E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধারা পরশ্রীকাতরতার শিকার !!!

২০২০ ডিসেম্বর ২৬ ২২:৪৪:২৯
মুক্তিযোদ্ধারা পরশ্রীকাতরতার শিকার !!!

আবীর আহাদ


আমার ধারণা, উনিশশো একাত্তর সনে সাড়ে সাতকোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার পক্ষে । ঐ পাঁচ কোটির মধ্যে নিশ্চয়ই পনেরো থেকে চল্লিশ বছরের কিশোর-যুবকের সংখ্যা ছিলো প্রায় আড়াই কোটি ! কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত মহাসমরে জীবন দেয়া-নেয়ার চেতনা ও ব্রত নিয়ে সশস্ত্র হয়ে মাঠে নেমেছিলো মাত্র দেড় লক্ষের মতো কিশোর-যুবকরা ! বলতে দ্বিধা নেই, বাকিরা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে নিরাপদ দূরত্বে । তারা ছিলো ভীরু-কাপুরুষ, দোদুল্যমান, সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী ।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেদিন বিজয়ী বীরের অভিধা অর্জন করে ঘরে ফিরেছেন, সেদিন থেকেই তারা বিপুল সংখ্যক ঐ ভীরু-কাপুরুষদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে । মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার কিছুসংখ্যক যোদ্ধা অসচেতনভাবে আত্মীয়তা অথবা বন্ধুত্বের কারণে তাদের অতিরিক্ত অস্ত্রগুলো বহন করে পার্শ্ববর্তী থানা অথবা মিলিশিয়া ক্যাম্পে জমা দেয়ার সুবাদে ঐ অমুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা খাতায় নাম লিখিয়েছিলো । এদেরকেই সিক্সটিন ডিভিশন বলা হয়, তবে আনুপাতিক হারে এদের সংখ্যা ছিলো খুবই নগণ্য ।

পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধার চাকরি-বাকরি সুযোগ, তারও পরবর্তীতে মাসিক ভাতা প্রচলন করা হলেই ঐ সেই ভীরু-কাপুরুষ দলের মধ্যকার অতিলোভী, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও পরশ্রীকাতরতার মানুষগুলো আত্মীয়তা, রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিয়ন উপজেলা জেলা ও কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, নেতা এমপি মন্ত্রী এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের স্বার্থান্ধ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ঢুকে পড়ে ।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, (জামুকা) ও রাজনৈতিক নেতাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই । মূল দোষী সরকারের অনুসৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই সংজ্ঞা ও নির্দেশিকা । বঙ্গবন্ধু সরকার উনিশশো বাহাত্তর সনে কারা মুক্তিযোদ্ধা----এ-বিষয়ক যে ঐতিহাসিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটাই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা । তাতে বলা হয়েছিলো : 'মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি একটি সংঘবদ্ধ দলের (ফোর্স) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন'। কিন্তু বিভিন্ন সরকারের কী দু:সাহস, তারা বঙ্গবন্ধুর সেই সংজ্ঞাকে অবজ্ঞা ও বাইপাস করে নিজেদের দলীয় নেতা-কর্মী ও আত্মীয়-স্বজনকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর লক্ষ্যে খেয়ালখুশি মতো মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা ও নির্দেশিকা তৈরি করে এ-সুবর্ণ সুযোগটি করে দিয়েছে । এ-সুযোগটি গ্রহণ করেছেন ঐসব দুষ্কৃতিকারীরা । এই ভয়াবহ দোষে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সমানভাবে দোষী ।

আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বসাকুল্য সংখ্যা দেড় লক্ষের নিচে । কিন্তু অতীতের বিএনপি-জামায়াত ও হালের আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে সে-তালিকা বৃদ্ধি পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের ওপরে----যার মধ্যে প্রায় আশি/পঁচাশি হাজারই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা । এরা অমুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, এমনকি তার মধ্যে হাজার হাজার রাজাকারও রয়েছে ! এ-বিষয়টি অনুধাবন করে আমিই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদের একটি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাই । পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে তাদের ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তুলি । দাবি দু'টি আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে ।

এই যে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বা সরকারি আয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জঘন্যতম প্রবৃত্তি, এর মূলে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চরম হিংসা ও তাদের মর্যাদার প্রতি পরশ্রীকাতরতা । সেই মুক্তিযুদ্ধকালীন ভীরু-কাপুরুষের দল তাই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আজ মুক্তিযোদ্ধা খাতায় নাম লেখানোর জন্য হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে । আর এ জঘন্য প্রতিযোগিতায় উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী, সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সুবিধাবাদী ও প্রতারকচক্র শামিল হয়েছেন । মোদ্দা কথা, মুক্তিযুদ্ধে যে অধিকাংশ নিম্নশ্রেণীর দরিদ্র মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেসব নিম্নশ্রেণীর দরিদ্র মানুষকে জাতীয় বীর বা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানের মর্যাদা দেয়া যাবে না----অমুক্তিযোদ্ধা হলেও উচ্চবিত্ত ও উচ্চশ্রেণীর টাউট বাটপাঢ়দেরও ঐ মর্যাদায় আসতেই হবে ! এটাই হলো প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একাত্তরের সেই ভীরু-কাপুরুষ ও সুবিধাবাদী-----যারা আজ অর্থবিত্তে ও রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান-----তাদের প্রতিহিংসা ও পরশ্রীকাতরতার জ্বলন্ত প্রকাশ ।

আমাদের অনেক আন্দোলন সংগ্রাম ও লেখালেখির কারণে অবশেষে সরকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মধ্যে বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই করার একটি কার্যক্রম শুরু করেছেন । সরকারসহ আমাদের অনেকেরই ধারণা এই যে, বেসামরিক গেজেটধারীদের মধ্যে বিরাটসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে----যদিও আমরা এও জানি যে, অন্যান্য তালিকার মধ্যেও কমবেশি অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে । আমরা আশা করি এবং দাবি জানাচ্ছি যে, বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাইয়ের পর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য তালিকার ভুয়াদেরও উচ্ছেদের ব্যবস্থা করতে হবে ।

যে পরশ্রীকাতরতার শিকার হয়ে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা এতোকাল ভুয়াদের কারণে সমাজে অপমান ও অপদস্থের শিকার হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যারা বীর মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদায় যারা ভাগ বসিয়েছে, সরকার তথা জনগণের অর্থ লুটপাট করে চলেছে----তাদের ধরার একটা মওকা পাওয়া গেছে । এ মওকার সদ্ব্যবহার করে ভুয়াদের অপসারণের জন্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয়ই কার্যকর ভূমিকা রাখবেন । প্রত্যেক এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ভালো করেই জানেন যে, কারা সেই নরাধম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা । তাই যাচাই বাছাই কার্যক্রমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোনোক্রমেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন না । অনুরূপভাবে কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যেনো কোনো কারণে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test