E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

গল্প

২০১৫ সেপ্টেম্বর ১৫ ১৩:১৭:৪৪
গল্প






 

জলে ধোয়া পানসে রক্ত

তরিকুল জনি

ঝুম বর্ষা হচ্ছে। আকাশ হাউমাউ করে বুক চাপিয়ে-দাপিয়ে ঢেলে দিচ্ছে তার জমিয়ে রাখা এতদিনের জল। যে জল পুড়েছিলো রোদে-সূর্যের সহবাসে। উবু হয়ে জল ঢালতে-ঢালতে টলমল উদাস হচ্ছে আকাশ। এই উদাসী আকাশের দিনে আমি খুন করবো। একজনকে খুনের মতো করে খুন করবো। হৃদয়ের সব প্রেম দিয়ে খুন করবো। হাসতে-হাসতে, ভালো বাসতে-বাসতে খুন করবো।

‘আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে...’এই সব কী যেন পড়তাম ছোটবেলায়, মনে করতে পারছি না। যদিও এখন এগুলো মনে করারও কথা না। তবুও প্রথম লাইটা মগজে গেথে আছে। কেনো গেথে আছে, এতো দিন এতো বছর ধরে ? আমি জানি না।
দূরের সব কিছু কুয়াশার মতো ঝাপসা। টানা বর্ষায় দুলে যাচ্ছে এদিক-ওদিক। দৃষ্টির দূরত্ব ছোট হয়ে আসছে চোখের সামনে থেকে। দূর বলতে সামনে কেবল জলধারা। জলের সাথে মিশে যাচ্ছে আরেক জল। জলের ওধারে আশুলিয়া শহর। সেখানে গিয়েছিলাম কয়েক বার। ওর সাথেই গিয়েছি। ও আমাকে আশুলিয়া যাওয়া শিখিয়েছে। ভেঙেছে যৌবনের বয়স। আমি ভেঙেছিলাম সেবার ওর পরশে। ওর আঙুলের খেলাতে। আশুলিয়া আমার ভাঙার শহর। ছিড়ে যাওয়া রক্তের শহর। শালোয়ার কামিজে মিশেমিলে যাওয়ার শহর। আজ বর্ষার দাপোটে দেখা যাচ্ছে না সেই শহর। তবুও আমি চিনি। এই যে তিন রাস্তার মোড়। ঐদিকের রাস্তা গিয়েছে আব্দুল্লাপুর, উত্তরায়। উত্তরায়ও গিয়েছি এক ফ্লাট বাসায়। সে অধ্যায় এখন আর মনে করতে চাইছি না। সেছিল একটা দেহ বেচাকেনার অধ্যায়। আর এই যে এই রাস্তাটা চলে গেছে সোজা আশুলিয়ায়। আর আমার পেছনে মিরপুর; আমার ঢাকা শহর। ভেড়িবাঁধে ঘিরে রাখা এক ঢাকা শহর। এই শহরে দূরকে বড় কাছে দেখায়। এই তো সব কিছুই কেমন কাছে আছে। কাছের জন-কাছের মানুষ। সবাই থাকে পাশাপাশি। কিন্তু হাত বাড়ালে, হাত দূরে সরে যায়, অনেক দূরে, বহু দূরে, বহু দূরে...। এই কাছে থাকা দূরের শহরে আমার বাস। আমার ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যাওয়া দিনগুলো বেড়ে উঠে এই শহরের ইটের উপর আরেক ইটের ঘরে।

এই ভেড়িবাঁধে ওর আসার কথা। গতকাল মাঝ রাতে ঘুম ছিড়ে-ছিড়ে ওর সাথে কথা হয়েছে। আমি রাজি হয়েছি ওর সব কথায় ঘুমের ঘোরে আর এক ঘুম ভেঙে। মেঘলা আকাশের এই বর্ষা ভেজা দিনে আমরা কোনো এক আবাসিক হোটেলে সময় কাটোবো। আমি জানি আবাসিক হোটেল মানে গোপন সিসি ক্যামেরা। কিছু দৃশ্য ভিডিও। তারপর কী কী হবে সবই আমার জানা। কিন্তু আজ ওসব কিছুই হবে না। তার আগে সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে। আমিই শেষ করবো। খেলাটা ও‘ই প্রথম শুরু করেছিলো। যখন আমি খেলনা ছিলাম, তখন ওর শুরু। ও খেলছিলো। ওর খেলায় আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন হয়ে আমি দারুণ পাকা খেলোয়ার হয়ে গেছি। এখন আমি খেলা শেষ করতে পারি। একাই শেষ করতে পারি। এখন আমার পাশে কেউ নেই। একা‘র মাঝে আমি এক দারুণ একা। এই বর্ষা ভেজা একলা রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট টোং দোকানের ছাউনির নিচেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। দোকানটার আশেপাশে আর কোনো দোকান নেই। ঝুম বর্ষায় ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক।

