপর সাঁকো
দূরে নীল গ্রাম-
আমার দূরন্ত শৈশব, ঘূর্ণায়মান লাটিম!'
এর একটি শব্দ যেন প্রাণের ঐশ্বর্যের কারণে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে, এক একটি বাক্য প্রকাশ করছে গ্রামের দারুণ সব চিত্রকল্প, সেখানে বর্ণিল শৈশব, আর বর্তমান জীবনের হাহাকার শুধুই ফিরে যাওয়ার জন্য।

সমর চক্রবর্তীর কবিতা গভীর মনোনিবেশ দাবি করে তাঁর শব্দ ব্যবহারের কুশলতার কারণে। এক একটি শব্দ বিশিষ্ট হয়ে ওঠে পঙক্তিতে নতুন অবয়ব দান করে, এবং দেখা যায় সমস্ত কিছু মিলে বর্ণাঢ্য আয়োজন তৈরি হয়ে থাকে। তাঁর কবিতায় প্রেমের প্রসঙ্গ অনুপস্থিত নয়, তবে সেখানে জীবন জিজ্ঞাসা ও কবিতার প্রতি মোহ কাজ করে বেশি। কবি তাঁর প্রিয়তমার প্রসঙ্গ আনতে গিয়ে সচেতন ভাবেই নিয়ে আসেন, তাঁর ভাষায়, শূন্যতার গণিতভাষা' কিংবা 'অব্যয়ের লাবণ্য কুয়াশা'- এ ধরনের উচ্চারণ এবং তাঁর মতে সব কিছুই যেন মনে হয়ে যায়, সম্পর্ক কংকাল শুধু থাকে পড়ে।

'নক্ষত্র মরে মরে গ্রহ হয়ে যায়' কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতাটি একটি দীর্ঘ কবিতা। এটি একটি আত্মজৈবনিক কবিতা হলেও সেখানে তিনি তুলে এনেছেন চিরায়ত বাংলার একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে।এটি একটি মুক্তিযুদ্ধের কবিতাও । কবিতার শিরোনাম বাবার স্বপ্ন। বাবার স্বপ্ন-সাধ, জীবন স্থাপন অভ্যাসকে তিনি বর্ণনা করেছেন- কোথাও কোথাও এ বর্ণনা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের মতো মনে হলেও আকাঙ্খা ও আবেগের রথে চড়ে এটি গতিশীল থেকেছে, বিষয়ভাবনা অন্য পাঠকের মনে উত্তাপ ও শৈত্য ছড়িয়েছে, এবং সেই সাথে এটি পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের মানবিক জীবন যাপন স্বপ্নকে।

বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এবং নব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি সমর চক্রবর্তী। তিনি মূলতঃ শব্দ নিয়ে খেলা করেন। সৃষ্টি করেন নতুন নতুন শব্দভাষা; স্মরণযোগ্যকাব্যময় উজ্জ্বল পঙক্তি। নিজস্ব ভাষা-শৈলীতে উপস্থাপিত স্বতন্ত্র ধারার কবিতাগুলো সহজেই পাঠকের উপলব্ধির দরোজায় কড়া নাড়ে। পুস্পিত প্রকৃতি, চেতনা, স্বাধীন মতবাদ, নতুন চিন্তা, সর্বোপরি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বোধ ভেঙ্গে শাব্দিকতার অণু-পরমাণু সৃষ্টির নৈপূণ্যতা তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

গ্রন্থটির প্রকাশক মুক্তচিন্তা প্রকাশন। প্রকাশকাল এপ্রিল ২০১১। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাহবাবুর রহমান/ মূল্য ১০০ টাকা।



পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test