E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড: ফজলে রাব্বী

২০২০ ডিসেম্বর ১৩ ১৪:৪৯:৪৩
শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড: ফজলে রাব্বী

রণেশ মৈত্র


সারাটি বছরই তো শহীদ হওয়ার বছর ১৯৭১ সালে। বিশেষ করে ২৫ মার্চের রাত্রি থেকে। সমাপ্তি ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে এসে। বলা চলে আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর নতুন সরকার গুছিয়ে ওঠা এবং মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরে সংগঠিত হওয়ার পূর্ব পর্য্যন্ত অন্তবর্তীকালীন সময়ে আরও বেশ কিছু শহীদ হয়েছেন। মোট শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ যা তৎকালীন সময়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশটিতে এক বিশাল জনসংখ্যা।এর মধ্যে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কতজন তা জাতীয়ভাবে আজও নির্ধারিত হয় নি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে থাকি প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বরে - তাই প্রতিবছরই ঐ দিনটিতে সংবাদপত্রগুলিতে নামগুলি প্রকাশিত হলে পরবর্তী প্রজন্মেও ছেলে-মেয়েরা তা জানতে পারবেন। প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে তার। তাই আশা কর্রি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল একটু পরিশ্রম করে সামনের বছরটিতে এই কাজটুকু করবেন। ঐ মন্ত্রাণালয় এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপর আমার আস্থা বড়ই কম-তবুও তাঁরা এই দায়িত্বটুকু পালন করলে তাঁদের প্রতি আস্থার , সামান্য হলেও, কিছুটা জায়গার সৃষ্টি হতো।

প্রতি বছর ১৪ ডিস্মেবরে - শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে অবশ্য আমাদের সংবাদপত্রগুলি জনাকয়েক শীর্ষ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করে থাকেন। দেশজুড়ে প্রতি বছরই দিবসটি পালনের লক্ষ্যে যে আলোচনা সভার আয়োজন হয়- তাতে সাধারণত:ঐ নামগুলিই উল্লেখ করা হয়-এর সাথে জেলাগুলিতে নিজ নিজ জেলার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম ও অবদানও স্মরণ করা হয়।

এই নিবন্ধের শিরোনামে দু’জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম উল্লেখ করেছি। আজ তাঁদেরকে নিয়েই, খন্ডিত হলেও, লিখব বলে স্থির করেছি। এতে অবশ্য একথা মনে করার কারণ নেই যে অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীকে আমি অবহেলা করলাম বা তাঁদের প্রতি আমার অশ্রদ্ধা প্রকাশ করলাম। প্রতি বছর আমি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখে থাকি কিন্তু এবার যুক্ত করলাম পাবনার সন্তান খ্যাতনামা চিকিৎসক ডা: ফজলে রাব্বীর নামটাও যা এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করবো। পরের অংশে লিখবো অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সম্পর্কে।

পাবনা শহরের অদূরে একটি নিভৃত গ্রামে ডা: ফজলো রাব্বীর পৈত্রিক ভিটা আজও আছে-সম্পূর্ণ অরক্ষিত এবং অযতেœ-অবহেলায় পড়ে আছে। তাঁর পরিবারের কেউই সেখানে থাকেন না ডা: রাব্বীর আমল থেকেই। তাই গুটি কয়েক বাদে বাদ-বাকী পাবনাবাসীও তাঁকে যেন ভুলতে বসেছে। তাঁর নামে একটি ফাউন্ডেশন আছে-ঢাকায়। একবার তাঁদের সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ হয়েছিল-অনেকদিন আগে। প্রথমত: পাবনার উৎসাহীদের সমন্বয়ে ঐ ফাউন্ডেশন পুণর্গঠিত করে হেড অফিসটা পাবনাতে স্থানান্তরিত করে সবাই মিলে ডা: রাব্বীকে স্মরনীয় করে রাখার ব্যাপারে কি কি করা সম্ভব তা আলাচনা করে স্থির করা হোক-এমন প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তাঁরা বেশ মনোযোগ দিয়েই কথাগুলি শুনেছিলেন বলে মনে হয়েছিল কিন্তু হ্যাঁ,না কিছুই স্পষ্ট করে বলেন নি। পরবর্তীতে প্রস্তাবগুলি নিয়ে তাঁরা কি স্থির করলেন তাও আর জানান নি। আর যোগাযোগও নেই তাঁদের সাথে।

