E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রেজিষ্ট্রেশন থাকা না থাকা : কিই বা আসে যায়?

২০২০ জুলাই ১৬ ২৩:০৯:২৯
রেজিষ্ট্রেশন থাকা না থাকা : কিই বা আসে যায়?

রণেশ মৈত্র


নতুন ও ভয়াবহ ভাইরাস হিসেবে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বহুমুখী দুর্বলতা জনসমক্ষে নয় শুধু গোটা দুনিয়ার সামনেই আতংকের বিষয় হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে। আজ বাংলাদেশের নাগরিকেরা গোটা পৃথিবীর কাছে নিজেদের মর্য্যাদা ও ভাবমূর্তি খুইয়ে বসেছি। বিচ্ছিন্ন হতে বসেছি সমগ্র পৃথিবী থেকেও।

ভাগ্যিস র‌্যাব রিজেন্ট হাসপাতালের সন্ধান পেয়ে তার দুটি শাখাকে সিলগালা করে দিয়ে জনাকয়েক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছিল। ঐ গ্রেফতারকৃতরা রিম্যা-ে জ্ঞিাসাবাদে আরও কত তথ্য জানাবে এই মুহুর্তে কল্পনা করা যাচ্ছে না। তবে প্রতারিত অসংখ্য করোনা রোগী তাদের অভিযোগ জানিয়ে দেশবাসীর দৃষ্টি রিজেন্ট হাসপাতালের অভাবনীয় কা-কারখানা এবং তার চেয়ারম্যান করিতকর্মা বহুরূপী সাহেদের প্রতি নিবদ্ধ করতে সহায়তা করেছে।

সাহেদ কী নন? স্বাস্থ্য ব্যবসায়ী, হাসপাতাল মালিক, টক-শোতে ঘন ঘন আমন্ত্রণ পাওয়া বুদ্ধিজীবী, বঙ্গভবন-গণভবনে অবাধে যাতায়াতের দুর্লভ সুযোগের অধিকারী, সরকারি দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সাব-কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য বিধায় সরকারের অপরিসীম বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব যাকে করোনা চিকিৎসার ডেডিকেটেড হাসপাতালে রিজেন্ট হাসপাতালকে পরিণত করতে দুই কোটি টাকা অগ্রিম অনুদান মঞ্জুর করা হলো বিনা পয়সায় করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষর, সকল সরকারি নেতা যথা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ছোট বড় সকল মন্ত্রীর সাথে ফটো তুলে রাখার দুর্লভ সুযোগ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, রিজেন্ট হাসপাতালে মক্ষীরানীদের সাথে অভিসার কক্ষ, টর্চার সেল কী নয়?

এই অসাধারণ যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিটিকে অবশেষে কোথায় কোন সূতোটি ছিড়ে যাওয়ায়, বিগত কয়েকদিন যাবত দেশবাসীর কাছে একজন প্রতারক, প্রতারণার অভিযোগে আসামী হিসেবে আজ দেখতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি গ্রেফতারও হয়েছেন। হয়তো বা এ সংকট থেকে তিনি শেষ পর্যন্ত উতরে যাবেন। কিছুদিনের জন্য রাজ আতিথ্যেও তাঁকে থাকতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও তিনি প্রথম শ্রেণীর কয়েদির মর্য্যাদা পাবেন এবং কারাগারের বাবাইরের হাসপাতালে দিব্যি আরামেও থাকবেন। অতীতের সকল অভিজ্ঞতা তো তাই বলে।

প্রশ্ন উঠেছে রিজেন্ট হাসপাতালের কোন রেজিষ্ট্রেশন নাকি ছিলো না। তা সত্বেও তার সাথে স্বাস্থ্য অধিদফতর আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করলো কিভাবে?