এমনও বর্ষায় ভালোবেসেছিলাম ওকে। ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল এমনও বাদলও ঘন বর্ষায়। জড়িয়ে ধরেছিলাম ওর বুক। দুরুদুরু এক বুকে, ভেজা শরীরে। মিরপুরের রূপনগরে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসের অপেক্ষায় কোনো এক বর্ষাদিনে। এতো সাত সকালে অপেক্ষার লাইনে কেউ ছিলো না দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায়। আমি ছিলাম। চারিদিকে বর্ষা বয়ে যাচ্ছে। দোকানপাট কেউ খুলিনি, কেউ সওদা সাজিয়ে রাখে নি। করেনি কেউ বেচাকেনা। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে কেউ নেই, একা আর আমি একার সাথে। হঠাৎ আমার পেছনে একজন এসে দাঁড়ালো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। ছেলেটা ঘড়ি দেখলো। খুব তাড়া আছে ওর, বুঝলাম। আমারও ছিলো তাড়া, তাইতো এই সাতসকালে ঘর থেকে বের হওয়া। আকাশ থেকে ঝড়ছে বর্ষা। গর্ভবতী আকাশ তার প্রসববেদনায় মাঝে-মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে। জানান দিচ্ছে এবার নামবে ঘনবর্ষা। ভোরের আকাশে বৃষ্টি বাতাসে অন্ধকারের মত আলো নেমে আসে। আকাশের বুকে একটা চিড় দিয়ে উজ্জ্বল আলোর রেখা চলে যায় আবছা-আবছা অন্ধকারকে ডিঙ্গিয়ে। তারপর হয় ভংকার বজ্রপাত। আমার মাথা জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। অজানা এক আশ্রয় খুঁজতে চায় মন। আশেপাশে কেউ নেই। মন পেয়ে যায় এক যুবকের বুক। আমি ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। জড়িয়ে ধরি ভরসার বুক। উড়ে যায় দুজনের মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ছাতা। ভিজে যায় দুটি শরীর। এভাবে বেড়ে ওঠে একটা সম্পর্ক। সময়ের পর সময় গড়াতে-গড়াতে এই সম্পর্কটা সু-সম্পর্ক থেকে এক জটিল সম্পর্কে রূপ নেয়। আজ সেই জটিল সম্পর্কটা হয়তো সহজ হয়ে যাবে। জলের মতন সহজ। আচ্ছা জল কি সহজ? আমার কাছে মানুষের সম্পর্কটা জলের মতন মনে হয়। জলের যেমন তিনটি রূপ, সম্পর্কেরও তাই। জলের ধর্ম আর সম্পর্কের ধর্ম একই মনে হয়। এরা শুধু গড়াতেই জানে।

ফেলে আসা জীবনটা সরলরেখার মতোই সোজা ছিল আমার। কিন্তু আমার আশেপাশের সময়টা সরল অংকের মতো ছিল। একটার পর একটা জটিল ধাপ আমাকে পেরোতে হচ্ছিল। অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একজন মেয়ে ছিলাম আমি। ঢাকা শহর; এ যেন কুয়া থেকে উঠে আসে এক মহাসমুদ্রে পড়া। চারিদিকে জল আর ঢেউ, আমি সাঁতারের পর সাঁতার দিই। থেকে- থেকে দোম নিতে বড় কষ্ট হয়। তখন কিছু একটা ধরে উঠার চেষ্টা করছি। আর সে সময়টা কাজে লাগায় ও। ওকে বিশ্বাস করেই হাত ধরেছিলাম। কিন্তু সেহাতে যে রক্ত ভাসবে আমি জানতাম না। আমি অনেক কিছুর শেষ জানতে পারি না কিন্তু অনেক কিছুই হয়ে যায়-ফুরিয়ে যায়।

একটু আগে আমি ওকে ফোন দিয়েছি। যাকে খুন করবো বলে ভেবেছি, বহু কাল, বহু দিন, বহু ক্ষণ ধরে। আজ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি। একটা খুনের সিদ্ধান্ত, একজন মানুষকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত। কত জটিল একটা বিষয়। অনেক ভাবনার একটা বিষয়। কিন্তু এই জটিল আর ভাবনার কাজটা ও করেনি। একদিন হুট করে এসে বললো, চলো আমরা বাচ্চাটা ফেলেদি। কতো সহজে কঠিন কথাটা বলে ফেললো। যে বাচ্চা আমার দেহ কুড়েকুড়ে খেয়ে বড় হচ্ছে। সেটা ও ফেলে দিতে বলছে। অবশ্য ও সব কিছুই সহজ করে বলে। সহজ করে সব কিছু করতে ও বড় বেশি ভালোবাসে। আমার সাথে প্রথম যেদিন বিছানায় গেলো। কতো সহজেই না গেলো। সব কিছু বুঝার আগেই আমর সব লুফে নিয়ে নিলো। ও বড় দ্রুত নিতে পারে। সব কিছুই ওর দ্রুত চায়। কিন্তু আমি দ্রুত সব কিছুতে যেতে পারি না। আমার যেতে বড় দেরি হয়। এই যে খুনটা করবো। এটা ভাবতে হয়েছে বড় দেরিতে। ভাবতে-ভাবতে আমি হারিয়েছি সব। ভেসে গেছে সব। কিন্তু কোনো ভাবনাতে আসতে পারিনি আমি। আজ আসতে পেরেছি।