বছর কয়েক আগে তিন চারজন বন্ধু মিলে ডা: রাব্বীর পরিতক্ত ভিটা তাঁদের গ্রামে দিখতে গিয়েছিলাম। মনটা বিষাদে ভরে গিয়েছিল দেখে এবং জেনে। গ্রামবাসীরা বললেন-আমরা তাঁকে খুব কমই দেখার সুযোগ পেয়েছি তিনি ছাত্রাবস্থা থেকে বরাবই ঢাকায় থাকার কারণে এবং আমাদের বয়স কম হওয়ায়। তবে শুনতাম যে তিনি ছিলেন খুবই বড় মাপের একজন ডাক্তার এবং পাক-বাহিনী ও রাজাকার আলবদরেরা তাঁকে মেরে ফেলেছে। একথা ভাবলে কষ্ট পাই মনে। ডা: রাব্বীর স্মৃতিতে কিছু করার কথা আপনারা কি ভাবছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বললেন, আমরা ক্ষুদ্র কৃষক। মন থাকলেও সাধ্য তো নেই। তবে আমরা যা পারি তা করেছি। গ্রামে তাঁর নামে একটি প্রাইমারী স্কুল গড়ে তুলেছি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠলো গ্রামবাসীদের কথাটি শুনে। সেদিন চোখে পড়েছিল-ডা: ফজলে রাব্বীর বাড়ী বা গ্রাম পর্য্যন্ত ভাল কোন সংযোগ সড়কও নেই। ইতোমধ্যে হয়েছে কিনা জানা নেই।

আমি ডা: রাব্বীর নামে কিছু একটা পাবনাতে করা সরকারের করণীয় বলে মনে করি। তাই কয়েকবার পত্রিকায় লিখেছি পাবনায় প্রতিষ্ঠিত (সরকার কর্তৃক) মেডিক্যাল কলেজটির নামকরণ করা হোক ”পাবনা শহীদ ডা: ফজলে রাব্বী মেডিক্যাল কলেজ”। তা যথারীতি ছাপাও হয়েছে কিন্তু আজও কোন ফলোদয় ঘটে নি।

এ বছরের প্রথম দিকে বর্তমান স্বাস্থমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম পাবনা মেডিক্যাল কলেজের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন। সাংবাদিক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে অনুষ্ঠানে যাই। খুব চমৎকার সামিয়ানা-মঞ্চ-অতিথিদের বসার আয়োজন করা হয়েছিল। আয়োজকেরা অতিথিদের প্রথম সারিতে আমাকে নিয়ে বসালেন। মন্ত্রী এবং অন্যরা কিছু পরে মঞ্চে এলেন। আসন গ্রহণ করলেন। বেশ কিছু পড়ে মন্ত্রীর নজরে পড়লো আমি নীচে বসা। তৎক্ষণাৎ তিনি কলেজের একজনকে পাঠালেন আমাকে মঞ্চে নিয়ে যেতে। আকস্মিকতায় কিছুটা বিব্রত বোধ করলেও- গেলাম-মন্ত্রীর পাশেই আমাকে চেয়ার দেওয়া হলো। বসলাম।

এক পর্য্যায়ে পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে লিখলাম এই কলেজটির নাম ”পাবনা শহীদ ডা: ফজলে রাব্বী কলেজ” রাখা হোক। দিলাম তাঁর হাতে। তিনি দেখে কিছু বললেন না-তবে কাগজের টুকরাটি পকেটে রাখলেন। বছর তো শেষ হতে চললো-আজও কিছু হয় নি। তবে আশা ছাড়ি নি। দেখা যাক কি হয়। মন্ত্রীতো বৃহত্তর পাবনা জেলার সন্তান-এবং পাবনা শহর তাঁর জন্মস্থান এবং বাল্যের ও যৌবনের কর্মস্থল। তাই আশাবাদটা একটু বেশী।