এ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে আমার মাথায় দুটি প্রশ্ন ঢুকেছে-যার জবাব এখনও কোন সূত্রে পাই নি। প্রশ্ন দুটি হলো:

এক. ঐ চুক্তি স্বাক্ষরকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা ছাড়াও খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবও উপস্থিত থেকে চুক্তি স্বাক্ষরের ছবি তুলেছেন। তা হলে রেজিষ্ট্রেশন বিহীন ঐ হাসপাতালের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে তার রেজিষ্ট্রেশন আছে কি না, ঐ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার উপযোগী কি না ঐ চিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জাম, আই.সি.ইউ, গ্যাস, উপযুক্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার-নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী আছে কি না এবং সর্বোপরি হাসপাতালটির মালিক সৎ ও যোগ্য কিনা এই প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছিলেন কি না? নাকি কোন খোঁজ খবর না নিয়েই অমন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন অসাধারণ “সরল বিশ্বাসে”?

দুই. রেজিষ্ট্রেশন বিহীন হাসপাতালের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত কে কে মিলে নিয়েছিলেন? যিনি স্বাক্ষর করলেন, যাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ঐ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে (যদি তা বে-আইনী ও রীতি-প্রথা-বিরোধী হয়ে থাকে) উপস্থিত থেকে ছবিতে স্থান পাওয়া স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও অন্যদের সাথে সম-অপরাধে অপরাধী বলে বিবেচিত কেন হবেন না-কেনই বা তাঁকে অবিলম্বে মন্ত্রীত্ব পদ থেকে অপসারণ করে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার কারণে এবং দুর্নীতিবাজের সাথে চুক্তি করায় ঐ কাজেও সাহেদের সহযোগিতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে কেন ফৌজদারী আইনের উপযুক্ত ধারায় তাঁদের সবার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে না? আমারা যেন মুহুর্তের জন্যেও ভুলে না যাই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ওঁরা কেউই একক বা যৌথভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।

এখন পুলিশ-র‌্যাব খুঁজে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের হাসপাতাল ক্লিনিকগুলির মধ্যে কোনটা কোনটার বৈধ রেজিষ্ট্রেশন আছে। কাজটা অবশ্যই ভাল। কিন্তু তদন্তকারীরা পেরে উঠবেন কি সকল রেজিষ্ট্রেশন বিহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিককে চিহ্নিত করতে? বেসরকারি হাসপাতলগুলির এবং ক্লিনিকগুলির অধিকাংশেরই মালিক কিন‘ কেউ কেটা। দুনিয়ার বে-আইনী কাজ করলেও তাদের গায়ে হাত দেওয়া অত্যন্ত দুরুহ। তাঁরা সদর্পে সমাজে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ বা এম.পি. মন্ত্রীপদেও অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। তাই তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার আশংকা প্রচুর।

এক্ষেত্রে অবাধে সুষ্ঠু তদন্ত যেমন আকাংখিত-তেমনই আবার যেগুলির রেজিষ্ট্রেশন নেই-সেগুলির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যেন দ্বিধাহীনভাবে নেওয়া হয়। তদন্তশেষে মিডিয়াতে প্রকাশ করা হোক কোথাকার কোন কোন হাসপাতালের বা ক্লিনিকের রেজিষ্ট্রেশন নেই। তাদের ও সেগুলির মালিকের নাম প্রকাশ করা হোক। কারণ ভোগান্তির শিকার তো হন সাধারণ মানুষ ও রোগাক্রান্ত মানুষেরা। তাই তাঁদেরকে স্বচ্ছতার সাথে বিষয়গুলি জানানো অপরিহার্য্য।
তদুপরি প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রবেশমুখে তাদের মালিকের নাম, রেজিষ্ট্রেশনের নম্বর ও তারিখ যেন স্পষ্টাক্ষরে লিখে খোদাই করে দেওয়া হয়। সঙ্গে মালিকের টেলিফোন নং টাও। রেজিষ্টার্ড হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীরা আইনত: কি কি সুবিধা পাবেন-তা-ও।

রেজিষ্টার্ড হাসপাতাল প্রসঙ্গ

বিস্তর হৈ চৈ চলছে হাসপাতাল-ক্লিনিকের রেজিষ্ট্রেশনের ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু রেজিষ্ট্রেশনের শর্তাবলী কি তা-ও মানুষের জানা প্রয়োজন।