আচ্ছা আমি কি সব গুছিয়ে বলতে পারছি? আমার মনে ভেতরের কথাগুলো, পাঁজরে ঠাঁসা এক বুকের ভেতরে আর এক বুকের জমানো কষ্টগুলো কি আপনারা জানতে পারছেন? আমি অনেক কিছুই জানাতে পারি না। এই কাছে থাকা দূরের শহরে আসার পর আমার উপর যে বালুর ঝড় বয়ে গেছে আমি উটপাখির মতন তা মাথা গুজে সহেছি। আর দেখেছি একটা দোয়েল পাখি কীভাবে উটপাখি হয়ে যায়। আমি তখনও অনেককে অনেক কথা বলতে পারিনি।

বর্ষার বিছানো রিনিঝিনি শব্দের ভেতর মোবাইলের রিংটোন জানান দিলো এই যান্ত্রিক সভ্যতাকে। ব্যাগ থেকে মোবাইল রেব করে দেখি ওর কল। ও জানতে চায়, আমি আছি কি না, দাঁড়িয়ে ওর জন্য? আমি তো দাঁড়িয়ে আছি। ‘সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতন দাঁড়িয়ে থাকি’। আচ্ছা এটা কি কোনো কবিতার লাইন? আমি ভাবতে পারছি না। কবিতার মতন ছন্দ কি ছিলো, আমার জীবনে? সেই গ্রাম্য বালিকার? যে বর্ষা ভেজা দিনে পলিব্যাগে বই নিয়ে জলকাদা মাখা রাস্তা দিয়ে ফিরে ছিলো স্কুল থেকে এক বালকের সাথে। যে বালকটা মারা গিয়েছিলো জোছনা রাতে সাপের কামড়ে। যার জন্য বুক ভাসিয়ে কেঁদে ছিলো এই বালিকার দুচোখ।
মোবাইলের ওপাশ থেকে ও জানতে চায়ছে। আমি কথা বলছি না কেনো? আমি কখন যে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি; খেয়াল করেনি এই মন। আমার মনটা কি আমার সাথে আছে? মন তো চলে গেছে সেই গ্রাম্য বালকের কাছে। যে বউ-বউ খেলার সময় কচুড়িপানার ফুল এনে দিয়েছিলো এই হাতে। আজ কেনো মনে পড়ছে সেই বালককের কথা। তার কাছে কেনো চলে যেতে ইচ্ছে করছে এই বর্ষা প্লাবণে? আমি যাবো, হ্যাঁ চলে যাবো তার কাছে।
মোবাইলের ওপাশ থেকে আবারও জানতে চায়, আমি আছি কি না, দাঁড়িয়ে ওর জন্য?
আমি হ্যাঁ বললাম। ও আসছে। এ আসায় শেষ আসা ওর। আমার মগজ হালাকা হয়ে যাচ্ছে। ছেলেবেলার মেয়ে হওয়ার জীবনটা খুব মনে পড়ছে। যে জীবনে একটা বলক ছিল। গ্রাম্য দুপুরে পুকুর জুড়ে অবাধ ডুবসাঁতার খেলা ছিলো। আচ্ছা সব খেলা কি খেলা হয়ে যায়? কোনো-কোনো খেলা তো আর খেলা থাকে না। খেলা শেষে এক একটা জীবন হয়ে যায়।

লাল রঙের ছোট্ট একটা নেনোগাড়ি থেকে ও নামলো। ব্যাঙের মতন লাফ দিয়ে আমার কাছে এলো। গায়ে গা গেসে দাঁড়ালো।
কোনো কিছু বুঝার আগেই আমি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছুরিটা বের করে ওর পেটে বসিয়ে দিলাম। কত বার বসিয়েছি আমার মনে নেই। আমার ছুরি ঢুকেছে আর বেরিয়েছে। যখন ক্লান্ত হয়েছি, তখনই থেমেছি।
নিথর শরীর নিয়ে ও পড়ে গেলো রাস্তায়। যে রাস্তা জলে ধুয়ে যাচ্ছে তার কালো পিচ।
আমার কান্না পাচ্ছে। রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। গাঢ় রক্ত জলে ধুতে-ধুতে সাদা হয়ে যাচ্ছে। জলধারায় মিশে যাচ্ছে, পানসে হয়ে যাচ্ছে রক্ত। আমি দেখছি। একজন মানুষের রক্ত সাদা হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ঝুম বর্ষা হচ্ছে। ধুয়ে যাচ্ছে সব।
আমি দূরে দেখতে পেলাম, বর্ষায় ভিজতে-ভিজতে বালকটি ডাকছে আমায়।




(ওএস/এসসি/সেপ্টেম্বর১৫,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test