E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ক্রিকেটার শাকিব, অতঃপর

২০২০ ডিসেম্বর ০৬ ১৪:৪১:২৭
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ক্রিকেটার শাকিব, অতঃপর

রণেশ মৈত্র


শিরোনামটির শেষে লিখেছি “অতঃপর”। অর্থাৎ শেষ কোথায়? অত:পরকে ইচ্ছে করেই প্রশ্নবোধক চিহ্নের বৃত্তে আনি নি। কারণ আমি তো ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না-যেহেতু আমি সর্বজ্ঞ বা সর্বজান্তা বা দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন কোন মানুষ নই। দেশকে ভালবাসি। ব্যস্। এটুকুই আমার পরিচয়। এ পরিচয়ে আমি গর্বিতও বটে।

তবু কিছু অনুমান তো করতেই হবে। আমার দৃঢ় এবং আশাবাদী অনুমান হলো-অত:পর ৬৯ এর চাইতেও বড় ধলনের এক মহা গণ-অভ্যূত্থান। কারা ডাক দেবেন ঐ গণ-অভ্যূত্থানের? কার আহ্বানের অপেক্ষায় ঐ অভ্যূত্থানের?কারও আহ্বানের অপেক্ষায় ঐ অভ্যূত্থানের নায়ক-নায়িকারা বসে থাকবেন না। কখন হবে গণ-অভ্যূত্থান? না এই প্রশ্নেরও পূর্ণাঙ্গ উত্তর এই মুহুর্তে আমার কাছে নেই। তবে যা বলতে পারি এবং যা অবশ্যসম্ভাবী তা হলো বাংলাদেশের ঘুমন্ত যুব সমাজ।

তারা জেগে ওঠা মাত্রই দেশে ঘটবে বিষ্ফোরণ। যুব সমাজই ভাষা আন্দোলন করেছে-তার আগে তারাই ইংরেজ তাড়িয়েছে, তারাই বিভ্রান্তির কবলে পড়ে পাকিস্তান এনেছিল-তারাই আবার ততোধিক শক্তি নিয়ে জেল-জুলুম, হাজারো নির্য্যাতন সহ্য করে ঐ পাকিস্তানকে “গুড বাই” জানিয়েছে-তারাই অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করে, তার আগে ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান শ্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের ভাঙালি বিরোধী, মৌলিক অধিকার বিরোধী, নারী নির্য্যাতন বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা ও অথর্ধনৈতিকসহ তাবৎ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান সৃষ্টি করেছে, ত্রিশ লক্ষ বাঙালির প্রাণের ও কয়েক লক্ষ বাঙালী নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে নয় মাসব্যাপী ইতিহাস সৃষ্টিকারী সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে পরিচালিত করেছে। আবার স্বাধীনতার পর আজ অর্ধ-শতাব্দী সুফল থেকে। তাই গণ বিষ্ফোরণ, গণ-অভ্যূত্থান অপরিহার্য্য।

নেতৃত্ব কে দেবে, দেশ নেতৃত্বহীন এসব কথা তোলাটা অর্থহীন। কারণ কেউ মাতৃগর্ভ থেকে নেতা হয়ে বের হন না-কাজের ভিত্তিতেই কোন এক বা একাধিক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। জনগণের স্বার্থে নিরন্তর, নিঃস্বার্থ ও সাহসিকতার সাথে জনগণকে সংগঠিত করে লড়াই সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমেই নেতা হয়ে গড়ে ওঠেন। সেভাবেই গড়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসনী, কমরেড মনি সিং এবং ছোট খাট হলেও আমরা আরও হাজারে হাজারে নিজ নিজ অঞ্চল ও এলাকায় নেতা হিসেবে স্থানীয় নেতা হিসেবে জনগণের শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলাম। তাই নেতার সৃষ্টিও অবশ্যই হবে।

আজ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তার আদর্শ, তার ইতিহাস ও তার মর্য্যাদা রক্ষা করবেন বা যাঁদের উপর সেই মহান দায়িত্ব বর্তেছে তাঁদের একটি অংশ ইতোমধ্যেই গর্জে উঠতে সুরু করেছে। ঢাকার সাহবাগ হয়ে উঠেছে আমাদের যুগের পল্টন ময়দান। তাঁরা সেখানে সমবেত হয়ে তাঁদের দাবী যা আজ নতুন করে সামনে এসেছে তা হলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য নির্মাণ নিয়ে ইসলামী ঐক্য জোট বা ইসলামী মৌলবাদীদের হুঁশিয়ারী। এদের স্পর্ধা বিনা চ্যালেঞ্জে যাচ্ছে না-যেতে দেওয়া হবেও না।

