E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কৈশরের স্মৃতিকথা

২০২০ নভেম্বর ০১ ১৮:০৬:১৪
কৈশরের স্মৃতিকথা

রণেশ মৈত্র


এই তো সেদিন অষ্টাশিতে পা রাখলাম। বাল্যকালটা তো কবেই হারিয়ে গেছে। এখন মাঝেমধ্যে অতীতের নানা স্মৃতিকথা স্মরণে আসে। তারই খন্ডাংশ আজ পরিবেশন করি। বলা চলে কৈশোরেই সাংবাদিকতা শুরু করি। রাজনীতি, রানৈতিক দল প্রভৃতি তখনও তেমন একটা মানুষের কাছে, সমাজের কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে নি। যুগটাও অন্ধকার যুগ-গণতন্ত্রের জন্যে, মন খুলে কথা বলার জন্যে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালানোর জন্যে। সমাজের এই দুরবস্থা, মানুষের জীবনের অভাব অনটন, বিদ্যমান বৈষম্য-এ কথাগুলি তখন সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পেতনা। অথচ কিছুকিছু তরুণ ছাত্র যুবক দেশের মানুষ ও সমাজের এই সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবতেন-সাধ্যমত কাজ করতেন। অনেক ঝুঁকি নিয়েই তা করতেন।

পাবনাতে তখন একদল তরুণ ‘শিখা সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলে। আমিও একজন তাদেরই মধ্যে যারা তখন পাবনা শহরে এই কাজগুলি করছিলাম-শিখা সংঘ নামে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম।
কিন্তু দেখা গেল আমার চোখে ধরা পড়লো যে, এই কাজগুলি সমাজের মানুষের নিত্যদিনের সমস্যাবলী ও আন্দোলনের রিপোর্টগুলি পত্রিকার পাতায় আদৌ গুরুত্ব পাচ্ছে না। তখন আমি পরীক্ষামূলকভাবে নানা পত্রিকায় এই জাতীয় খবর পাঠাতে থাকি। বিশেষত: শিখা সংঘের, পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী এবং শহরের অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্য্যকলাপ, ছাত্রদের আন্দোলন এগুলি ররিপোর্ট পাঠাতে শুরু করি।

দেখা গেল বিশেষত: কলিকাতায় দৈনিক ‘সত্যযুগে’ এবং সিলেটের প্রাকলাল সপ্তাহিক নওবেলালে তা বেশ ছাপাহচ্ছিল। উৎসাহ তাতে বেড়ে যায়। প্রথম নিয়োগপত্র পাই ‘নওবেলাল’ থেকে। এরপর একই ধরণের খবর পাঠাতাম পাকিস্তান অবজার্ভারেও। ১৯৫৪ সালের মে মাসে অবজার্ভারের প্রথম নিয়োগপত্র পাই। কিন্তু যে দিন নিয়োগপত্রটি ডাকযোগে পেলাম সেদিনই ৯২(ক) ধারার জারী হয় এবং একই দিনে গ্রেফতার হই জননিরাপত্তা আইনে। তবে নিয়োগপত্র পাবার আগেও আমি বেশ কয়েক মাস খবর পাঠিয়েছি অবজার্ভারে-যা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে নিয়মিতই ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।

কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে প্রায় একই সময় আমি দৈনিক সংবাদ এবংইউ.পি.পি. (United press of Pakistan) এর নিয়োগপত্র পাই। তখন খন্ডিত যুক্তফ্রন্টের সরকার। আবু হোসেন সরকার মুখ্যমন্ত্রী। বৃহত্তর পাবনা জেলার মুসলিম লীগ দলীয় একমাত্র প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল মতিন (চোরা মতিন বলে পরিচিত) তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী। খবর পেলাম তাঁর একটি সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগের। খবরটি ইউ.পি.পি তে পাঠালাম। খুব দ্রুতই তা কিছু পত্রিকায় ছাপা হলো। খবরটি ছিল সত্য। তা সত্বেও পরদিনই পত্রিকায় ঐ খবরের প্রতিবাদ ছাপা হলো-সে খবরটিও পরিবেশন করে ইউ.পি.পি। সংবাদটির মূল প্রেরককে না জানিয়ে-তাঁর কাছ থেকে কোন ব্যাখ্যা বা প্রমাণ পত্র না চেয়ে ইইউ.পি.পি. ঐ পার্লামেন্টারী সেক্রেটারীর মিথ্যা প্রতিবাদ লিপি সংবাদপত্র সমূহে পরিবেশন করেন এবং তা যথারীতি ছাপাও হয়।