আর সড়ক বিভাগ যদি ডা: ফজলে রাব্বীর বাড়ী পর্য্যন্ত ভাল সড়ক নির্মাণ করে দেন-ঐ মানুষ যেমন তাতে উপকৃত হবে তেমনই যাঁরাই ডা: রাব্বীর বাড়ী দেখতে যেতে চাইবেন-তাঁরাও সহজেই যেতে পারবেন। আশা করতে চাই এ কাজটিও অচিরেই হবে।

অধ্যাপক আনোয়র পাশা পাবনার সন্তান নন-ছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড-কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। তিনি মুর্শিদাবাদের সন্তান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যের ¯œাতকোত্তর করে মুর্শিদাবাদ/বহরমপুর কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন। বরাবরের ভাল ছাত্র তিনি। পড়েছেনও বহরমপুর কলেজেই। তাঁর আকাংখা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার। হঠাৎ আকদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে জানতে পারেন- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে একজন শিক্ষকের পদ খালি হওয়ায় ঐ পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রার্থীদের যোগ্যতা ও শর্তাবলী বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা ছিল।

তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা দেখে অত্যন্ত আশাবাদী চিত্তে বিজ্ঞাপনের চাহিদা মোতাবেক কাগজপত্র সংগ্রহ করে দরখাস্ত করলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। সময়মত ইন্টারভিউ এর কার্ডও পেলেন। গেলেন কলকাতা, ইন্টারভিউ দিয়ে এলেন। ইন্টারভিউ ভাল করেছেন বলে আশাবাদের মাত্রা আরও বেড়ে গেল আনোয়ার পাশার মনে। থাকলেন অপেক্ষায়। কিন্তু অপেক্ষার যেন আর শেষ নেইÑশেষ হয় না অপেক্ষার পালা। অবশেষে সংশয়। শেষতক একদিন ছুটলেন কলকাতায় অনুসন্ধান নিতে। জানলেন ঐ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি যোগদানও করে ফেলেছেন। গেলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের তাঁর পরিচিত একজন সদস্যের কাছে-বিস্তারিত জানতে। তিনি প্রথমে দুঃখ প্রকাশ করলেন অতঃপর জানালেন যোগদানকারীর নাম। দেখা গেল ঐ যোগদানকারী আনোয়ার পাশারই একজন সাবেক ছাত্র। সাবেক শিক্ষক হিসেবে তিনি এও জাননে-তাঁর অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা তাঁর চাইতে অনেক কম- জিজ্ঞেস করলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যকে-কি করে সম্ভব হলো এটা। তিনি বললেন, আপনার যাবতীয় রেকর্ড তার চাইতে ভাল-ইন্টারভিউও সর্বাপেক্ষা ভাল দিয়েছেন। একজন বাদে বোর্ডের সবাই আপনার পক্ষে দৃঢ়মত দিয়েছিলেন কিন্তু বোর্ডের প্রধান সব নাকচ করে ঐ প্রার্থীকে মনোনীত ঘোষণা করে নিয়োগ দেন একটি মাত্র কারণে যে ঐ প্রার্থীটি হিন্দু ঘরের সন্তান। শুনে মাথায় বাজ পড়লো অধ্যাপক আনোয়ার পাশার। সাম্প্রদায়িকতা? তাও আবার ভারতের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে? নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ফিরে এলেন বহরমপুর। বিতৃষ্ণা জাগলো মনে। ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা মারাত্মকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েন। যে ভারত তাঁর মাত্রভূমি, যে ভারত তাঁর স্বপ্নের ও সাধনার , যে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ -যে ভারত গান্ধীজীর, প-িত নেহেরুর, মওলানা আজাদের-যে ভারত অজশ্র গৌরবের ইতিহাস রচনাকারী-তারই এবং রবীন্দ্রনাথ - নজরুল ও জীবনানন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে সাম্পদায়িকতা-তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না-বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল তাঁর।

