E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বদলে যাচ্ছে মিরসরাই উপকূল

২০১৭ জুলাই ১৬ ১৩:৩১:১৮
বদলে যাচ্ছে মিরসরাই উপকূল

স্টাফ রিপোর্টার : বঙ্গোপসাগরের মিরসরাই উপকূলজুড়ে চলছে দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞ। দিন যত যাচ্ছে, ততই দৃশ্যমান হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বদলে যাবে এখানকার চেনা দৃশ্যপট। এলাকাটি হয়ে ওঠবে অচেনা এক উন্নত শহর। লিখেছেন : এনায়েত হোসেন মিঠু, মিরসরাই

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে মিরসরাই উপকূলীয় এলাকায় পরিকল্পিত শিল্পশহর গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। প্রথম ধাপে ৫৫০ একর জমিতে চলছে ভূমি উন্নয়ন, ওই এলাকায় যাওয়ার সড়ক নির্মাণ,

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে চারলেনবিশিষ্ট সংযোগ সড়ক নির্মাণ, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, সুপেয় পানির সরবরাহ, পর্যটন সম্ভাবনা তৈরি করতে পাঁচটি কৃত্রিম হ্রদ তৈরি, খাল সংস্কার ও বাঁধ নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ।

জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠেছে এসব জমি। এগুলো অনেক নিচু হওয়ায় ভূমি উঁচু করতে ফেলা হচ্ছে মাটি। ২২ কোটি ৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ওই মাটি ফেলার কাজ চলছে। ভবিষ্যতে যাতে পানির কারণে চর ডুবে না যায়, এর সুরক্ষার জন্য ইতিমধ্যে বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাঁধে থাকছে স্লুইস গেট এবং সেতু। এ জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২২ কোটি ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০১ টাকা। বিশ্ব ব্যাংক, ডিএফআইডি ও সরকারি অর্থায়নে এসব কাজ করছে মেসার্স আতাউর রহমান খান নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর সড়ক নির্মাণের কাজ করছে নিয়াজ ট্রেডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই কাজের জন্য সর্বমোট সাত মাস সময় বেঁধে দেওয়া হলেও মাটি ভরাট ও সড়ক উন্নয়নকাজ এখনো শেষ হয়নি।

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘৬.৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাঁধ সুরক্ষায় সিসি ব্লকও বসেছে। মঘাদিয়া স্লুইস গেট থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়কের কাজ ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। সড়কে দুটিতে সেতু রয়েছে। এগুলোর ৮০ ভাগ কাজ শেষ। পাঁচ তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবনের কাজও শুরু হয়েছে। এখন পাইলিং এর কাজ চলছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকায় ৫.১৬ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরির কাজ ৫০ ভাগ শেষ হয়েছে। সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য এখানে মোট পাঁচটি প্রোডাকশন টিউবওয়েল বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি তিনটি স্থাপনে প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ’

তবে ৫৫০ একর জমিতে মাটি ভরাটের কাজ পিছিয়ে রয়েছে স্বীকার করে বেজার এই প্রকৌশলী জানান, বিরূপ আবহাওয়ায় মাটি ভরাটের কাজ বন্ধ রাখতে হয়। যেহেতু সাগর থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালুমিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে সেহেতু সাগরের গতিপ্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হয়। এ পর্যন্ত মাটি ভরাটের কাজ ৫০ ভাগ শেষ হয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার চারলেন বিশিষ্ট সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ করছে সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। তারা সড়ক নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ শেষে প্রথম দফায় সড়ে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক এলাকায় ১৮টি কালভার্ট নির্মাণকাজ করছে। আলাদা দুটি প্যাকেজে ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। সড়ক নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা।