যদিও ইউ.পি.পি.ই তাঁকে মাসিক কিছু সম্মানী দিতেন, তা সত্বেও ইউ.পি.পি’র অমন আচরণ তাঁর কাছে একজন সাংবাদিকের মর্য্যাদাহানির কবলে মনে হয় এবং পরদিনই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। পরে ইউ.পি.পি. কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানান, চাপের মুখে এমন কাজ করতে হয়েছে এবং তাঁরা দুঃখিত এবং অনুরোধ করেন বারবার যাতে আমি তাঁর কাজ পুনরায় শুরু করি। এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি সাংবাদিকের সম্মান অক্ষুন্ন রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে।

১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিলে পাবনায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেল। সন্ধ্যায় শুরু, চললো রাত তিনটে অবধি। পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায়। সারাটি শহর সারারাত ধরে দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। ৩০/৩২ জন হিন্দু (একজন আইনজীবী পাবনা জজ কোর্টের এবংজি.সি. ইনস্টিটিউশনের একজন শিক্ষকসহ) নিহত হন-অনেকে আহত। বাড়ী পুড়েছে শহরে শতাধিক। গুন্ডারা ট্রাকে করে প্রকাশ্যে ঘুরেছে আর এই তান্ডব চালিয়েছে। সে দিন আইউবের মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

স্বভাবত:ই আমরা সাংবাদিকেরা নির্বাচনের খবর সংগ্রহে ব্যস্ত। ভাসানী ন্যাপ নেতা অমলেন্দ দাক্ষীর বাসা এবং ডিসপেন্সারীটি সাংবাদিক রাজনৈতিক কর্মীদের আড্ডাস্থল। ঐ মুহুর্তে কয়েকজ নসাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মীসহ আমিও ওখানে উপস্থিত। স্থানটি খুব নিরাপদ কারণ বিশেষ-protected. হঠাৎ ন্যাপ নেতা মীজানুর রহমান দাঙ্গা শুরুর খবর পেয়ে ছুটে এলেন খবরটি দিতে। আমার বাসা তখন অত্যন্ত বিপজ্জনক এলাকায়। ওখানে সবাই স্থির করলেন আমার পরিবারটিকে দাক্ষীর বাসায় জরুরী ভিত্তিতে shift করে আনা হোক। মীজানুর রহমান, সাংবাদিক আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক ইদরিস আলী (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক) আরও কয়েকজন ছুটলেন আমার পরিবারটিকে আনতে। সঙ্গে আমাকেও নিলেন তাঁরা। স্ত্রী ও দুই শিশু পুত্রকে নিয়ে আসা হলো। থাকতেও হলো ঐ বাসায় ক’দিন।

পরদিন প্রেসটেলি গ্রামে খবরটি পাঠালাম ‘সংবাদ’ ও ‘মর্নিং নিউজে’। ছাপা হলো না। জানা গেল, প্রেস টেলিগ্রামটি যায়নি। DSB গভর্নর জেনারেল আজম খান বিদায়ী সফরে হেলিকপ্টার যোগে দাঙ্গা বিধ্বস্ত পাবনা সফরে এলেন। শহরটি ঘুরলেন। পরিবারগুলিকে সান্তনা দিলেন। দুস্কৃতিকারীদের কঠোর শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন সার্কিট হাউসে এক সুধী সমাবেশে। গভর্নরের বক্তৃতা (সফরের কাহিনী সমেত) আবার প্রেসটেলিগ্রাম করলাম। এবারও ছাপাহলো না কোন কাগজে। কারণ একই DSB যেতে দেয় নি।

