E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

‘দলে জায়গা হারানো থেকে কলম্বিয়ার ফুটবল সম্রাট’

২০২৪ জুলাই ১৩ ২০:৫৭:১৭
‘দলে জায়গা হারানো থেকে কলম্বিয়ার ফুটবল সম্রাট’

স্পোর্টস ডেস্ক : প্রায় দুই বছর ও ২৮ ম্যাচ ধরে কলম্বিয়ার অজেয় যাত্রার বড় কারিগর রদ্রিগেজ। একের পর এক অ্যাসিস্ট করে কোপা আমেরিকায় দলকে ফাইনালে তুলে তিনিই এখন পর্যন্ত তর্কযোগ্যভাবে টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার।

'দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই আমি হামেসের সঙ্গে দেখা করেছি। জাতীয় দলে খেলার জন্য ওর নিশ্চয়তা নিয়েছি’- কথাগুলো বলেছেন কলম্বিয়া কোচ নেস্তর লরেন্সো। অথচ একের পর কোচের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে হারিয়েই যেতে বসেছিলেন হামেস রদ্রিগেজ।

ক্লাব ক্যারিয়ার পায়নি প্রত্যাশিত গতি। জায়গা হারিয়ে ফেলেন জাতীয় দল থেকেও। তবে অতীতের কোচদের তিক্ত অভিজ্ঞতায় নজর না দিয়ে লরেন্সো দায়িত্ব সঁপে দেন রদ্রিগেজের কাঁধে। আর ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রদ্রিগেজই এখন কলম্বিয়ার স্বপ্নযাত্রার নায়ক।

কলম্বিয়াকে ২৩ বছর পর কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন করার অভিযানে আর্জেন্টিনা-বাধা উতরানোর জন্যও লরেন্সোর বড় ভরসাই হবেন রদ্রিগেজ৷ আর ম্যাচটি জিততে পারলেই হয়তো পূর্ণতা পাবে তার অপার সম্ভাবনার এক ক্যারিয়ার।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তুমুল প্রতিভাবান হিসেবে পরিচিত ছিলেন রদ্রিগেজ। লাতিন আমেরিকান ফুটবলের বিস্ময় বালকদের একজন হয়েই আবির্ভাব ঘটে তার৷ পথচলার শুরুতে সম্ভাবনার ফুল অনেকটাই প্রস্ফুটিত হয় কলম্বিয়ান প্রতিভার।


২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপে সবাইকে ছাপিয়ে রদ্রিগেজই জেতেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুট। কলম্বিয়ার কোনো ফুটবলারের জন্য সেটি ছিল স্বপ্নের মতো। ওই আসরে উরুগুয়ের বিপক্ষে বুক দিয়ে নামিয়ে হাওয়ায় ভেসে থাকা বলে ডি-বক্সের বাইরে থেকে দর্শনীয় এক ভলিতে গোল করে সেই বছরের পুসকাস অ‍্যাওয়ার্ডও জেতেন তিনি।

জাতীয় দলের সাফল্য তাকে এনে দেয় ক্লাব ফুটবলেও বড় দলের সুযোগ। রিয়াল মাদ্রিদে ছিলেন লম্বা সময়। ২০১৪-১৫ মৌসুমে টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচের মতো সতীর্থদের টপকে তিনি পান লা লিগার সেরা মিডফিল্ডারের স্বীকৃতি।

এরপরও সুখকর হয়নি তার রিয়াল অধ্যায়। প্রথমে রাফায়েল বেনিতেস, পরে জিনেদিন জিদানের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে মাঠের ফুটবল থেকে মনোযোগ হারান রদ্রিগেজ। তাকে বায়ার্ন মিউনিখে ধারে পাঠিয়ে দেয় রিয়াল।

ক্লাব ফুটবলের এসব নেতিবাচক খবরের ছাপ পড়ে তার জাতীয় দলের ক্যারিয়ারেও। দেশে অনেক ভক্ত-সমর্থক থাকলেও তার নিন্দুকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। ২০১৯ সালে কলম্বিয়ার কোচ কার্লোস কিরোসের সঙ্গে বিবাদের খবর প্রকাশ্যে আসে।

২০১৮ বিশ্বকাপের পর কিরোস জানিয়ে দেন, রদ্রিগেজ আর মূল তারকা নন কলম্বিয়ার। অন্য ভালো ফুটবলারদের একজন। বিষয়টি যেন মানতে পারেননি রদ্রিগেজ। খবরে আসে, বদলি হিসেবে খেলানোর চিন্তা থাকলে কিরোস যেন তাকে বিবেচনা না করেন, বলেছেন রদ্রিগেজ।

পরে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে উরুগুয়ে ও একুয়েডরের বিপক্ষে দুই ম্যাচ মিলিয়ে ৯ গোল হজমের পর চাকরি হারান কিরোস। দায়িত্ব দেওয়া হয় রেইনালদো রুয়েদাকে। তাতেও অবশ্য রদ্রিগেজের ভাগ্য বদল ঘটেনি। বরং নতুন কোচের সঙ্গেও তার বিবাদের খবর ছড়িয়ে পড়ে।

জাতীয় দলের আরেক স্ট্রাইকার লুইস মুনিয়েলের সঙ্গে ড্রেসিং রুমে ঝামেলায় জড়িয়ে বিপদ আরও বাড়ান রদ্রিগেজ। তাকে ছাড়াই বিশ্বকাপ বাছাই ও ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার দল সাজান রুয়েদা।