কাজের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে সওজ চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহম্মেদ বলেন, ‘প্রথম দফায় সড়কের ১৮টি কালভার্ট নির্মাণের টেন্ডার হয়েছে। এগুলোর কাজ দ্রুত চলছে। ইতোমধ্যে ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের শেষের নাগাদ কালভার্ট নির্মাণ শেষ হবে। আলাদা দুটি প্যাকেজে সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর ব্যয় ধরা হয়েছে যথাক্রমে ২৪ ও ২৫ কোটি টাকা। ’

এদিকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকাকে শুধু শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য সহায়ক হিসেবে নয়, এখানকার সাগরপাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন সম্ভাবনার দুয়ার খোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে বেজা কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে এখানে তৈরি করা হচ্ছে সুবিশাল আয়তনের পাঁচ পাঁচটি কৃত্রিম হ্রদ। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেখ হাসিনা সরোবর’।

বেজার সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌস ওয়াহিদ জানান, শিল্প কারখানার পাশাপাশি এখানে গড়ে তোলা হবে নয়নাভিরাম পর্যটনকেন্দ্র। সে লক্ষ্যে বিশালায়তনের পাঁচটি হ্রদ তৈরি করা হবে। এগুলোর কাজ এখনো শুরু হয়নি টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে।

এদিকে অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকায় সুপেয় পানির বন্দোবস্ত করতে কাজ করছে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তারা ওই এলাকায় মোট পাঁচটি উৎপাদন টিউবওয়েল স্থাপন করবে। এরই মধ্যে দুটি উৎপাদন টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ চলছে। ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে টিউবওয়েলগুলো স্থাপনের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচ এম কনস্ট্রাকশন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন দেওয়ান বলেন, ‘দুটি টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে পাম্প হাউস স্থাপনের কাজ। বাকি তিনটি স্থাপনের ব্যাপারে এখনো কোনো প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়নি। ’

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান (জ্যেষ্ঠ সচিব) পবন চৌধুরী বলেন, ‘এখানে কয়েকটি ধাপে ৩০ হাজার একর জমিতে প্রতিষ্ঠা পাবে ৫০টি বিশেষায়িত উপ-অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে বর্তমানে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নতুন অর্থ বছরে আরো ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ’

বেজা কর্মকর্তারা জানান, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেওয়ার পর থেকে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আগামী বছর নাগাদ তা বাস্তবে রূপ নেবে। দেশি উদ্যোক্তারাও এখানে শিল্পকারখানা স্থাপনে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক জোন করতে ১ হাজার ৫৪ একর জমি চেয়েছে। এছাড়া দেশটি এখানে একটি আইটি পার্ক করতে ৭২০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছে।

এখানে ১৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে চীন।

প্রথম ধাপের ৫৫০ একর জমির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ পেয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ। শিল্প প্রতিষ্ঠানটি যৌথভাবে পাওয়ারপ্যাক ও গ্যাসমিন লিমিটেডকে সঙ্গে নিয়ে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন করবে। গত ২১ মার্চ ঢাকার একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের হাতে লেটার অব অ্যাওয়ার্ড (এলওএ) তুলে দেন বেজা কর্মকর্তারা।

প্রতিবেদনের অপেক্ষায় বন্দ ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের মাঝামাঝি এলাকায় একটি বন্দর টার্মিনাল স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়। সেই আলোকে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি দল সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। আগামী বছরের এপ্রিল অথবা মে মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রিপোর্ট পাওয়া যেতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘বন্দর স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। আমরা এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে সবরকম সহযোগিতা দিব। ’

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গভর্নিং বোর্ডের সভায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ইছাখালী এলাকায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে এখানে মোট ৩০ হাজার একর জমির ওপর গড়ে ওঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। মোট ৫০টির মতো বিশেষায়িত অঞ্চল এখানে স্থাপিত হবে। বর্তমানে ৫৫০ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি উন্নয়ন ও অন্যান্য কাজ চলছে। ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু হওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির উন্নয়নকাজ উদ্বোধন করেন।

(ওএস/এসপি/জুলাই ১৬, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test