এহেন মানসিক অবস্থা চলাকালে অকস্মাৎ একদিন জানতে পারেন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনাতে এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা বিভাগের জন্য শিক্ষক নেওয়া হবে । দরখান্ত করে বসলেন ঐ চাকুরীর জন্য। পেয়েও গেলেন। ছুটে চলে এলেন পাবনায়। যে পাকিস্তান দ্বিজাতিতত্ত্বের, যে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র-সেই পাকিস্তান ছিল তাঁর কাছে ঘৃণার ও অপছন্দের। কিন্তু ঐ পরিস্থিতি এড়াতে তিনি সপরিবারে মুর্শিূদাবাদ ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান চলে এলেন। রাধানগরে একটি বাসাও ভাড়া নিলেন।

এটা ষাটের দশকের গোড়ার দিককার কথা। আমি তখন এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএ পাশ করে বেরিয়ে এসেছি কয়েক বছর আগেই। পাবনা সদর মহকুমা ন্যাপের সাধারণ কম্পাদক ছিলাম তখন। কিন্তু আইউবের মার্শাল ল’। রাজনীতি নিষিদ্ধ - তাই প্রকাশ্যে কিছু করা সম্ভব ছিল না।

আমাদের নৈমিত্তিক সকাল-সন্ধা আড্ডা ছিল তখনকার ন্যাপ নেতা শহীদ ডা: অমলেন্দু দাক্ষীর চেম্বারে। ডা: দাক্ষী পেশাগত ব্যস্ততা সত্বেও নিজেই ছিলেন এ আড্ডার মধ্যমণি। তিনি তখন পাবনার একমাত্র দন্তচিকিৎসক। বিশাল ফিগার-সদা হাসিমুখ। ওখানে শুধুমাত্র ন্যাপের নেতাদের আড্ডা ছিল তা নয়। আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও ফাঁক-ফোকড় পেলেই চলে আসতেন ঐ আড্ডায় ভিন্ন স্বাদে কিছু সময় কাটাতে। আসতেন আরও শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীরাও। বলা চলে, ওটা ছিল পাবনার প্রগতিশীল শক্তির এক চমৎকার মিলন ক্ষেত্র। কমিউনিষ্ট পার্টিও গোপন যোগাযোগ রক্ষার সুযোগ পেত দিব্যি। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা প্রায়:শই আসতে শুরু করলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ রবীন্দ্র ভক্ত, রবীন্দ্র গবেষকও। রবীন্দ্র জয়ন্তী, রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবস, নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে ধীরে, ধীরে আনোয়ার পাশা হয়ে উঠলেন সকলের অন্যতম প্রিয়জন।

এলো ১৯৬২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচন আইউব দিতে চান নি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দাবীর মুখে নিজ পছন্দমত একটা সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে এই আয়োজন। সাধারণ ভোটাররা ভোটার নন। উভয় পাকিস্তান মিলে মোট ৮০,০০০ ভোটার। মৌলিক গণতন্ত্রীরা-অর্থাৎ ইউনীয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান -মেম্বররা ভোট দেবেন। পাবনাতে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় গোপন সিদ্ধান্ত না মেনে ঐ নির্বাচনে পৃথক পৃথক প্রার্থী দেয়। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ছিল নির্বাচন বর্জনের। দাক্ষীর চেম্বার হয়ে দাঁড়ালো ন্যাপের এক অঘোষিত বিকল্প অফিস। যা হোক নির্বাচন সমাপ্ত হলো সন্ধার আগেই। নেতারা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছেন-বিনে পয়সার চা উপভোগ করছেন। হঠাৎ জানা গেল দাঙ্গা লেগে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গ। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বস্তুত: হিন্দুরা একতরফাভাবে আক্রান্ত। সারা রাত ধরে চললো অগ্নিসংযোগ,খুন, অপহরণ,লুট-পাট প্রভৃতি। পাবনার মত ছোট্ট শহরে ঐ রাতে ৩০ জনের অধিক হিন্দু খুন হন-হাজার হাজার বাড়ী অগ্নিদগগ্ধ লুট-পাট সীমাহীন।