তবে ওরা সাহস পেয়েছে সরকারের কতিপয় কাজের ফলে। যেমন, ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ রাতে দেশের সর্বোচ্চ বিচার প্রাঙ্গন সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামীর প্রয়াত আমীর ‘তেঁতুল হুজুর’ নামে খ্যাত মৌলবাদীদের দাবী মেনে নিয়ে ‘লেডি জাষ্টিস’ ভাস্কর্য্যটি লোকচক্ষুর অন্তরালে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।

২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে রাজধানীর বলাকা ভবনের সামনের রাস্তায় ‘বলাকা’ ভাস্কর্য্যে হামলা চালায় ওলামা আঞ্জুমানের আল বাইয়াত নামের উগ্রবাদী সংগঠনের নেতা কর্মীরা। একই বছর শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের গোল চত্বরে ‘বাউল’ ভাস্কর্য্যে হামলা চালায় মৌলবাদী গোষ্ঠী।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ করে হেফাজতে ইসলাম দেশ থেকে সকল ভাস্কর্য্য ভেঙ্গে ফেলার আলটিমেটাম দিয়েছিল সরকারকে। তারা ঔ সমাবেশে সরকারের প্রগতিমুখীন নারীনীতি, শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীও তুলেছিল। তাদের ঘোষিত ১৩ দফা কর্মসূচীতে নারীকে পঞ্চম শ্রেণীর বেশী স্কুলে না পড়িয়ে বাড়ীতে ২৪ ঘন্টা আটকে রেখে নারী প্রগতির বিরোধিতাই শুধু নয়-নারীর প্রতি চরম অমর্য্যাদাও প্রদর্শন করেছিল। সর্বোপরি তাদের দাবীকৃত ১৩ দফা না মানলে সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকীও দিয়ে চলেছিল। প্রচলিত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে অমুসলিম খ্যাতনামা সাহিত্যিক, কবিদের লেখা প্রত্যাহার করে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লেখকদের রচনা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণের দাবী তুলে তা কার্য্যকর করিয়ে নিতেও সক্ষম হয়েছিল।

না। তারা থামে নি।

প্রশ্রয় পেতে পেতে তারা মাথায় উঠেছে। আজ ধরাকে সরা জ্ঞান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না তারা।
বাংলাদেশের নানা জায়গায় ফ্রান্সের কার্টুন ঘটনা নিয়ে আক্ষরিক তা-ব শুরু করেছে তারা। কুমিল্লার একটি গ্রামের ৩০০ এরও অধিক হিন্দু পরিবারের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুটপাট করেছে, মহিলারা হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলে, সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলে মুসলিম পরিচয় দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। আরও অনেক জায়গায়এমনটি ঘটেছে বলে জানা যায়।

সাকিব হত্যার হুমকি

সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা, বাংলাদেশের গর্ব, বাঙালির অহংকার। মৌলবাদীরা হুংকার দিয়ে ভিডিও কলের মাধ্যমে তরবারী উঁচিয়ে সাকিবকে হত্যা করার হুমকি দেয়। স্পর্ধাও বটে। সরকার ঐ হুমকি দাতাকে গ্রেফতার করেছে-প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে। জানামতে, ঐ অভিযুক্ত হুমকিদাতাকে ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধ করলেও ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের তার বিরুদ্ধে কোন মামলা করা হয় নি। এ ছাড়াও ঐ ভিডিও হুমকি দানকালে সে তার নির্দেশ দাতা দুইজনের নামও নাকি বলেছে কিন্তু তাদের কাউকে গ্রেফতারের খবর আজও পাওয়া যায় নি।

অপরদিকে সাকিবের অপরাধ কি? কলকাতায় এক কালী পূজায় আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যোগদান। এতে নাকি ‘ইসলামের অবমাননা’ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে নাকি আঘাত হানা হয়েছে। ইসলামকে এভাবে হাস্যকর, ঠুনকো একটি ধর্ম হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা বোধ করছে না ঐ ঘুনী জঙ্গীগোষ্ঠি।
সাকিব ভয় পেলেন! তাঁর জীবন অক্ষত থাকবে কি না-তিনি এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে দেবে কি না এই সংশয়বোধ থেকে তড়িঘড়ী করে ভিডিও কল করে যাঁরাই তাঁর কালী পূজায় যাওয়াতে মনোকষ্ট পেয়েছেন, যারা এটাকে ইসলাম ধর্মের অবমাননা বলে মনে করছেন-তাদের সবার কাছে অকুণ্ঠ চিত্তে ‘ক্ষমতা’ চেয়েছেন। আমি মনে করি এই ক্ষমা চাওয়া এক ধরণের কাপুরুষতা। তাঁর উচিত ছিলো নিজের কাজকে সমর্থন করে ঐ হুমকি দাতাকে পাল্টা আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করা। সরকারের কাছে ঐ হুমকি দাতা ও তাকে মদদদাতাদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করার দাবী জানান। তা না করায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে যে অপমানিত করা হলো-সাকিব আল হাসানের চেতনায় সে বোধের কি একটুও উদয় হলো না?