বাদ পড়া মানতে পারেননি রদ্রিগেজ। সামাজিক মাধ্যমে বিশদ বার্তায় কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট ও দেশের ফুটবল ফেডারেশনের এক হাত নেন তিনি। ততদিনে রিয়াল অধ্যায় শেষ করে তার ঠিকানা ইংলিশ ক্লাব এভারটন। এরপর ২০২১-২২ মৌসুমে সৌদি আরবের আল রায়ানে চলে যান রদ্রিগেস।

২০২১ সালের কোপায় কলম্বিয়া সেমি-ফাইনালে উঠলে রুয়েদার সিদ্ধান্তই সঠিক মনে হতে থাকে। আর রদ্রিগেজর অনুপস্থিতিতে জাতীয় দলের বড় দায়িত্ব সামলাতে থাকেন লুইস দিয়াস। তার মাঝেই নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন কলম্বিয়ানরা।

কোচদের সঙ্গে রদ্রিগেজের বিবাদের বিষয়ে ফুটবলারের দায়ই দেখেন কলম্বিয়ার সাংবাদিক কার্লোস আন্তনিও ভেলেস।

“ক্লাউদিও রানিয়েরি, রাফা বেনিতেস, জিনেদিন জিদান, নিকো কোভাচ, কার্লোস কিরোস আর এখন রেইনালদো রুয়েদা। এতসব ঝামেলার পরে যে কেউই বুঝতে পারবে, এটি কোনো ধারা নয় বরং একজন ব্যক্তির (সমস্যা)।”

কোপায় সফল হলেও বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্যর্থ হন রুয়েদা। এর আগেই অবশ্য রদ্রিগেজকে দলে ফেরান তিনি। তবু তাকে ছাঁটাই করতে ভাবেনি কলম্বিয়ার ফুটবল ফেডারেশন। নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয় লরেন্সোকে। তিনি প্রথমেই দেখা করেন রদ্রিগেজের সঙ্গে। অতীতের সব ঝামেলা ভুলিয়ে রদ্রিগেজকেই করেন দলের প্রাণভোমরা, তার হাতে তুলে দেন অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড।

নতুন কোচের অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচ হারেনি কলম্বিয়া। আর্জেন্টাইন কোচ দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন, উরুগুয়ের মতো দলকে হারিয়ে টানা ২৮ ম্যাচ ধরে অপরাজিত তারা। আর এই সাফল্যের পেছনে লরেন্সো নিজেও বড় কৃতিত্ব দেন রদ্রিগেজকে। যার প্রমাণ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে চলতি কোপা আমেরিকায়।

টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত ১ গোলের সঙ্গে ৬টি অ্যাসিস্ট করেছেন রদ্রিগেজ। কোপা আমেরিকার এক আসরে এটিই সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের রেকর্ড। পানামার বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে পেনাল্টি থেকে গোল করে উদযাপনের জন্য সাইডলাইনের কাছে গিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে যান রদ্রিগেজ। তখন তার কাছে এসে মুকুট পরিয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করেন দিয়াস।

এক দশক আগে রদ্রিগেজকে দেখেই ফুটবলে বড় স্বপ্ন বুনছিলেন দিয়াস। ঘটনাচক্রে সেই রদ্রিগেসের জায়গা পেলেও, কলম্বিয়ার আসল সম্রাট যে রদ্রিগেজই, সেটিই যেন মনে করিয়ে দেন ২৭ বছর বয়সী দিয়াস। পরে উরুগুয়ের বিপক্ষে সেমি-ফাইনাল জেতার পর সংবাদমাধ্যমেও সেটি স্পষ্টভাবে বলেন তিনি।

“জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তে আমি হামেসকে জানিয়েছি, তিনিই আমার আদর্শ। আমি তাকে সবসময় বলি, ‘আপনি দুর্দান্ত, আপনি প্রশংসনীয় এবং এসব আপনার প্রাপ্য।’ এই শিরোপা তার। আমরা তার সেরা ফুটবল দেখছি। আমরা জানি তাকে কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কতটা ভুগেছেন। ফুটবল এভাবেই চলে। ফুটবলই তাকে আরেকটি সুযোগ দিয়েছে।”

রদ্রিগেজ-দিয়াসরা মিলেই এখন প্রায় ৫ কোটি কলম্বিয়ানের স্বপ্ন বয়ে চলেছেন। ২০০১ সালে ঘরের মাঠে তারা প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বটে। তবে সেবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে খেলতে যায়নি আর্জেন্টিনা। আর শুধু অংশগ্রহণের খাতিরে দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েছিল ব্রাজিল।

তবে এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলকে ঠেকিয়ে দিয়েছে কলম্বিয়া। সেমি-ফাইনালে তারা হারিয়েছে উড়তে থাকা উরুগুয়েকে। আর দ্বিতীয় শিরোপার জন্য তাদের সামনে শেষ বাধা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা।

সেটি পার করে যেতে পারলে একসময় দলে জায়গা হারানো রদ্রিগেজই হবেন কলম্বিয়ার ফুটবলের অবিসংবাদিত সম্রাট। সেমি-ফাইনাল জয়ের পর আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে সেই শিরোপার আকুতিই জানান রদ্রিগেজ, ‘প্রায় ১৩ বছর ধরে আমি এটি চাইছি। আমরা খুশি।’ রদ্রিগেজদের মতোই খুশি পুরো কলম্বিয়া। অপেক্ষা শুধু শেষ পরীক্ষা উতরে যাওয়ার।

(এসএস/এএস/জুলাই ১৩, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

১৮ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test