রেজিষ্টার্ড সকল হাসপাতালেই কি বেড সংখ্যার অনুপাতে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্ন কর্মী আছেন? জানি, অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই। সরকারি কোন হাসপাতালেই নিয়ম বিধি থাকা সত্বেও প্রেসক্রিপশন মোতাবেক বিনামূল্যে কোন ওষুধই কোন রোগীকে কেন সরবরাহ করা হয় না-সরকারিভাবে তারও তদন্ত করা হোক এবং যদি প্রয়োজনানুযায়ী ওষুদ কেন্দ্র থেকে সকল হাসপাতালে সরবরাহ করা না হয়-তার সুনির্দিষ্ট কারণগুলিও খতিয়ে দেখা হোক।

বস্তুত: স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি যেন সর্বগ্রাসী এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রোগী এবং তাঁদের অভিভাবকেরা। শুনা যায়, নিয়োগ বাণিজ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে ব্যাপক। কিন্তু কোনদিনই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজেরা চিহ্নিত হয় নি-কেউই শাস্তির আওতায়ও আসেন নি। তদুপরি আমলারা আইন এমনভাবে করিয়ে নিয়েছেন যে তাদের কারও গায়ে সামান্যতম হাত আজ পর্য্যন্ত কেউ তুলতে পারেন নি। অকস্মাৎ যদি কারও শাস্তি হয়ও তা বড় জোর এক দফতর থেকে অপর দফতরে-কখনও বা সম-মর্য্যাদার পদে আবার কখনও বা উচ্চতর মর্য্যাদায়। কারও কোন জবাবদিহিতাও নেই।

পরিস্থিতি এমনই যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগী মারা গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঐ রোগীর কাছে পাওনা বাবদ এক বা একাধিক লক্ষ টাকার বিল তার অভিভাবকের হাতে গছিয়ে দেন এবং ঐ টাকা পরিশোধ না করা পর্য্যন্ত রোগীর মরদেহ সৎকারের জন্য লাশ ঘর থেকে বের করে হস্তান্তর প্রক্রিয়া আটকে রাখা হয়। এমন বেশ কিছু মর্মান্তিক ও অমানবিক ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

শাস্তির ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গেল, ডা. সাবরিনার ক্ষেত্রে। তাঁকে সরাসরি গ্রেফতার করা হলো ও পরক্ষণেই সাময়িকভাবে পদচ্যুতির আদেশও দেওয়া হলো। হঠাৎই এমন একটা ঘটনা একজন সরকারি চিকিৎসকের ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়ায় অনেকেই বিস্মিত। তবে কি সরকারি চাকুরীর বাবদে প্রাপ্য ইমিউনিটির আওতায় তিনি পড়েন না? আমার এই কথার অর্থ এ নয় যে আমি ডা: সাবরিনার পক্ষে ওকালতি করতে কলম ধরেছি। কোন সরকারি উচ্চপদস্থ চাকুরিয়াকে সহসা এ জাতীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে বড় একটা দেখি নি-তাই এমন সংশয়।

এবারে আসি করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে। এ ব্যাপারে আজ আমরা গোটা বিশ্বের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। দেড় শতাধিক বাংলাদেশী ইতালি গিয়ে সেখানকার পরীক্ষায় অনেকেরই করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে রোম বিমানবন্দরে। ফলে সেখান থেকে তাদের সবাইকে ওই ফ্লাইটেই ঢাকা ফেরত পাঠানো হয় অথচ তাঁরা সবাই বাংলাদেশ থেকে করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই না, বেশ কিছু দিনের জন্য বাংলাদেশী নাগরিকদের ইাতলী সহ বিদেশে যাওয়ার সুযোগও একই কারণে বন্ধ হয়েছে বা হতে চলেছে। বিদেশী পর্য্যটকরাও বাংলাদেশে পর্য্যটন সফরে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে তাই না-এর ফলে বাংলাদেশ বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনও হয়েছে।

কেন? এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? দায়ী নিশ্চয়ই সাহেদ-ডা: সাবরিনা এবং অনুরূপ হাজারো অপরাধীরা যারা করোনার মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামালেন এবং যারা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ঐ দুনীতিবাজদের সাথে বৈধ/অবৈধভাবে সহযোগিতা করলেন।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test