পরদিন বারবার পুলিশের একজন সিনিয়র দারোগা এসে দাক্ষীর বাসায় আমার খোঁজ করতে থাকেন আমি তখন বাইরে খবর সংগ্রহে ব্যস্ত। অবশেষে দেখা না পেয়ে দারোসাডা: দাক্ষীকে বিশেষভাবে বলে গেলেন-রণেশ বাবু এলেই যেন থানায় আসেন। এস.পি. সাহেব বিশেষভাবে ডেকেছেন। বন্ধু সাংবাদিক আনোয়ারুল হকসহ ডা: দাক্ষীর অনুরোধে তিনি থানায় গেলেন। দেখি থানার সামনের লাইনে বিস্তর চেয়ার পাতা। অনেক পুলিশ ও ডি.এসবি. অফিসার বসা। সাদরে দু’জনকে বসতে দেওয়া হলো। কিন্তু এস.পি. সাহেব কৈ?

প্রশ্ন করতেই ডি.আই.ও ওয়ান বললেন, উনি জরুরী কাজে আটকে গেছেন এবং তাঁকেই দায়িত্ব দিয়েছেন আলাপের। বিনয়ের সাথে বললেন ভারতের ‘আনন্দবাজারে’ পাবনার দাঙ্গা সম্পর্কে বহু মিথ্যা খবর বেরিয়েছে এবং সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের “জং” পত্রিকায় পুন:মুদ্রিত হয়েছে। এস.পি. সাহেবের অনুরোধ এর প্রতিবাদে হিন্দু নেতৃবৃন্দের বিবৃতি নেওয়া হবে, তাতে আপনাকেও সাংবাদিক হিসেবে স্বাক্ষর করে পত্রিকায় পাঠাতে হবে। স্পষ্ট জবাব দিলাম, ঐ দুটি পত্রিকাতো পাবনাতে আসেনা। তাই না পড়ে কিভাবে বলা যাবে যে অতিরঞ্জিত খবর বেরিয়েছে। তাই এ কাজ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত: আরও বললেন, যা প্রকৃত ঘটেছে সে খবর যেতে দেওয়া হয়নি পত্রিকায় বে-আইনীভাবে। যদি যেতে দেওয়া হতো-সত্য খবর যদি ছাপা হতো তবে অতিরঞ্জনের সুযোগ থাকতো না। সুতরাং বিলম্ব যদিও হয়েছে তবুও সত্য যা যা ঘটেছে হয় সেই খবর স্থানীয় সকল সাংবাদিক মিলে সব কাগজে পাঠাই সরকার যেন তা প্রকাশে বাধা না দেয়। এটাই হবে একমাত্র পথ যাতে বাইরে সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। দৃঢ়ভাবে এই কথা বলায় এবং এর কোন নড়চড় করতে কোন ক্রমে রাজী না হওয়ায় আইউবী সাম্প্রদায়িক প্রশাসনের ঐ অপচেষ্টা ভঙ্গুল হয়ে গেল। আমার সাংবাদিক জীবনে এ এক উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা।

আরও কদিনপরে ঐ দাঙ্গার কথা উল্লেখ না করে কদিন ধরে পাবনার জনজীবনের বিপর্য্যস্ত অবস্থার বর্ণনা সম্বলিত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন লিখে পাবনার বাইরে এক ডাকঘরে Post করে ‘সংবাদে’ পাঠাই। বিশেষ আগ্রহসহকারে সংবাদের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক তোয়াব খান ঐ প্রতিবেদনটি ‘সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করলে তা সারাদেশে চাঞ্জল্যের সৃস্টি করে। পরে অভিনন্দন বার্তা পেলাম ‘সংবাদ’সম্পাদকের কাছ থেকে।

লেখক : সভাপতিম-লীরসদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test