এডওয়ার্ড কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্ররা নিরাপত্তাহীনতায় ছুটে যায় অধ্যক্ষের কাছে। তিনি কিছু করতে অপারগতা প্রকাশ করে এস,পি’র কাছে অথবা থানার সহায়তা চাইতে বলে দরজা বন্ধ করে দেন। খবর পেয়ে ছুটে আসেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। শুনলেন আতংকিত ছাত্রদের কাছে। ডাকলেন নাইট গার্ডকে । বললেন টিচার্স ওয়েটিং রুম খুলে দিতে। ছেলেদের সবাইকে চুপচাপ সেখানে চলে আসতে বললেন। তাদেরকে ঢুকিয়ে দিলেন ঐ রুমে। তালাবদ্ধ করলেন। বলে গেলেন চুপচাপ ঐ রুমে রাতটা কাটাতে। নাইট গার্ডকে বললেন কদাপি না খুলতে এবং সর্বদা সতর্ক নজর রাখতে।

আনোয়ার পাশা নিজ বাসায় ছুটে গিয়ে স্ত্রীকে জনা ত্রিশেকের জন্য ডাল ভাত রান্না করতে বলেন। রান্না শেষে ভাত-তরকারী-ডাল, কয়েকটি প্লেট ও কলসীভরা খাবার জল ও গ্লাস রিকসায় সাধ্যমত লুকিয়ে নিয়ে নিজেই ছুটে এলেন কলেজ ক্যাম্পাসে। রাত তখন ১১টার কম না। সারা শহর জ্বলছে। যেদিকে তাকানো যায় আগুন-ফুলকি আর ধোঁয়া বাতাসে ভেসে আসে মানুষের আর্ত চীৎকার। আর আসে দাঙ্গাকারী গুন্ডাপান্ডাদের পাশবিক উল্লাসের আওয়াজ। নৈশপ্রহরিকে বলে টিচার্স কমন রুমের দরজা খুলিয়ে খাবার ঢুকিয়ে দিয়ে ছেলেদেরকে বললেন, তোমরা চুপচাপ খেয়ে নাও। দরজা বন্ধ থাকবে-সকালে আসবো দেখা হবে। নৈশ প্রহরীকে রুমটি আটকাতে বলে আরও কিছু নির্দেশ দিয়ে ফিরে গেলেন। সকালে এলেন আবার - দরজা খুলিয়ে সবাইকে হোটেলে ফিরে যেতে বললেন।

এভাবে তিনি সাম্প্রদায়িক শাক্তির আক্রমনের সম্ভাব্য হাত থেকে হিন্দু ছাত্রদেকে রক্ষা করলেন । অথচ তিনি নিজে ভারতের একজন উচ্চ-শিক্ষিত ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক আচরণের শিকার হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগী হয়ে পাবনা এসে আশ্রয় নিয়েছেন। ছেলেদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত হলেও অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি ঘৃণায় ও নিন্দায় সরব ছিলেন।

কিছুকাল পর অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি শিক্ষক পদে। নিয়োগপত্র পেয়েই সেখানে গিয়ে যোগ দান করেন। পরিবার পরিজনকেও নিয়ে যান সেখানে। সম্পর্ক ছিন্ন হয় পাবনার সাথে। কিন্তু পাবনা তাঁকে বহুদিন মনে রেখেছেন-তিনিও মনে রেখেছেন পাবনাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ধীরে ধীরে তিনি অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষকে পরিণত হন। আর এই জনপ্রিয়তাই ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হয়ে পড়েলো তাঁর জীবনের প্রতি হুমকি স্বরূপ। ঠিকই তাঁকে চিহ্নিত করে পাকিস্তানি জানোয়ারেরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে একজন নির্দোষ শিক্ষকেরই নয় একজন মহৎ প্রাণ নিবেদিত প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষকে। তাই তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন মানুষের হৃদয়ে। তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

এই সুযোগে আরও শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখি পাবনার শহীদ ডা: অমলেন্দু দাক্ষী, মওলানা কছিম উদ্দিন, এডভোকেট আমিন উদ্দিন, শিবাজীবাবু সহ স্থানীয় শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরকেও।

লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test