ঐ জঙ্গীরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে নি করেছে পাকিস্তানের দালালি। শেষ পর্য্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে অবশ্যই তাদের ঠাঁই হবে।

সাকিব কি ভেবে দেখেছেন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভারতের অধিবাসী। কালীপূজায় নিমন্ত্রণ জানিয়ে পূজার আয়োজকেরা ভিন্নধর্মী সাকিবকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে যে ধর্মীয় উদারতার প্রসংশনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, হুমকিদাতা বর্বর জঙ্গীদের কাছে ও ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে ভারতের তথা সারা বিশ্বের হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের মনে যে আঘাত করলেন তাঁদের ধর্মের প্রতি পরোক্ষে যে অবমাননা জ্ঞাপন করলেন-তাতে বাংলাদেশের যতটুকুও বা ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ছিল-তার প্রতিও অবমাননা করা হলো?

তাহলে ঐ হিন্দুরা যদি দাবী করে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করায় সাকিবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেফতার করা হোক, নিতান্ত অনাকাংখিত হলেও যদি তেমন দাবী হিন্দুদের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হতো-তা কি খুব একটা অন্যায় হতো?

তবে সে ক্ষেত্রে সকল শক্তি দিয়ে আমি ও দেশ-বিদেশের সকল অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি প্রতিবাদ জানিয়ে বলতাম-এমন দাবী একটি সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসূত দাবী-তাই পরিত্যজ্য।সাকিবের অনুধাবন করা উচিত ছিলো ঐ হুমকীদাতারা কারা?তারা কি আদৌ বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণকামী? তারা কল্যাণের শক্তি, নাকি অকল্যাণের শক্তি। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যদি সামান্যও ভাবতেন-তবে অবশ্যই বুঝতেন-তাঁর এই ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বহু লোককে অনুরূপ হুমকিদিতে বা এমন কি প্রাণ সংহার করতেও উৎসাহিত বোধ করবে।

সাকিব, বাংলাদেশের খেলোয়াড় সম্প্রদায়গুলি-যাঁরা ১৯৭১ এ নানাস্থানে খেলার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে মুজিবনগর সরকারের কাছে তা পৌঁছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিপুল সহযোগিতা দিয়েছেন-তাঁদের চেতনাবোধে সমৃদ্ধ হয়ে আসুন, ঐ অপশক্তিগুলির বিরুদ্ধে দেশ জোড়া শক্তিশালী গণ আন্দোলন গড়ে তুলি, দেশের গণ-আন্দোলনের মূলস্রোতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ঐ ধর্মীয় অপশক্তিগুলির কাছে সরকারের নতি স্বীকারের বিরোধিতা করি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করতে চাইবে-এটা তো স্বাভাবিক।কিন্তু আমরা? সরকার? সবাই কি চোখ বুঁজে থাকবো? সরকার আজও হুমকিদাতাদের আজও গ্রেফতার না করে, বে-আইনী ঘোষণা করে পরোক্ষে পুনরায় তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। একে রুখতেই হবে-আন্দোলন সংগাম-সমাবেশের মাধ্যমে।

দাবী করি:

এক. যারা হেফাজতে ইসলামের দাবী মেনে জাষ্টিসিয়া বা লেডি জাষ্টিস নামক ভাস্কর্য্য সরানোর দাবী তুলেছিল-যারা ওলামা আঞ্জুমান আল বাইয়াত নামক জঙ্গী সংগঠন ‘বলাকা’ ভাস্কর্য্যে হামলা চালিয়েছিল, যারা ঢাকা বিমানবন্দরের সম্মুখের গোলচত্বরে দৃষ্টি নন্দন ‘বাউল ভাস্কর্য্য’ হামলা চালিয়েছিল, যারা এখন ফ্রান্সের ইস্যু বাংলাদেশে টেনে এনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালাচ্ছে বা চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য নির্মানের বিরোধিত তাদেরকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং গ্রেফতারের মাধ্যমে ঐ অপশক্তির বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি।

লেখক : সভাপতি ম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test